বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


রাহুল দেব বর্মণ।

১৯৮২ সাল পঞ্চমের শেষ হয় বহু ব্যস্ততা এবং সাফল্যের মধ্যে দিয়েই। একের পর এক মনমাতানো সুর রচনা করে নিজের জনপ্রিয়তাকে তুলে নিয়ে আসেন সর্বোচ্চ শিখরে। বলাই বাহুল্য, তার সঙ্গে দেশজোড়া খ্যাতি এবং অসংখ্য গুণমুগ্ধ। তাই, ১৯৮৩ সালটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁর জীবনে। ভারতীয় সংগীত জগতের এই সান্তা ক্লজের ঝুলি যে একটি পরিপূর্ণ সুর-ভান্ডার। শুধু ঝুলির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে নতুন একটি সুর বাইরে নিয়ে আসার দেরি। সেই সুরের ঢেউ আছড়ে পড়বে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা। তাও আলোর গতিতে। যে ঢেউ শ্রোতামনকে সিক্ত করে তুলবে এক নিমেষে। যে ঢেউ শ্রোতাকুলকে করে তুলবে নেশাতুর। যে সুর দেশের গণ্ডী পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলিতে, এমনকি অন্য মহাদেশেও।
‘দৌলত কে দুশমন’ ছবিতে দৃশ্যের দাবি অনুযায়ী ‘হাম তো হ্যায় সবকে ইয়ার’ গানটিকে ক্যাবারের ধাঁচে তৈরি করেন পঞ্চম। গাওয়ান কিশোর-আশা জুটিকে দিয়ে। আশানুরূপভাবে উপস্থাপিত হয় গানটি।

কিন্তু ‘জানা হ্যায় হামে’ গানটির ক্ষেত্রে কিশোরের জুটি হিসেবে পঞ্চম বেছে নেন লতাকে। এর প্রধান কারণ দুটি। প্রথমত, এই গানের সুরের কাঠামো এবং দ্বিতীয়ত গানের প্রবাহ। তাই এই গানের ক্ষেত্রে কিশোর-লতা জুটিকেই চয়ন করেছেন সুরকার।

কিশোরের গাওয়া ‘জিনা তো হ্যায় পর আয় দিল কাহা’ গানটির কথা একটিবার ভাবুন তো? মেজর এবং মাইনর মিশিয়ে কী অনবদ্য এক প্যাথস মাখানো সুরই না রচনা করেছেন পঞ্চম! নায়কের তীব্র মানসিক যন্ত্রণার অভিব্যক্তি হিসেবে গানটিকে যথাযত ভাবে সৃষ্টি এবং ব্যবহার করা হয়েছে। এই গানের জন্য কিশোর ব্যতীত অন্য কারো কথা পঞ্চমের মাথায় আসা একপক্ষে অসম্ভব। গানটি কানে এলে একটু হলেও আমরা মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি বইকি?
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪৪: তু তু হ্যায় ওহি, দিল নে জিসে আপনা কহাঁ…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

কিন্তু সম্পূর্ণরূপে এক ভিন্ন কিশোরকে আমরা দেখতে পাই এই ছবির ‘জো ভি হুয়া হ্যায় ও পেয়ার মে হুয়া হ্যায়’ গানটিতে। এই গানে কিশোর একজন প্রেমিক। একজন দিওয়ানা। তাই তাঁর উপস্থাপনাটিও সেইরকম। আর হবে নাই বা কেন? নেপথ্যে যে বসে রয়েছেন পঞ্চম স্বয়ং। তাঁর সুরের জাদুকাঠি এবং কিশোরের কণ্ঠ, এই দুইয়ে মিলে যে একটি উন্মাদনার সৃষ্টি করবে তাতে আর সন্দেহ কোথায়?

ঠিক যেমন শক্তি সামন্ত প্রযোজিত ‘ম্যায় আওয়ারা হুঁ’ ছবির ‘মেরা রাস্তা মেরি মঞ্জিল’ গানটি। নায়ক সঞ্জয় দত্ত। কিন্তু তাতে কি? কিশোর ম্যাজিক তো রয়েইছে! আরডি-র সুরে নবীন নায়কের লিপে কিশোর আবার অনবদ্য। গানের দৃশ্যটি চাক্ষুষ করার সময় কখনও মনে হবে না যে গায়ক এবং নায়ক ভিন্ন। কিশোর পঞ্চম জুটির আবারও সেই জয়জয়কার।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩০: সুন্দরবনে লৌকিক দেবতা ছাওয়াল পীর ও রাখাল ঠাকুর

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৫: ঠাকুরবাড়ির দখিনা বাতাস— জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

‘কৌন কিসে’ ছবির ‘আও মেরে পাস আউর আও’ গানটির ছন্দ অত্যাধুনিক। তৎসত্ত্বেও মেলোডি যেন রাজ করে গিয়েছে পুরো গানটি জুড়ে। আসলে পঞ্চমের সুর রচনার একটি বৈশিষ্ট্য, অথবা প্রধান বৈশিষ্ট হল মেলোডি। যেটির জন্ম দিতে গিয়ে তিনি কখনও কোনও কিছুর সঙ্গে আপোস করেননি। বিভিন্ন সূত্রে এও শোনা যায় যে, মেলোডির স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রে লেখককে দিয়ে গানের কথার কিঞ্চিৎ পরিবর্তনও করিয়েছেন পঞ্চম। কারণ সুরারোপ করার আগে খুব ভালো করে লেখাগুলিতে চোখ বোলাতেন তিনি। লেখক ঠিক কি ব্যাক্ত করতে চাইছেন, দৃশ্যটি কেমন হবে, এমন কি যে জায়গায় গানটিকে ক্যামেরা বন্দি করবেন পরিচালক, সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিতেন। তারপর বসতেন হারমোনিয়াম নিয়ে। চলত গবেষণা। তারপর ভূমিষ্ঠ হতো এক একটি মর্মস্পর্শী সুর।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪২: নিজেকে যিনি আড়ালে রেখেছিলেন

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে

ঠিক যেমন নিকম্মা ছবির কিশোরের গাওয়া ‘কই শামা শিশে কি লায়া’ গানটি। নায়িকার সম্মতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে নায়কের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা, গানের মাধ্যমে। যেমন গুলশান বাওড়ার লেখা, তেমনই পঞ্চমের মেলোডি। অমন একটি লেখা যেন এমনই একটি সুরের অপেক্ষায় বসে ছিল। এই সুরকে আপন করে সে যেনো পরিপূর্ণতা পেল। গানটি একটিবার শোনার অনুরোধ রইল।
মেলোডি কিং আরডি বর্মণের কারনামার আরেকটি নিদর্শন হল এই ছবির ‘তেরে বিনা ম্যায় কুছ ভি নেহি’ গানটি। গানটির আনাচে-কানাচে পাবেন মেলোডি ম্যাজিক। কিশোর এবং আশার দ্বৈতকণ্ঠ এবং তার সঙ্গে কোরাসের মূর্ছনা। এই গান আপনাদের মন চুরি করবেই।

পঞ্চম সুরারোপিত বাংলা গান ‘সন্ধ্যাবেলায় তুমি আমি বসে আছি দু’জনে’ গানটি শোনেননি এমন বাঙালি বিরল। আর ঠিক একই সুরে গুলশান বাওরার লেখা এই ছবির ‘তেরি বিনা আব এক পল’ গানটি সাজিয়ে ফেলেন পঞ্চম। বাংলা গানটির মতো এই গানটির ক্ষেত্রেও গাওয়ার গুরুভার দেওয়া হয় আশাকে। আর যা হওয়ার তাই হয়। জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছে যায় গানটি। শুধুমাত্র সেই যুগেই নয়। গানটি আজকের দিনেও একই রকম জনপ্রিয়। এই ভাবেই ছুটে চলে পঞ্চম এর বিজয়রথ।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content