শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


‘ইয়ে ওয়াদা রহা’ ছবিতে আবারও পঞ্চম এবং গুলশন বাওরা একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান। গায়ক এবং গায়িকার দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় যথাক্রমে কিশোর কুমার এবং আশা ভোঁসলেকে। একে একে ছবির গানগুলি লেখা শেষ হলে গুলশন সাহেব পঞ্চমকে নিয়ে বসেন। ‘আইসা কাভি হুয়া নেহি’ গানটিতে ঋষি কাপুর লিপ দেবেন। গাইবেন কিশোর। শুরু হয় রিহার্সাল এবং তারপর গানটির রেকর্ডিং সম্পন্ন হয়। বাজিমাত করেন কিশোর। ঋষি কাপুরের ব্যাক্তিত্বের ছাঁচে নিজের কণ্ঠকে ফেলে দারুন একটি টেক্সচার তৈরি করেন কিশোর কুমার।

গানটি শোনার সময় যদি একটু খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন যে আবহ সঙ্গীতগুলি বেজে চলেছে ঠিকই কিন্তু কিশোরকণ্ঠকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। ইচ্ছে করেই পঞ্চম কিশোরকে তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি প্রাধান্য দিতেই বাদ্যযন্ত্রগুলিকে একটু যেনো আড়ালে রেখেছেন।

এই ছবির ‘জিনে কো তো জিতে হ্যায় সভি’ গানটি কিশোর-আশার দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া বহু মনমাতানো গানের মধ্যে একটি। নায়ক ঋষি কাপুর এবং নায়িকা পুনম ধিলনের কণ্ঠ হয়ে উঠে দু’ জনে মিলে কি অসাধারণ ভাবেই না পরিবেশিত করেছেন গানটি। মূলত বঙ্গের মাধ্যমে মাঝারি গতির একটি ছন্দ ব্যবহার করেছেন পঞ্চম। জায়গা বিশেষে ভায়োলিনের প্রবেশ, বিশেষ করে অব্লিগেটোর অংশগুলিতে, যেন আলাদা একটি সৌন্দর্যের ছোঁয়া দিয়ে গিয়েছে গানটিতে।

মাইনর স্কেলে জন্ম নেওয়া ‘ম্যায়নে তুঝে কভি কুছ কাহা থা’ গানটির মধ্যেও কোনও দ্রুত ছন্দ ব্যবহার করেননি পঞ্চম। তবলা এবং বঙ্গের সাহায্যে ধির গতির একটি ছন্দের আশ্রয়ে সুরের ডালি সাজিয়েছেন এবং কিশোর এবং আশা সেই সুরে নিজেদের কন্ঠ দিয়ে ছবি এঁকে গিয়েছেন। ঠিক যেন কোনও এক ক্যানভাসে তুলির টান।
পঞ্চম সুরারোপিত যে কটি গানে বেস গিটার আমাদের মুগ্ধ করে তার মধ্যে অন্যতম হল এই ছবির ‘তু তু হ্যায় ওহি, দিল নে জিসে আপনা কহাঁ’। গানের শুরুতেই টনি ভাজের বেস গিটারের ‘বৈদ্যুতিক চমক’। তার কিছু পরেই গানটির মূল স্রোতে প্রবেশ। এটিও মাইনর স্কেলেই রচিত এবং গানটিতে ছন্দের সূক্ষ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেটি পঞ্চম এর স্বভাবসিদ্ধ একটি ব্যাপার। কিশোর আশার কথা নতুন করে কী বলি? ঋষি কাপুর এবং পুনম ধিলনের অভিনয়কে যেনো আরও বেশি করে আলোকিত করে তুলেছে গায়ক গায়িকার কণ্ঠের জাদু।

আসে বাসু চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘সৌকিন’ ছবিটি। গানগুলি লেখেন যোগেশ সাহেব এবং সুরকার যথারীতি আরডি বর্মন। ‘যব ভি কই কঙ্গনা বলে’র মতো একটি অসাধারন গানের জন্ম হয়। খুবই মজার গান। দৃশ্যে উৎপল দত্ত, একে হাঙ্গল এবং অশোক কুমারকে দেখা যায়। আরও একটি মজার ঘটনা হল এই গানে দাদামনি অশোক কুমারকে লিপ দিতে শোনা যায় তাঁরই অনুজ কিশোরকে। দাদা লিপ দিচ্ছেন ভাইয়ের কণ্ঠে। মজার ঘটনাটি একবার ভাবুন।

পঞ্চমের সুরের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় আলোকিত এই ছবির ‘সুহানি সাম আই হ্যায়’ গানটি আশা উপস্থাপিত করেছেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢংয়ে। অবশ্যই নেপথ্যে রয়েছেন পঞ্চম এবং তাঁর দলের কারিকুরি। সেই মনমাতানো ছন্দ, বাদ্যযন্ত্রের এবং কোরাসের সুপরিকল্পিত ব্যবহার, সুরের প্রবাহ এবং আশাকণ্ঠের মাদকতা সব মিলিয়ে গানটি ভালো লাগতে বাধ্য।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪৩: এ রি পবন ঢুন্ডে কিসে তেরা মন…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৭: হারায়ে খুঁজি চন্দ্রনাথ

সুনীল দত্ত পরিচালিত ‘দরদ কি রিস্তা’ ছবিতে আনন্দ বকশির লেখা গানে সুর করেন পঞ্চম। ‘কৌন হুঁ ম্যায় কেয়া নাম হ্যায় মেরা’ কি অপূর্ব গান। সহজ সরল একটি সুরকে আশ্রয় করে জন্ম নেওয়া এই গানটিতে এক শিশুশিল্পী তাঁরই জন্মদিনের পার্টিতে লিপ দিচ্ছে বাগদেবীর আশীর্বাদধন্যা লতা মঙ্গেশকরকে। একটি শিশুর অভিব্যক্তি কি অসামান্য ভাবেই না ফুটিয়ে তুলেছেন লতা। কোনও তুলনাই চলে না।

‘বাপ কি জাগা মা লে স্যাকতি হ্যায়’ গানটি একটু হলেও আপনার নয়নযুগলকে অশ্রুসিক্ত করবেই। মাতৃহারা এক অবোধ শিশুর জন্য নায়ক গাইছেন গানটি। শিশুটিকে মায়ের স্নেহ না দিতে পারার একরাশ আক্ষেপ নিয়ে এক বাবা গাইছেন গানটি। সেই বাবার আক্ষেপ আমদের কানে আরও বেশি করে প্রতিধ্বনিত হয়েছে কেন জানেন? কারণ গায়কের নাম কিশোর কুমার। এমন ভাবে গানটি গেয়েছেন তিনি, শুনে মনে হবে এই আক্ষেপ তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত। নায়কের দুঃখ নয়, মনে হবে তিনি যেন তাঁর নিজের দুঃখের কথাই শ্রোতাদের ব্যক্ত করছেন গানটি গেয়ে। এমনই প্যাথস রয়েছে তাঁর কণ্ঠে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

‘ইউ নিন্দ সে ওহ জানে চামান জাগ উঠি হ্যায়’। এটি এমন একটি গান যেটি শুনলে প্রবাসে থাকা যে কোনও মানুষের নিজের দেশে শৈশবে কাটানো দিনগুলি একের পর এক মনে পড়তে বাধ্য। বিদেশের একটি আধুনিক শহরের প্রেক্ষাপটে ইমন রাগে রচিত এমন একটি গান সেই সব মানুষদের অতীত-আর্ত করে তুলবেই। কিশোরের আবেগ তো বটেই। বিশেষ করে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ইন্টারলুড দুটি, যেখানে যথাক্রমে সেতার এবং ভায়োলিনের যুগলবন্দি শোনা যায় এবং পরেরটিতে সারেঙ্গি এবং সেতার। ফেলে আসা দিনগুলিকে ফিরে পেতে আমাদের কিছুটা ব্যাকুল করে তোলে গানটি। গানটি শোনার পর সেই রেশটি থেকে যায় পরবর্তী বেশ কিছু সময় ধরে। বিষয় সেটি নয়। বিষয় হল গানটির বক্তব্য এবং প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাগ-চয়ন এবং সুরটির ধরন। এটি পঞ্চম বলেই সম্ভব। এটি তাঁর যে কোনও সমালোচকও এক কথায় স্বীকার করবেন।

‘তেরি কসম’-এর মতো একটি ছবিতে পঞ্চম ডাক পাবেন না সেটি কি হয়? তাও আবার গীতিকার যখন আনন্দ বকশি? নায়ক হলেন কুমার গৌরব এবং নায়িকা পুনম ধিলন। তাই তাদের কণ্ঠ হিসেবে পঞ্চম বেছে নিলেন যথাক্রমে কিশোর পুত্র অমিত কুমারকে এবং লতা মঙ্গেশকরকে। ‘হাম জিস রাস্তে পে চলে’ গানটি একটি যুবক যুবতীর মিষ্টি প্রেমের গান হিসেবে একশো তে একশো পাবেই। শুধুমাত্র সেই যুগেই নয়। আজকের দিনেও। যদি গানটি আপনারা শুনে থাকেন তাহলে আমার সঙ্গে যে এই বিষয়ে একমত হবেন এটি আমার বিশ্বাস। অমিত-লতা জুটি আবারও অনবদ্য।

‘দিল কি বাত কাহি লব পে না আ যায়’ গানটি অমিত কুমারকে দিয়ে গাওয়ানো হয় কুমার গৌরবের লিপে। তরুণ নায়ক, তরুণ গায়ক এবং নেপথ্যে পঞ্চম। সুতরাং গায়ক-নায়ক জুটি যে বাজিমাত করবেই সেটি কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: স্বপ্নে আমার মনে হল

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৯: গাধা পিটিয়ে ঘোড়া

একই কথা প্রযোজ্য ‘ইয়ে জমিন গা রহি হ্যায়’ গানটির ক্ষেত্রে। সেই একই রসায়ন। পঞ্চম, অমিত কুমার এবং কুমার গৌরব। এই গানটির আবেদনও গভীর এবং চিরস্থায়ী। অমিত কুমারের একটি অনুষ্ঠানে ‘কেয়া হউয়া এক বাত পর’ গানটি সম্বন্ধে তিনি একটি তথ্য জানিয়েছিলেন।

গানটি লেখা এবং সুর দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ছবির নির্মাতাদের পঞ্চম আমন্ত্রণ জানিয়েছেন গানটি একটিবার শোনার জন্য। তাঁরা হাজির। পঞ্চম পুরো গানটি শোনান তাঁদের। কিন্তু তাঁরা জেদ ধরে বসেন যে গানের শুরুর অংশটিকে একটু পরিবর্তন করতে হবে। পঞ্চমের তো মাথায় হাত। এই শেষ মুহূর্তে পরিবর্তন? বাধ্য হয়েই তাঁদের পঞ্চম জিজ্ঞেস করেন ঠিক কি চাইছেন তাঁরা। তাঁদের সাফ কথা। একটু ‘মদন মোহন ইফেক্ট’ চাই। মান্না দের গাওয়া ‘কৌন আয়া মেরে মন কে দ্বারে পায়েল কি ঝংকার লিয়ে’ ধরনের কিছু চাই। বেশিক্ষণ ভাবতে হয়নি পঞ্চমকে। প্রথম পংক্তিটির সুর কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে তৈরি করে ফেলেন ‘কেয়া হউয়া এক বাত পর’ গানটি। ফাইনাল রেকর্ডিং ও সম্পন্ন হয়। এটি সেই গান যে গানের কথায় ও সুরের মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রেমিকার প্রতি প্রেমিকের এক নিদারুণ অভিমান। যে অভিমান একমাত্র ভাঙাতে পারে তার প্রেমিকাই। পৃথিবীর যে কোনও কিছুই তার সেই অভিমান ভাঙাতে অক্ষম।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content