রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ত্রয়ী: আরডি, আশা ও গুলজার। ছবি: সংগৃহীত।

নিজের ভালোবাসার কোনওকিছুকে যদি আমরা পেশা হিসেবে গ্রহণ করি তাহলে হয়তো খুব সহজেই সাফল্য আসে। তখন সেটিকে আর দায়িত্ব অথবা পরিশ্রম বলে মনে হয় না। ভালোবাসার তাগিদেই জন্ম নেয় সতস্ফুর্ততার। তাই হয়তো তখন আর ঘড়ির দিকে চোখ যায় না। ক্ষুধা-তৃষ্ণাও যেন ম্লান হয়ে যায়। পঞ্চম এবং তাঁর কর্মকাণ্ডগুলি হয়তো এরই সাক্ষ্য বহন করে। এক একটি দিন এরকমও যেত, যে দিনগুলিতে তিনি তাঁর সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে সকাল থেকে সুরসৃষ্টির কাজে বসতেন, আর কখন যে দুপুর গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসতো তা টেরই পেতেন না। কোনও কোনও দিন গভীর রাত অবধিও চলতোসুর নিয়ে কাটাছেঁড়ার পর্ব। আবার যখন মনোনিবেশ করতে পারেননি কোনও কারণে, তৎক্ষণাৎ হারমোনিয়াম ছেড়ে উঠে পড়েছেন। সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছেন নিজের রন্ধনশালায়। সব রকমের প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করে রেঁধে ফেলেছেন বিরিয়ানি, মটন বা অন্যকোনও পদ।

পঞ্চম শুধু ভোজনরসিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পাকা রাধুনিও। বিরিয়ানির প্রতি তাঁর ছিল এক অকৃত্রিম ভালোবাসা। এক জায়গায় ফ্রাঙ্কো ভাজ একটি মজার কাহিনির অবতারণা করেছেন। একবার নাকি রেকর্ডিং সেশন চলার সময় মধ্যান্যভোজের আগেই পঞ্চম প্রবল ক্ষুধা অনুভব করেন। আর থাকতে না পেরে ফ্রাঙ্কোর বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খাবারটি তিনি খেয়ে ফেলেন। আর ফ্রাঙ্কোর জন্য বাইরের থেকে খাবার অনিয়ে দেন। ফ্রাঙ্কো-সহ বাকি সবাই এই ঘটনায় প্রবল হেসেছিলেন। সুরসৃষ্টির সময় অথবা রেকডিং চলাকালীন ছোট ছোট এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যা আমাদের অনেকেরই হয়তো অজানা।
আর একটি মজার ঘটনা ঘটিয়েছিলেন পঞ্চম। ‘আ আ ই ই মাস্টার্জি কি আগেই চিঠ্ঠি’ গানটির কথা আগেই বলেছি। ‘কিতাব’ ছবিতে এই গানটির দৃশ্যায়ন হয় একটি ক্লাসরুমের মধ্যে, যেখানে পড়ুয়ারা টেবিল বাজিয়ে এই গানটি করছে। তাই গানটির রেকর্ডিংয়ের সময় পঞ্চম কোনো এক বিদ্যালয় থেকেকয়েকটি বেঞ্চ জোগাড় করে নিয়ে আসেন। এবং অন্য বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি ওই বেঞ্চগুলিকেও বাজানো হয়, যাতে ক্লাসরুমের একটি আবহ তৈরি করা যায়।
‘খুশবু’ ছবির ‘ও মাঝিরে আপনা কিনারা’ গানটির রেকর্ডিংয়ের আগে ফাইনাল সিটিং চলছে। সুর তৈরি। যন্ত্রীরাও নিজের নিজের বাদ্যযন্ত্রে নিয়ে বসে আছেন, পঞ্চম ইশারা করলেই শুরু করবেন। গানটি সিরিয়াস তো বটেই এবং পুরো গানটি জুড়ে একটি প্যাথোস তো রয়েইছে। হঠাৎ পঞ্চম ঘর থেকে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে যান। সবাই তো অবাক! কোথায় গেলেন পঞ্চম? সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। এমন সময় পঞ্চমের প্রবেশ। দু’হাতে দুটি বিয়ারের বোতল। দুটোই অর্ধেক জলে দিয়ে ভর্তি। সবাই তো হতবাক! কী চাইছেন পঞ্চম? পঞ্চম বুঝতে পারেন যে, তাঁর এই কাণ্ডে সবাই যথেষ্টই বিভ্রান্ত। এবার মুচকি হেসে তিনি সবাইকে শুরু করতে বলেন। এবং তিনি একটি মাইকের সামনে বসে সমান ব্যবধানে বিয়ারের বোতল দুটিতে ফুঁ দিতে থাকেন। এবার সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় আরডি-র ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য। গানটিতে প্রথম থেকে শেষ অবধি যে ছন্দটি বেজে চলে, একটু খেয়াল করলেই শুনতে পাবেন একটি অদ্ভুত ‘গুপ্ গুপ্’ শব্দ, যা বাকি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেজে চলেছে। সেটির সৃষ্টি বিয়ারের বোতল থেকেই।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৮: সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত গান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন পঞ্চম

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১০: কান্না-হাসির দোল দোলানো ‘সাড়ে চুয়াত্তর’

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৩: এখানকার একমাত্র ভারতীয় রেস্তরাঁর মালিকও বাঙালি

হেলদি ডায়েট: হাঁসফাঁস গরমে মুখে রুচি নেই, কোন কোন টক জাতীয় খাবারে স্বাদ ফিরে পাবেন?

একই ভাবনা পঞ্চম কাজে লাগিয়েছিলেন ‘ওয়ারেন্টে’ ছবির ‘রুক জানা ও জানা হামসে দো বাতে’ গানটিতেও। নায়ক দেবানন্দ সাহেব একটি রোড-রোলার চালিয়ে গানটিতে লিপ দিচ্ছেন আর এখানেও যে ‘গুপ্ গুপ্’ শব্দটি শোনা যাচ্ছে সেটিও বিয়ারে বোতল থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।
‘জওয়ানি দিওয়ানি’ ছবির ‘সামনে ইয়ে কন আয়া দিল মে হুই হালচল’ গানটি সবাই শুনেছেন। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭২ সালে। পঞ্চম এই গানটির নেপথ্যে এমন একটি শব্দ ব্যাবহারকরতে চাইছিলেনযেটিতে একটু বাসের প্রভাব থাকবে। কিন্তু সেই যুগে বাস গিটার তিনি পাবেন কোথায়? পাশ্চাত্যে সেই সময় বাস গিটার ব্যাবহারহতো কিনা সেটি অনুসন্ধান সাপেক্ষ। কিন্তু ভারতে তখনও এই বাদ্যযন্ত্রটির সে ভাবে প্রচলন ছিল না। অগত্যা শুরু হল পঞ্চমের গবেষণা। তিনি এবার দেখা করলেন পারকাসানিস্ট বিজয় ইন্দোরকারের সঙ্গে। বিজয়জিকে বোঝালেন তিনি ঠিক কি চাইছেন। শোনার পর এবার বিজয়জি নেমে পড়লেন গবেষণায়। বেশ কিছুদিন পর যে যন্ত্রটির জন্ম হল সেটির একটি নামকরণও করা হল। পঞ্চম আর বিজয়জি মিলে সেটির নাম দিলেন ‘প্যাডেল মটকা’। একটি বড় আকারের মাটির কলসি। কলসির মুখটি একটি চওড়া এবং গোলাকার চামড়ার মোটা চাদরে ঢাকা। সেই চামড়ার চাদরের চার পাশ থেকে মোটা দড়ির গোছা নেমে গিয়েছে নিচে। সেই দড়ির গোছাগুলি দিয়ে এমন একটি ফাঁস তৈরি করা হয়েছে যেটির মধ্যে একটি পা ব্যাবহারকরে নিচের দিকে ঠেলা যায়। একই সময় যদি সেই চামড়ার উপর হাত দিয়ে বাজানোযায় (অনেকটা তবলার মতো) তাহলে শব্দের ‘পিচ’ কে বদলানো যায়। আর এই যন্ত্রটিকেই গানের শুরু থেকে শেষ অবধি ছন্দটিকে ধরে রাখার কাজে ব্যাবহারকরা হয়েছে। শুধু ‘বাস এফেক্ট’ নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে এত কর্মকাণ্ড।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: স্বাস্থ্যকর উপায়ে বাড়িতে বানিয়ে ফেলুন মুচমুচে আলুর চিপস

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২: এখানে দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, বাণিজ্যনীতি এবং বৈদেশিক নীতির চর্চা করা হয়েছে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮: রামচন্দ্রের কৈশোর, ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র: এক অনন্য উত্তরণ

আর একটি গানের কথা বলি। গানটি হল ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘শালিমার’ ছবির ‘হাম বেওয়াফা হারগিস না থে’। গানটির অভিনবত্ব লুকিয়ে আছে ‘ফোনেটিক্স’ এর ব্যাবহারে।‘জিঙ্গা লালা হুম’, ‘আবু আজু আবা চাহু কুসু বাজা’, ‘আবু কুসু উয়া সুগু আনি আজা’ প্রভৃতি শব্দগুলি কিশোর-কণ্ঠের নেপথ্যে কোরাসে উচ্চারিত হয়েছে। শব্দগুলির অর্থ কোনও শব্দকোষে পাওয়া যাবে কিনাজানা নেই। কিন্তু এই আপাত অর্থহীন শব্দগুলিই এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে গানটিকে। সঙ্গে এক এবং অদ্বিতীয় কিশোর কুমারের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কণ্ঠ। অনবদ্য।

১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ইয়াদো কি বারাত’ ছবির ‘চুরালিয়া হ্যায় তুমনে তো দিল কো’ গানটি সবাই শুনেছেন। কিন্তু জানেন কি, এই গানটির প্রেলুডের প্রথম অংশটি আসলে বাজানো হয়েছে একটি চামচ এবং কাঁচের গেলাস দিয়ে? তারপর ১২ স্ট্রিং গিটার বেজে ওঠার পর কঙ্গ, মাদল এবং রেসো-রেসো ছন্দটিকে এগিয়ে নিয়ে চলে ঠিকই। কিন্তু একদম প্রথমে কাঁচের গেলাসের সাহায্যে জন্ম নেওয়া শব্দটি শ্রোতাদের যেন একটি ‘মুড’ তৈরি করে দেয়বাকি গানটুকু শোনার জন্য। একটি গানকে কী কী উপায়ে ‘ক্লাইম্যাক্স’ এ নিয়ে যেতে হয় সেটি পঞ্চম বহুবার সাফল্যের সঙ্গে করে দেখিয়েছেন।

১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ইজাজাত’ ছবির ‘মেরা কুছ সামান তুমহারে পাস পরা হ্যায়’ গানটি লেখার কাজ শেষ করে গুলজার সাহেব একদিন আসেন পঞ্চমের বাড়িতে। পঞ্চমকে লেখাটি পড়ান। পড়া শেষ হলে গুলজার সাহেব এবার পঞ্চমকে বলেন লেখাটিতে সুরারোপ করতে। পঞ্চমের যেন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। প্রবল চটে যান গুলজার সাহেবের উপর। চটে গিয়ে তিনি গুলজারকে বলেন, সবকিছু যে দিকে এগোচ্ছে তাতে গুলজার হয়তো একদিন সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত কোনও একটি খবর নিয়ে এসে তাতে তাঁকে সুরারোপ করতে বলবেন। সেই সঙ্গে গুলজারকে বলেন, ওই লেখাটি কবিতা হিসেবে অসাধারণ। কিন্তু ওই লেখাকে সুরে ফেলা? সেটি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সব কিছুর একটি সীমা থাকে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৩: বায়োফ্লক পদ্ধতিতে সফলভাবে মাছচাষ করছে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও তামিলনাড়ু

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১২: সকালবেলার আগন্তুক

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৭: গরমে পান্তা ভাত কি সত্যিই শরীর ঠান্ডা করে?

কিন্তু গুলজার কোনও প্রতিক্রিয়া না দিয়ে ঠান্ডা মাথায় পঞ্চমকে ছবির দৃশ্যটি বর্ণনা করেন। কী পরিস্থিতিতে ছবির নায়িকা এই গানটি গাইবেন, সেটিও বলেন তাঁকে। এও বলেন, তিনি পঞ্চমের দক্ষতার কথা মাথায় রেখেই ওই লেখাটি লিখেছেন। তিনি এও খুব ভালো করে জানেন, পঞ্চম তাঁকে নিরাশ করবেন না। নিমরাজি হওয়া সত্যেও শুধু তাঁর বন্ধুত্বের কথা মাথায় রেখে পঞ্চম গুলজারকে লেখাটি রেখে যেতে বলেন। সেই সঙ্গে এও জানান, তিনি চেষ্টা করবেন ঠিকই, কিন্তু কথা দিতে পারছেন না। গুলজার সাহেব লেখাটি পঞ্চমের কাছে রেখে ফিরে আসেন।

এবার দিন-রাত এক করে শুরু হয় পঞ্চমের গবেষণা। সুরের কাঠামো তৈরি করে ফেলেন খুব অল্প সময়েই। তারপর তাঁর নবরত্নদের নিয়ে বসে সেটিকে গুলজারকে শোনানোর জন্য প্রস্তুত করে ফেলেন। তারপর একদিন ডাকেন গুলজারকে। পুরো গানটি শোনার পর গুলজার সাহেবের যেন উচ্ছাসের বাঁধ ভেঙে যায়। একজন নায়িকার আবেগকে একটি গানে সুরের মাধ্যমে কি অসাধারণ ভাবেই না ফুটিয়ে তোলা হয়েছে! আর তাও এমন একটি লেখা যেটিকে সুরে ফেলা অসম্ভব বললেও হয়তো কম বলা হয়। তবু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন পঞ্চম।

গানটি আবারও একবার শুনে দেখবেন, আশার কণ্ঠকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে গানটিতে খুব বেশি বাদ্যযন্ত্র কিন্তু ব্যাবহারকরেননি পঞ্চম। তাল ধরে রেখে গিয়েছে একটি তবলা। পুরো গানটি জুড়ে নেপথ্যে বেজে গিয়েছে বাস গিটার। আশার অসামান্য গায়কীর সঙ্গে ফিলারে প্রাধান্য পাওয়া সন্তুর, সরোদ, এসরাজ এবং সিন্থেসিজরে বাজানো কিছু অংশ নায়িকার আবেগকে যেন আরও প্রস্ফুটিত করে তুলেছে। আর গানটির শেষ পংক্তিটি আশাকে দিয়ে খালি গলায় গাওয়ানো হয়েছে, যা গানটিকে আক্ষরিক অর্থেই ক্লাইম্যাক্সে নিয়ে গিয়েছে। এই হল পঞ্চম ম্যাজিক।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content