বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


হেমন্তকুমার মুখোপাধ্যায়, এসডি বর্মণ, সলিল চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মণ।

একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও রমেশ আইয়ার পঞ্চমের প্রতি আকৃষ্ট হন তাঁর সুরের জাদুতে। তিনি নিজেও ছিলেন একজন অসামান্য গিটারিস্ট। ভাগ্য তাঁকে একদিন মিলিয়ে দেয় পঞ্চম এর সঙ্গে। আরডি-র বহু গানে শ্রুতিমধুর লিড-গিটার বাজিয়েছেন রমেশ।

সুনীল কৌশিক ছিলেন আরও একজন স্বনামধন্য লিড-গিটারিস্ট এবং পঞ্চম-সভার অন্যতম সদস্য। শোনা যায়, প্রথমবার যখন পঞ্চমের সঙ্গে পরিচয় হয়, সুনীলের কেন যেন মনে হয়েছিল যে, তিনি এতদিনে একটি সঠিক মানুষের কাছে এসেছেন। আমরা হয়তো একেই ‘ওয়েভ লেন্থ ম্যাচিং’ বলে থাকি। সেটি ছিল সত্তরের দশক। ‘শালিমার’ ছবিতে লিড বাজানোর মধ্যেদিয়ে তাঁর পঞ্চমের সঙ্গে পথচলা শুরু। ‘সাগর’ ছবির ‘চেহারা হো ইয়া চাঁদ খিলা হ্যায়’ গানটির প্রিলুডে যে দুটি লিড গিটারের যুগলবন্দী আমরা শুনতে পাই, সেটি রমেশ-সুনীল জুটিরই সৃষ্টি।
টনি ভাজ ছিলেন পঞ্চমের প্রধান বাস গিটারিস্ট। টনির সঙ্গে পঞ্চমের প্রথম দেখা হয় কোনও একটি হোটেলে। সেই হোটেলে টনি বাস গিটার বাজাতেন। সেই থেকেই টনির পঞ্চমের দলে যোগদান করা। টনির অসামান্য দক্ষতা পঞ্চমকে মুগ্ধ করেছিল। সেই-কারণে তিনি তাঁকে নিজের কাছে টেনে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি।

একটি উদাহরণ দিলেই আপনারা অনুধাবন করতে পারবেন টনিজির দক্ষতার কথা। ‘তু তু হ্যায় ওহি’ গানটি আপনারা সবাই শুনেছেন। গানটিতে পঞ্চম বাস গিটারকে কিছুটা বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন, আর সেটি অন্য কেউ নন, বাজিয়ে বাজিমাত করেছেন টনি ভাজ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পঞ্চমই প্রথম বাস গিটারের প্রচলন ঘটান বলিউড মিউজিকে। রমেশ আইয়ারও বাস গিটারে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই চরণজিত সিংয়ের কথাও উল্লেখ করতেই হয়। বাস সেকশনে পঞ্চমের আরও এক নক্ষত্র ছিলেনচরনজিত। বাস ব্যাপারটিকে অসম্ভব গুরুত্ব দিতেন পঞ্চম, আর তাই সঙ্গে নিয়েছিলেন উপরোক্ত তিনজন ভারত বিখ্যাত বাসিস্টকে। তবে চরনজিত ট্রানসিকর্ডেও একই রকম ভাবে পারদর্শী ছিলেন।

ব্লাস্কো মনসোরেট এবং রাজ শোধা ছিলেন ত্রম্বন বাদক। পঞ্চমের চোখ যে জহুরির সেটি বোঝা যেত তাঁর দলের যন্ত্রীদের দক্ষতা দেখে। ব্লাস্কো এবং রাজ সেই সত্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আরও পড়ুন:

পর্ব-৭: পঞ্চমের কথা মতো ড্রাম ছেড়ে অমরুতের পিঠের উপর স্যাম্পল রিদম বাজাতে শুরু করলেন ফ্রাঙ্কো!

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭: ভারতের উত্তরাধিকার, কৌরব ও পাণ্ডবগণ

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫২: প্রাকৃতিক উপায়ে মাছের ফলন বাড়াতে পুকুরে উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণার ভারসাম্য ঠিক রাখা জরুরি

টেনোর সেক্সোফোনের দায়িত্বে ছিলেন শ্যামরাজ। শান্ত স্বভাবের ছোটখাট চেহারার এই মানুষটি পঞ্চমের বহু গানকে মাধুর্যে ভরিয়ে তুলেছেন তার এই বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে।
মারুতির কথা আগেই বলেছি। এই লেখায় আরও একজনের নাম উল্লেখ করতেই হয়। তিনি হলেন দেবিচান্দ। তাঁর তবলা যেন কথা বলতো। আর মারুতির সঙ্গে যখন বাজাতেন সেই যুগলবন্দী যেন কালবৈশাখীর ঝড়ের রূপ নিত। কেউই যেন কারও কাছে হারবেন না। আর পঞ্চম এই ঘটনাটি খুব উপভোগ করতেন। তিনি দু’ জনকেই নিজস্ব ভঙ্গিতে উৎসাহ প্রদান করতেন। আর তাই দু’জনেই নিজেদের উজাড় করে দিতেন।

কঙ্গ এবং থুম্বাতে ছিলেন নীতিন শংকর। সদাহাস্যময় এবং পঞ্চমের অতিপ্রিয় এই মানুষটি পঞ্চমের সঙ্গে কাজ শুরু করেন আশির দশকের শেষদিকে। ছাত্রজীবন থেকেই আরডি-র তাল এবং লয় নিতিনকে খুব আকৃষ্ট করতো। তাই জেদ ধরে বসেন যে দেখা করবেনই পঞ্চমের সঙ্গে। মন থেকে সৎভাবে কিছু চাইলে ভগবান হয়তো মনের সেই আশা পূর্ণ করেন। তাই নিতিনের সুপ্ত ইচ্ছেও একদিন পূর্ণ হয়। হঠাৎ একদিন সুযোগ আসে পঞ্চমের সঙ্গে কাজ করার। ততদিনে তিনি অক্টোপ্যাড, কঙ্গো এবং থুম্বাতেও হাত পাকিয়ে ফেলেছেন। পঞ্চম ডেমো সেশনে বসেন নিতিনের সঙ্গে। এবং নিতিনের দক্ষ হাতের বিভিন্ন ছন্দ শোনার পর পঞ্চম আর দ্বিতীয়বার ভাবেননি। তৎক্ষণাৎ নিতিনকে অন্তর্ভুক্ত করেন তাঁর দলে। আর নিতিনের এতো দিনের স্বপ্ন সত্যি হয়।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৬: লিঙ্গ পরিচিতিতে খাদ্যাভ্যাসের রাজনীতি

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৬: রতনপুর মহামায়া দর্শন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩২: কি ‘উপহার’ সাজিয়ে দেব

পঞ্চমের আরও একজন রত্নকে আমরা বুজি লর্ড নামে চিনি। ড্রাম সেকশনে ফ্রাঙ্কো ভাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্টুডিয়ো মাতিয়ে রাখা এই মানুষটি দেশের সেরা ড্রামারদের মধ্যে একজন। ‘তিসরি মনজিল’ থেকে তাঁর পঞ্চমের সঙ্গে যাত্রা শুরু। ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ ছবির ঊষা উথুপ (তখন ঊষা আইয়ার) এবং আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘আই লাভ উ’-এর মতো একটি ক্যাবারে গানে যে ড্রামটি বাজতে শোনা যায়, সেটি বুজি লর্ডেরই বাজানো। অবশ্য লেসলি গডিনহওঅনেক ক্ষেত্রে পঞ্চমের ড্রামার হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বুজি লর্ড-এর পারদর্শিতা শুধু ড্রামেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি একই দক্ষতায় বঙ্গ, ভাইব্রাফোন, জাইলোফোন বাজাতে পারতেন।

একবার ভেবেদেখুন, যেসঙ্গীত পরিচালক নিজে একজন অসামান্য এবং অদম্য প্রতিভার অধিকারী। আর তাঁর সঙ্গে যদি এই উচ্চতার দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বরা মিলিত হন, তার ফল কি হতে পারে। এ যেন সম্রাট আকবরের নবরত্ন সম্ভার। প্রত্যেকেই তাঁর নিজ নিজ ক্ষেত্রে এক একটি প্রতিষ্ঠান। এবং সবাই যেন সপ্তসুর নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় মেতে থাকতেন। যে গবেষণা চলতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিরামহীন, ক্লান্তিহীন। ফলত গবেষণার শেষে যে সুরের সৃষ্টি হতো সেটি স্বাভাবিক নিয়মেই শ্রেষ্ঠত্বের নজির বহন করতো। যে সুরগুলির ঠাঁই একমাত্র হতে পারে শ্রোতাদের হৃদয়ে। যে সুরগুলি কেবল মাত্র কোনও মুষ্টিমেয় শ্রোতাবৃন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: আমি বনফুল গো— তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১

ত্বকের পরিচর্যায়: ত্বক শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে? যত্নে কী কী করবেন? জেনে নিন ত্বক বিশেষজ্ঞের জরুরি পরামর্শ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৬: গরমে কক্ষনও ডিম খেতে নেই?

সাতটি সুর, অর্থাৎ সা (সদযা), রে (ঋষভ), গা (গান্ধার), মা (মধ্যমা), পা (পঞ্চম), ধা (ধৈভত), নি (নিষাদ)। আর এই সাতটি সুরের মাধ্যমে একের পর এক মালা গেঁথে গিয়েছেন পঞ্চম। তাঁর জ্ঞান-গরিমা শুধু ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতিও তাঁর পরম অনুরাগ ছিল ছোটবেলা থেকে। বাক, মোৎজার্ট, বেথোভেন, মন্টেভার্ডি, অ্যান্টোনিও ভিভালদির মতো পৃথিবী বিখ্যাত কম্পোজারদের তৈরি করা সুর সময় পেলেই শুনতেন এবং সেগুলির মাধ্যমে নিজেকে অনুপ্রাণিত করতেন। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকান ছন্দগুলির প্রতি তাঁর ছিল এক অপরিসীম ভালোবাসা। তা ছাড়াও অচেনা কোনও গান বা সুর, সেটি প্রাচ্যেরই হোক অথবা পাশ্চাত্যের, শোনার ক্ষেত্রে কোনও বাছবিচার করেননি কখনও। তিনি সুরে বিশ্বাস করতেন। তাই ভিনদেশী কোনও গান শুধুমাত্র ভাষার কারণে দূরে সরিয়ে রাখেননি। গানের সে সুরটি যদি হৃদয় ছুঁয়ে যেতো, সেটি বারবার শুনতেন। সতীর্থদেরও শোনাতেন। ব্যাকরনটিবোঝার চেষ্টা করতেন। সেগুলি থেকে নতুন কিছু শেখার প্রতি ছিল তাঁর চরম আগ্রহ। হয়তো সেই কারণেই তিনি পরম অনুরাগী ছিলেন আরও এক স্বনামধন্য এবং কালজয়ী সুরকার এবং সঙ্গীতকার প্রয়াত সলিল চৌধুরীর।

সলিলবাবুর সুরারোপ করা গানগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তাঁর গানগুলিতে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের কোনও ছোঁয়া পেলে তার বিন্যাসটি বোঝার চেষ্টা করতেন। সলিলের ব্যবহার করা কর্ডগুলি বারবার শুনতেন। কোথায় কোন কর্ডকে কাজে লাগালেএকটি গানকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলা যায় সেগুলির দিকে বিশেষভাবে নজর দিতেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কর্ড হল পাশ্চাত্য সঙ্গীতের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যেকোনও স্বরোগ্রমের (স্কেলের) নির্দিষ্ট কিছু স্বরকে (নোট কে) একসঙ্গে বাজালে সেটিকে কর্ড বলা হয়ে থাকে।

পিয়ানো, অ্যাকর্ডিয়ান, গিটার, সিন্থেসাইজার, হারমোনিয়াম প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে কর্ড বাজানো সম্ভব। অর্থাৎ যে যে বাদ্যযন্ত্রে আমরা একসঙ্গে একের বেশি স্বর (নোট) বাজাতে পারি, সেই সেই বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে কর্ড বাজানো সম্ভব। একটি গানের নেপথ্যে বিভিন্ন কর্ডের ব্যবহার গানটিকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়। এই কর্ড ব্যাবহারেরক্ষেত্রে সলিল চৌধুরীকে মনে মনে গুরু মানতেন পঞ্চম।
আরও পড়ুন:

বাস্তুবিজ্ঞান: পর্ব-১৮: বাস্তু মতে আপনার বাড়ির প্রধান প্রবেশদ্বার কোন দিকে হওয়া উচিত?

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১২: দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ঢুকে পড়লাম নিকটবর্তী একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১: নাথানিয়্যাল গোবিন্দ সোরেনের গল্প

ব্যাকরনগতকচকচানি যদি বুঝতে অসুবিধেও হয়, একটি ছোট উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন কর্ডের ব্যাবহার ঠিক কি।‘আজ নয় গুন গুন গুঞ্জন প্রেমের’ গানটিতে সলিলবাবু একটি অভিনব কায়দায় কর্ড ব্যাবহারকরেছেন। ‘আজ নয় নিস্ফল ক্রন্দন’ অংশটি যখন লতা মঙ্গেশকর গাইছেন, তখন একটু খেয়াল করে দেখবেন, সুর কিন্তু একই থাকছে, তিনবার একই সুরে গাইছেন। কিন্তু সেই একই সুরের নেপথ্যে তিনটি আলাদা আলাদা কর্ড ব্যাবহারকরা হয়েছে। একই ভাবে কিশোরকুমারের গাওয়া ‘কাহেনা হ্যায় কাহেনা হ্যায়’ গানটি খেয়াল করুন। ‘তুমহি তো লাই হো জীবন মে’ অংশটিতে একই সুর তিনবার গাওয়া হয়েছে। কিন্তু নেপথ্যে তিনটি আলাদা আলাদা কর্ড ব্যাবহারকরেছেন পঞ্চম।

দুটি গানের ক্ষেত্রেই কর্ডের এই অভিনব ব্যাবহারগান দুটিকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। দুটি গানই আরও একবার শোনার অনুরোধ রইলো। শুনলেই বুঝবেন কি বলতে চাইছি। তাই সলিল চৌধুরী মহাশয়কে পঞ্চম এতো সম্মানের চোখে দেখতেন। গুলজার সাহেবের লেখা এবং লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘সিলি হাওয়া ছুঁ গেই সিলা বদন ছিল গেয়া’ গানটি আপনারা সবাই শুনেছেন। কিন্তু জানেন কি, এই গানটিতে লুকিয়ে রয়েছে পঞ্চমের আরও এক অভিনবত্ব? গানটির সুরের জন্ম হয়েছে একটি কর্ডের নোটগুলি থেকে। ‘সাসপেন্ডেড ফোর্থ’ বলে একটি কর্ড হয়। সেই কর্ডে যে যে স্বর (নোট) ব্যবহার হয়, সেই সেই স্বর কে কাজে লাগিয়ে এই গানটির সুরসৃষ্টি করেছেন পঞ্চম। রিদম গিটার, বাস গিটার, সেক্সোফোন, সন্তুর আর পারকেশনের দ্বারা সুসজ্জিত এই গানটি পঞ্চমের একটি অন্যতম সৃষ্টি। তাই তো গানটির মধ্যে কোথাও যেন আমরা একটি অপার্থিব সৌন্দর্য খুঁজে পাই। শুধু তাই নয়। গানটির প্রিলুড এবং ইন্টারলুডগুলিও গানের কথার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এক অদ্ভুত আবেগে ভাসিয়ে রাখে শ্রোতাদের।—চলবে
—চলবে
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content