বুধবার ১৩ নভেম্বর, ২০২৪


মগ্ন পঞ্চম। ছবি: সংগৃহীত।

যে কোনও গানের প্রাথমিক সুর রচনা করার পর সেটিকে কীভাবে অলঙ্করণ করা হবে, প্রিলুড (গান শুরু হওয়ার আগের অংশ) এবং ইন্টারলুড (অনুচ্ছেদগুলির মাঝের অংশ) কেমন হবে, কোথায় কোন বাদ্যযন্ত্রকে কতটুকু সময়ের জন্য ব্যবহার করা হবে, গানের কোন জায়গায় কোন বাদ্যযন্ত্র প্রাধান্য পাবে, এই বিষয়গুলির চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়। যে কারণে সব সংগীত পরিচালকই একজন অথবা একাধিক অ্যারেঞ্জর নিযুক্ত করে থাকেন। তাই পঞ্চমের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলতে গেলে আরও তিনজনের নাম স্বাভাবিকভাবেই চলে আসতে বাধ্য। তাঁরা হলেন বাসুদেব চক্রবর্তী, মনোহারী সিং এবং মারুতি রাও কির যাঁরা সে যুগে বাসু-মনোহারী-মারুতি নামে অতিপরিচিত ছিলেন সংগীত মহলে। এঁরা ছিলেন আরডি-র মিউজিক অ্যারেঞ্জর এবং তাঁর অগুনতি অবিস্মরণীয় সৃষ্টির সাক্ষী।

বাসুদেব চক্রবর্তী পঞ্চমের অ্যারেঞ্জর হিসেবে প্রথম কাজ করেন ভূত বাংলা ছবিতে, ১৯৬৫ সালে। যদিও তিনি এর আগে শচীন কর্তার সঙ্গে বহু ছবিতে কাজ করেছিলেন। এবং সেই থেকেই তাঁর পঞ্চমের সঙ্গে পরিচয়। তিনি যেন ছিলেন পঞ্চমের দক্ষিণ হস্ত। অসাধারণ সুন্দর চেলো বাজাতে পারতেন। শুধু চেলো কেন, প্রায় সব রকমের স্ট্রিং ইনস্ট্রুমেন্ট বাজানোর ক্ষেত্রে তাঁর ছিল সমান দক্ষতা। পঞ্চম কিচাইছেন সেটি খুব তাড়াতাড়ি বুঝে যেতেন। আর ছিলেন অসম্ভব শৃঙ্খলাপরায়ণ। তাই সতীর্থদের কাছ থেকে প্রচুর শ্রদ্ধা এবং সম্মান পেয়েছিলেন।
তবে আশির দশকের প্রথম দিকে কোনও একটি অজানা কারণে বাসুদেব চক্রবর্তী পঞ্চমের সংগীতসভার সদস্যপদ ত্যাগ করেন। তারপর বাবলু চক্রবর্তি, যিনি বাসুদেব চক্রবর্তীরই আত্মীয়, পঞ্চমের অ্যারেঞ্জর হিসেবে কাজ শুরু করেন। বেশ কিছু ছবিতে তিনি তাঁর কর্মদক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন।

মনোহারী সিংয়ের কর্মজীবন শুরু শচীন কর্তার হাত ধরে, একজন সাক্সোফোনিস্ট হিসেবে। সাল ১৯৫৮। ছবির নাম ‘সিতারও কে আগে’। কিন্তু পরবর্তীকালে পঞ্চমের অ্যারেঞ্জর হিসেবে পাকাপাকিভাবে কাজ শুরু করেন মনোহারিজি। এমনকি তাঁকে পঞ্চমের সুযোগ্য সহকারী বললেও হয়তো ভুল বলা হবে না। সব ধরনের সাক্সোফোন, ট্রাম্পেট, ফ্লুট, ক্লারিনেট, বাঁশি, ম্যানডোলিন—সবেতেই ছিল তাঁর সমান দক্ষতা।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫০: ‘ফিশ পাস’ পুরোদমে চালু হলে ইলিশের প্রজনন বাধাহীনভাবে সম্ভবপর হবে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩০: দিনের পরে দিন গড়ে যায় ‘বিধিলিপি’

মারুতি রাও কির একজন প্রখ্যাত তবলাবাদক হওয়ার পাশাপাশি শচীন দেব বর্মণের সংগীত সভার একজন স্থায়ী সদস্যও ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ শচীন কর্তার ‘পিয়া তো সে নয়না লাগে রে’ গানটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই গানটিতে যে তবলা আপনারা শুনতে পান সেটি মারুতিই বাজিয়েছিলেন। তাঁর দক্ষতা উজাড় করে দিয়েছিলেন এই গানটিতে। কি অসাধারণ সৃষ্টি! তিনি পঞ্চমের সমবয়সী ছিলেন। তাই বন্ধুত্বের সম্পর্কও তৈরি হয়েছিল দুজনের মধ্যে।যে কারণে পঞ্চমের হয়ে কাজ করতেও তাঁর কোনও অসুবিধে হয়নি। কোন গানে কোন ছন্দ ব্যবহার করা হবে, তাল কেমন হবে, মাত্রা কী হবে— এই সব কিছু নিয়েই নিরন্তর চলত দু’ জনের গবেষণা। আর তাতে রূপ দিতেন বাসু-মনোহারী জুটি।

জানা যায়, পঞ্চম অসম্ভব খোলা মনের মানুষ ছিলেন। রাগ, দম্ভ, ঈর্ষা, অহংকার অথবা মানসিক জটিলতা এগুলি তাঁর অভিধানে ছিল না। সে-কারণে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সতীর্থদেরও কোনরকম অসুবিধের মধ্যে পড়তে হয়নি। বাসু-মনোহারী-মারুতি যখনই সুর রচনা নিয়ে কোনও পরামর্শ দিয়েছেন, পঞ্চম তা খোলা মনে সানন্দে গ্রহণ করেছেন। এবং সেই মতো সুরের বা তালের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাঁদেরই আবার নতুন করে শুনিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাব নিকাশ/২

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৪: কাওয়ার্ধা পরিভ্রমণ

সহজ কথায় বললে, তিনি তাঁর সমালোচকদের আত্মোন্নতির শ্রেষ্ঠ পথবলে মনে করতেন। আর সেই জন্যই সুর সংক্রান্ত যে কোনও পরামর্শ ইতিবাচক ভঙ্গিতে গ্রহণ করতেন। প্রতিভা সাফল্য আনে ঠিকই, কিন্তু চিরস্মরণীয় হতে গেলে আর যা যা প্রয়োজন সে সবই পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ রাখা ছিল পঞ্চমের মধ্যে। যে কোনও ক্ষেত্রেই সাফল্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। আর তাই,পঞ্চমের সাফল্যের নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কথা খুব স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে।

প্রয়াত ভানু গুপ্তর কথা আগেই বলেছি। তিনি প্রধানত ছিলেন পঞ্চমের অ্যাকাউস্টিক রিদম গিটারিস্ট এবং মাউথ-অর্গানিস্ট। প্রঙ্গত উল্লেখ্য, আমরা এই বাদ্যযন্ত্রটিকে ‘মাউথ-অর্গান’ বলি বটে, কিন্তু এর সঠিক নাম হল ‘হারমোনিকা’। এমন বহু গান রয়েছে যেগুলিতে ভানু গুপ্তর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন পঞ্চম। ‘তিসরি মঞ্জিল’ থেকে দু’জনের একসঙ্গে পথ চলা শুরু। পঞ্চম নিজেও যথেষ্ট সুন্দর হারমোনিকা বাজাতেন। কিন্তু ভানু গুপ্ত তাঁর সংগীতসভার একজন নিয়মিত সদস্য হওয়ার পর পঞ্চম এই কাজটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁকেই সমর্পণ করতেন।

বাসুদেব চক্রবর্তী, মনোহারী সিং এবং মারুতি রাও কির। ছবি: সংগৃহীত।

রণজিৎ গাজমের ওরফে ‘কানছা’ ছিলেন পঞ্চমের এক এবং অদ্বিতীয় মাদল বাদক। জন্ম দার্জিলিঙে হলেও পরবর্তীকালে মনোহারী সিংয়ের সূত্রে তাঁর বম্বে পাড়ি দেওয়া। যদিও ড্রাম বাজানোর ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। কিন্তু মাদলকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ভালোবেসে। পঞ্চমের অধিকাংশ সুরকে আলোকিত করেছে কানছার মাদল। বলা হয়ে থাকে খাবারে যেমন লবণের উপস্থিতি তাকে সুস্বাদু করে তোলে, ঠিক একইভাবে মাদলের উপস্থিতি পঞ্চমের অধিকাংশ ছন্দকে আরও যেন শ্রুতিমধুর করে তোলে।

হমি মুল্লান ছিলেন পঞ্চমের পারকাশনিস্ট এবং তাঁর খুব প্রিয় একজন মানুষ। শান্ত স্বভাবের এই মানুষটির প্রতিভা পঞ্চমকে অসম্ভব আকৃষ্ট করেছিল প্রথম থেকেই। ১৯৪০ সালে কলকাতায় তাঁর জন্ম। মজা করে পঞ্চম হমিজিকে ‘পার্সি’ বলে সম্বোধন করতেন। বঙ্গো, ঢোলক, ডুগি, পিয়ানো, ভাইব্রাফোন, অ্যাকর্ডিয়ান, অর্গান তিনি একই দক্ষতায় বাজাতে পারতেন। এ সবের সঙ্গে, পঞ্চমের তত্বাবধানে, কিছু ফেলে দেওয়া বস্তু দিয়ে অথবা সুর-সঙ্গীতের সঙ্গে কোনও দিক দিয়েই কোনও সম্পর্ক নেই এমন কিছু ব্যাবহারকরে তিনি বেশ কিছু অসাধারণ শব্দ সৃষ্টি করেছিলেন, যা আজও শ্রোতাদের অবাক করে।
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: দ্রুত রোগা হতে চান? ভরসা রাখুন সুপারফুড ডালিয়াতে

ষাট পেরিয়ে: অ্যালঝাইমার্সের যত্ন বেশ চ্যালেঞ্জের, সঠিক পরিচর্যায় ধৈর্যশীল, সহনশীল, সংবেদনশীল এবং কৌশলী হতে হবে

মনের আয়না: অনিদ্রায় ভুগছেন? কীভাবে মিলতে পারে মুক্তি? জরুরি পরামর্শ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের

সনামধন্য ড্রামার ফ্রাঙ্কো ভাজ পঞ্চমের সঙ্গে যাত্রা শুরু করেন ১৯৭৮ সালে, ‘কাসমে ওয়াদে’ ছবির মধ্যে দিয়ে। বম্বেবাসী এক সংগীত-প্রধান পরিবার থেকে উঠে আসা ফ্রাঙ্কো সহজেই পঞ্চমের মন জয় করেন তাঁর পারদর্শিতার মাধ্যমে। পঞ্চম সভায় তিনি নিজের জায়গাটি পাকাপাকি ভাবে তৈরি করে নেন। তিনি আজও পঞ্চমের একজন একনিষ্ঠ গুণমুগ্ধ।

অমরুত রাও কতকারের কথা এখানে বলতেই হয়। রেসো-রেসো নামক আফ্রিকান বাদ্যযন্ত্রটির কথা আগেই বলেছি। আর এই রেসো-রেসোর দায়িত্ব পঞ্চম সঁপেছিলেন অমরুতকে। তিনি আদতে একজন তবলা বাদক হওয়া সত্যেও পঞ্চম তাঁর ছন্দের প্রগাঢ় জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছিলেন এই বিদেশি যন্ত্রটি বাজানোর ক্ষেত্রে। জহুরির চোখ বোধহয় একই বলে। কি অসাধারণ বাজাতেন অমরুত। তিনি নিজেও হয়তো অবাক হয়ে ভাবতেন যে হায়! তবলা ফেলে শেষমেশ রেসো-রেসো!—চলবে
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content