শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


আরডি, আশা ও কিশোর। ছবি: সংগৃহীত।

সাল ১৯৭৭। ‘চলা মুরারি হিরো বাননে’ ছবিতে ডাক আসে পঞ্চমের। যোগেশের লেখা ‘না জানে দিন কায়সে জীবন মে আয়ে হ্যায়’ গানটিতে সুর করেন আরডি। গায়ক হিসেবে বেছে নেওয়া হয় সেই কিশোর কুমারকেই। সে এক অসাধারণ সৃষ্টি। সুরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘প্যাথস’কে কিশোর যথাযত ভাবে মেলে ধরেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে গানটির প্রেলুড এবং ইন্টারলুড যথেষ্টই সংক্ষিপ্ত। এ ক্ষেত্রে পঞ্চম গানের ভাব প্রকাশ করার পুরো দায়িত্বই গায়কের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর গায়ক যখন কিশোর, যা হওয়ার ঠিক তাই-ই হয়েছে। যদি না শুনে থাকেন, তাহলে একবার শুনে দেখতে পারেন। নিশ্চিত ভাবে আরও একবার অনুধাবন করবেন পঞ্চম-কিশোর জুটির স্বার্থকতা।

‘করম’ ছবির ‘পল পল সময় তু ধীরে ধীরে চল’ গানটির সার্বিক উপস্থাপনা গানটিকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়। রাজেশ খান্না ও বিদ্যা সিনহার লিপে কিশোর এবং আশার কণ্ঠ মিলেমিশে যা সৃষ্টি হয়েছিল তা অভাবনীয়। এই গান একবার শুনলে বার বার শুনতে ইচ্ছে করবে। বিশেষ করে গানটিতে ভায়োলিনের মূর্ছনা যেন মাদকতায় ভরা, যা শ্রোতাদের বারবার আকর্ষণ করে।

আসে আর এক ব্লক বাস্টার ছবি ‘হাম কিসি সে কম নেহি’। ছবির প্রযোজক এবং পরিচালক নাসির হুসেন। যেহেতু নাসির ভাই, তাই পঞ্চম যেন একটু বেশিই সতর্ক ছিলেন। সুরের মান এবং বৈচিত্রের ক্ষেত্রে একটু বেশি যত্নশীল। নতুনত্বের ছোঁয়া থাকতেই হবে। আর যদি এই যজ্ঞে সামিল হন কিশোর, তাহলে তো কথাই নেই। তাই জন্ম দেন ‘বাচনা এ হাসিনো লো ম্যায় আ গেয়া’র মতো একটি গান। মজরু সুলতানপুরীর কথায় একটি ‘পার্টি সং’ তৈরি ফেলেন পঞ্চম। এই সুর রচিত হয় নায়ক ঋষি কাপুর এবং গায়ক কিশোরের কথা মাথায় রেখে। গানটির প্রেলুড সমেত বেশ কিছু অংশে স্যাক্সোফোন প্রাধান্য পেয়েছে। যার মূল উদ্দেশ্য শ্রোতাদের মনে একটি দুষ্টুমিষ্টি মুড তৈরি করে দেওয়া। যাতে গানটি চলাকালীন কোনও মতেই শ্রোতারা গানটিকে উপেক্ষা না করতে পারেন। এ যেনও এক ইন্দ্রজাল, যা সমগ্র শ্রোতাকুলকে সম্মোহিত করে রাখে।
এ প্রসঙ্গে এই ছবির ‘আয় দিল ক্যায়া মেহেফিল মে তেরে’ গানটিও উল্লেখযোগ্য। গানটির মূলত চারটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে কিশোর একা গেয়েছেন। পরের অংশে গেয়েছেন পঞ্চম স্বয়ং। সেই অংশটি হল ‘তুম কেয়া জানো মহব্বত কেয়া হ্যায়’। তৃতীয় অংশে রয়েছে ‘মিল গেয়া হাম কো সাথী মিল গেয়া’ গানটি। গেয়েছেন কিশোর-আশা। ১৯৭৭ সালের মতো একটি সময়ে দাঁড়িয়ে ওই ধরনের সুর করার দুঃসাহস বোধহয় পঞ্চমের পক্ষেই সম্ভব। স্যাক্সোফোন, ইলেকট্রিক এবং আকস্টিক স্প্যানিশের সঙ্গে লিড এবং রিদম, বঙ্গ, কঙ্গো, ত্রম্বনকে কাজে লাগিয়ে উত্তেজনাকে একদম উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে কিশোর এবং আশার অনবদ্য উপস্থাপনা। এ সবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গানের বিশেষ কিছু অংশে কোরাসের ব্যবহার। গানটির অন্তিম তথা চতুর্থ অংশে প্রায় এক মিনিটের বেশি সময় ধরে বেজে চলা অসাধারণ ইন্সট্রুমেন্টাল পিস। অসাধারণ।

মজার বিষয়, আজকের দিনের বহু পরিচিত মেডলের আকারে গানটির উপস্থাপনা করা হয়েছিল। এত গুণে গুণান্বিত যে গান, সেই গানকে শ্রোতারা ভুলবেন কী করে? তাই আজও রেডিয়ো বলুন অথবা আধুনিক কোনও পার্টি, এই গান আমাদের কানে এসে ধরা দেয়। আজও কোনও অল্প বয়সীর কানে এই গান পৌঁছলে তিনিও এর রসাস্বাদন করবেন। অর্থাৎ, এই গান যেন কালের উর্ধ্বে। আজও যদি গানটিকে কোনও বাণিজ্যিক ছবিতে ব্যবহার করা হয়, তাহলেও একইরকম হিট হবে। আর এখানেই লুকিয়ে রয়েছে পঞ্চমের ম্যাজিক। এই সত্যটি পঞ্চমের যে কোনও নিন্দুকও হয়তো নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন।

উপরোক্ত কথাগুলি যে চরম সত্য তা আবারও প্রমাণ করে ওই ছবির অন্য একটি গান। গানটি হল ‘হাম কো তো ইয়ারা তেরি ইয়ারি’। মেজর মাইনর স্কেলের মহামিলন ঘটিয়ে সেই চেনা ছন্দকে আশ্রয় করে জন্ম নেওয়া এই গানটি কিশোরের কণ্ঠে আজও সমান জনপ্রিয়। একদিকে নাসির, আর অন্যদিকে ঋষি ও কিশোর। এ ক্ষেত্রে পঞ্চম যে নিজেকে যথাসাধ্য নিংড়ে দেবেন সেটাই তো স্বাভাবিক!
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৯: পঞ্চমের সুরে লতার গাওয়া ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’ গান শুনে শুনেই প্রস্তুতি শুরু করেন কিশোর

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪২: আশা-ভরসার ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক’

‘মুক্তি’ ছবির ‘ম্যায় জো চলা পি কর’ গানটির ক্ষেত্রে লেখক আনন্দ বক্সীর তো বটেই, পঞ্চমও সমান মাত্রায় প্রশংসার দাবি রাখেন। গানটির শুরুতে আশার মায়াময় কণ্ঠকে সঙ্গত করছে আকস্টিক স্প্যানিশ একটি নির্দিষ্ট ছন্দে। কিন্তু কিশোর যখন গানটি ধরছেন, ছন্দটি সম্পূর্ণ ভাবে পালটে যাচ্ছে। গানের শেষ অবধি সেই ছন্দটিই থেকে যাচ্ছে। এর সঙ্গে কিশোরের সেই অসাধারণ কণ্ঠাভিনয়। আগেই বলেছি, এই ছবিটির মাধ্যমেই পঞ্চমের সঙ্গে লুই ব্যাংকসের যাত্রা শুরু।

‘চলতা পারজা’ ছবিতে কিশোর-লতার গাওয়া ‘আরে আ গায়ে হাম দিলদার’ এবং ‘আপ নে ফরজ নিভায়া’ গান দুটির ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু পাই এক অচেনা পঞ্চমকে। অর্থাৎ ফের পঞ্চম ঘরানার বাইরে বেরিয়ে নতুন কিছু পাওয়া। গান দুটির কথা এবং দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রে হয়তো সেটির প্রয়োজন ছিল। অথচ এই ছবির ‘বেবি ঘর চলো ঘর তুম বিন হ্যায় শুনা’ গানটির ক্ষেত্রে আবার কানে ধরা দেয় সেই চেনা পঞ্চম-মেলোডি এবং কিশোর কণ্ঠের মেলবন্ধন।

ছবির নাম ‘কিনারা’। নির্দেশক গুলজার স্বয়ং। ছবির সবকটি গানই বেরিয়েছে তাঁর কলম থেকে। কিন্তু এক বিশেষ দৃশ্যে নায়ক জিতেন্দ্রের জন্য একটি গান লিখলেন তিনি। গানটি গেয়েছেন কিশোর। পঞ্চম যথারীতি হয়ে উঠলেন অপ্রতিরোধ্য। বস্তুত, এই ছবিতে কিশোর একটি মাত্র গানই গেয়েছেন। গানটি হল ‘জানে কেয়া সোচকার নেহি গুজরা, এক পল রাত ভর নেহি গুজরা’। ইমন রাগকে আশ্রয় করে এই গানের সুরের জন্ম দেন পঞ্চম। রিহার্সালের পর শেষ হল ফাইনাল রেকর্ডিং। কি অসাধারণ সৃষ্টি! গুলজার, পঞ্চম ও কিশোর। তিনজনই সমান প্রসংশার দাবি রাখেন। নায়কের একাকীত্বকে এই ত্রয়ী যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা অতুলনীয়।

‘ডার্লিং ডার্লিং’ ছবির সেই বিখ্যাত গানটির কথা মনে আছে? কোন গানটির কথা বলছি ভাবছেন তো? গানটি হল ‘রাত গেই বাত গেই’। এ যেন মেলোডি এবং রিদমের মহামিলন। হবে নাই বা কেন? নায়ক-নায়িকা যখন দেবানন্দ এবং জিনাত আমন, তখন পঞ্চমকে ধরে রাখার ক্ষমতা কারই বা আছে। তাই আনন্দ বক্সীর কথায় যে সুরটি বসানো হয় সেটি একটি ধামাকার থেকে কোনও অংশে কম হয়নি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫: সুন্দরবন নামরহস্য

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

একটি আপ-টেম্পো প্রেলুড দিয়ে শুরু হয়, যা কিছুটা দীর্ঘায়িত হওয়ার পর আশা ধরেন গানটি। অতঃপর কিশোরের প্রবেশ। পুরো গানটি জুড়ে সেই চেনা ছন্দ। যে ছন্দ কানে এলে শুধু একজনের কথাই মনে পড়ে। তিনি হলেন আর ডি বর্মণ। গানটিকে কেন্দ্র করে যে মজার ঘটনাটি ঘটেছিল সেটি আগের একটি পর্বে উল্লেখ করেছিলাম। যে দৃশ্যে জিনাত আমনকে হাত দিয়ে নিজের কোমরে ট্যাপ করতে দেখা যায়, অর্থাৎ দ্বিতীয় ইন্টারলুডে যে ট্যাপ করার শব্দ আপনারা শুনতে পান, সেটি ফ্রাঙ্কো ভাজ বাজিয়েছিলেন আমরুত রাও কতকারের পিঠের উপর। সেই সময়ে বাণিজ্যিক কোনও ছবিতে শব্দ নিয়ে এ হেন গবেষণা সত্যিই বিরল।

‘আয়সে না মুঝে তুম দেখো’ গানটির ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ভানু গুপ্তর অবদানের কথা আমরা জানতে পারি কিশোরপুত্র অমিত কুমারের থেকে। পঞ্চম তখন আনন্দ বক্সীর লেখা এই গানটির সুর রচনা নিয়ে নিরন্তর গবেষণায় মেতে রয়েছেন। কিছুতেই সঠিক সুর খুঁজে পাচ্ছেন না। নিজের তৈরি করা সুরও নিজের মনঃপুত হচ্ছে না। ঘরের এক কোণে বসে ভানু গুপ্ত পঞ্চমের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তিনি নিজেও খানিকটা চিন্তিত। বক্সী সাহেবের এই লেখাটি এমনই যে, সেটিকে সঠিক সুরে ফেলা যেন একটু কঠিন হয়ে পড়ছে। এ সব ভাবতে ভাবতে ভানু গুপ্ত নিজের মনেই তাঁর আকস্টিক স্প্যানিশটি হাতে তুলে নিয়ে বিভিন্ন রকম রিদম বাজাতে শুরু করেন। এমন সময় রিদমের একটি বিশেষ মুহূর্তে লাফিয়ে ওঠেন পঞ্চম। ভানুকে সেই রিদমটি বাজিয়ে যেতে বলেন আরডি। পঞ্চমও নিজের মনে গুনগুণ করতে থাকেন। এ ভাবেই জন্ম নেয় গানটি।

‘এক ম্যায় অউর এক তু’ গানটিতে আশা-কিশোর যেন একে অপরের পরিপূরক। এবারও সেই পঞ্চমের সিগনেচার রিদম এবং কিশোর-আশার অনবদ্য উপস্থাপনা। আসল কথা হল, পঞ্চমকে সার্বিকভাবে জানতে গেলে তাঁর সব গানকেই সমান আগ্রহে শুনতে হবে। তাঁর প্রতিটি গানেই কিছু না কিছু অভিনবত্ব রয়েছে। ওঁর এমন অনেক সৃষ্টি রয়েছে যেগুলি কখনও হয়তো সে ভাবে আমাদের কানে এসে পৌঁছয়নি। তার একটি কারণ হতে পারে সেই সব গান যে সব ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলি বাণিজ্যিকভাবে তেমন ভাবে সফল হয়নি। তাই আমরাও সেই সব গান নিয়ে খুব বেশি উৎসাহ দেখাইনি। যেমন ‘ডার্লিং ডার্লিং’ ছবিরই ‘হ্যালো ডার্লিং’ গানটির মধ্যেও লুকিয়ে আছে অভিনবত্ব। নায়ক দেবানন্দ লিপ দিচ্ছেন কিশোরকে। অত্যন্ত মজার গান। আনন্দ বক্সীর এই লেখায় সুর বসানো খুব একটা সহজ কাজ হয়তো ছিল না। অথচ পঞ্চম এ ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন দুটি জিনিসকে। একটি তাঁর প্রতিভা, আর অন্যটি কিশোর কণ্ঠের মধুরতা। সঙ্গে অবশ্যই রয়েছে আশা কণ্ঠের মায়াজাল। এই তিনে মিলে গানটিকে করে তুলছে সুমধুর।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২৩: গোবিন্দর হেঁয়ালি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২: মেয়েটি যেন গৃহলক্ষ্মী

এই ছবির ‘ও অউরত হ্যায় ইয়া সারাব’ গানটির মধ্যে অনেকেই হয়তো তেমন কিছু খুঁজে পাবেন না। কিন্তু যদি মন দিয়ে শোনা যায় তাহলে পাওয়া যাবে মেলোডির অভাবনীয় এক বিস্তারের উদাহরণ। তার সঙ্গে অন্তরার সুরের যে বিন্যাস সেটিও বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়। দুটি অন্তরার ক্ষেত্রেই শেষ দুটি পংক্তি গাওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। কিন্তু কিশোর খেলার ছলে করেছেন কাজটি। তার সঙ্গে উপহার হিসেবে দিয়েছেন তাঁর কণ্ঠের বিরল এক মাদকতাকে। তাই তো কিশোর-পঞ্চম অবিচ্ছেদ্য। তাঁদের সুগভীর বন্ধুত্ব এবং পেশাগত বোঝাপড়ার এমন ভালো উদাহরণ খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই হয়তো এবার সুরকার পঞ্চম এবং গায়ক কিশোর দু’ জনে মিলে গেয়ে ফেলেন ‘ও লায়লা তুঝে ঢুনডে তেরা ছাইলা’ গানটি। দুই কিংবদন্তির সার্বিক উপস্থাপনা গানটিকে করে তুলেছে অনন্য। বলা যেতে পারে, এই গানটিই পঞ্চম কিশোরের প্রথম দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া গান।

‘চাঁদি সোনা’ ছবির ‘আপসা কই হাসিন’ এবং ‘সোচা থা ম্যায়নে’ গান দুটি যদি না শুনে থাকেন একটিবার করে শুনে দেখবেন। আপাতভাবে গান দুটিকে সাধারণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আদতে তা নয়। কেন? কিশোরের বলিষ্ঠ কণ্ঠ গান দুটিকে যেন আরও বেশি করে আলোকিত করে তুলেছে। তাই তো কিশোর পঞ্চম-জুটি আজও বেঁচে আছে শ্রোতাদের হৃদয়ে। বেচেঁ থাকবে আগামীতেও।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content