শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


কিশোর ও শচীনকর্তা।

শচীনকর্তার প্রয়াণ যেমন বলিউডকে দিয়ে গিয়েছিল এক অপূরণীয় শূন্যতা, ঠিক তেমনি পঞ্চমকে দিয়ে গিয়েছিল এক সুগভীর একাকিত্ব। যে বটবৃক্ষের ছায়ায় তাঁর ছেলেবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠা, সঙ্গীত শিক্ষার শুরু, স্বরলিপি চিনতে শেখা, সুর সৃষ্টির আবেগের জন্ম হওয়া, সেই ছায়া যেন হঠাৎই কোনও আগাম বার্তা না দিয়ে চিরকালের মতো উধাও হয়ে যায়। তবু মায়ের কথা ভেবে, সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে যান তিনি। বাবার দেওয়া উপদেশগুলি বারবার মনে পড়তে থাকে। বাবার রেখে যাওয়া হারমোনিয়াম, তাঁর ব্যবহৃত সমস্ত কিছু যেন প্রতিক্ষণে পঞ্চমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। তিনি অনুধাবন করেন যে, এবার নিজেকে আরও ব্যস্ত করে তুলতে হবে। বাবা তাঁকে শিক্ষার মাধ্যমে যে সেরা উপহারটি দিয়ে গিয়েছেন, সেটিকে কাজে লাগিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে চলতে হবে।

শুধু পঞ্চমই নন, শচীনদেব বর্মণের পরলোকযাত্রা কিশোর কুমারকেও সমান ভাবে ব্যথিত করেছিল। শচীনকর্তা কিশোরকে নিজের জেষ্ঠো পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। কিশোর কুমারেরও তাঁর প্রতি ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। সেই কারণেই কিশোর পঞ্চমের এই দুর্দিনে বড় ভাইয়ের মতোই পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন। তিনি সর্বদা খোঁজ নিতেন পঞ্চমের। পরবর্তী সময়ে পঞ্চম এক অদ্ভুত ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন।

‘মিলি’ ছবির ‘বড়ি সুনি সুনি হ্যায়’ গানটির রেকর্ডিংয়ের আগে ফাইনাল রিহার্সাল করতে কিশোর এসেছিলেন শচীনকর্তার বাড়িতে। শেষ হয় রিহার্সাল। কিশোর ফিরে যান নিজের বাড়িতে। তার ঠিক ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মাথায় শচীনকর্তা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। শুরু হয় চিকিৎসা। খবর পাওয়া মাত্র হাসপাতালে ছুটে যান কিশোর। সেই অসুস্থতার মাঝেও শচীনকর্তা কিশোরের কাছে গানটির রেকর্ডিং নিয়ে নিজের দুশ্চিন্তার কথা ব্যক্ত করেন। যেহেতু তিনি অসুস্থ, তাই রেকর্ডিং পিছিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও করতে থাকেন। কিন্তু কিশোর তাঁকে সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত করেন বলেন, তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। রেকর্ডিংয়ের কাজটি কিশোর ঠিক সামলে নেবেন। তিনি শচীনকর্তাকে এই বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিন্ত থাকতে অনুরোধ করেন।
‘বড়ি সুনি সুনি হ্যায়’ গানের রেকর্ডিং যখন হয়, তখন শচীনকর্তা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার কিছুদিনের মধ্যেই চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে শচীনদেব বর্মন পাড়ি দেন আনন্দলোকে। শচীনকর্তার সুরে কিশোরের গাওয়া শেষ গান ‘বড়ি সুনি সুনি হ্যায়’ থেকে যায় মানুষের হৃদয়ে, চিরকালের জন্য।

আসে ১৯৭৬ সাল। পঞ্চমের ক্ষেত্রে শুরু হয় এক নতুন পথচলা। আসে শক্তি সামন্ত প্রযোজিত ছবি ‘বালিকা বধূ’। ডাক পান পঞ্চম। নায়ক নবাগত শচীন। আর তাই পঞ্চম খুঁজতে থাকেন নতুন কোনও কণ্ঠ। যে কণ্ঠ শচীনের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অনেকাংশে খাপ খেয়ে যাবে। জানা যায়, এর আগে পঞ্চম কিশোর-পুত্র অমিত কুমারের কণ্ঠে ঘরোয়া পরিবেশে গান শুনেছিলেন। তাই তাঁর মনে পড়ে যায় অমিতের কথা। ফোন করেন কিশোর কুমারকে। কিশোরের অনুমতি নিয়ে অমিতকে পরের দিন সময় মতো পৌঁছে যেতে বলেন রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে। পৌঁছে যান অমিত। সঙ্গে কিশোর কুমার স্বয়ং। পঞ্চম অমিতকে নিয়ে বসে ‘বড়ে আচ্ছে লাগতে হ্যায়’ গানটি শেখাতে শুরু করেন।

অমিতের এই প্রথম পঞ্চমের সঙ্গে কোনও বাণিজ্যিক ছবিতে কাজ। সামনে বিরাজমান স্বয়ং আরডি বর্মন এবং বাবা কিশোর কুমার। খুব স্বাভাবিক কারণেই অমিত কিছুতেই যেন নিজেকে নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী মেলে ধরতে পারছিলেন না। ব্যাপারটি বেশ বুঝতে পারেন পঞ্চম। তাই আর সময় নষ্ট না করে কিশোরকে অনুরোধ করেন কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যেয়ে অপেক্ষা করতে। যাতে অমিত একটু নিজের মতো করে গাইতে পারেন। পঞ্চমের অনুরোধ মেনে নিয়ে কিশোর রেকর্ডিং রুমের বাইরে যেয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। আর ভিতরে তখন চলতে থাকে পঞ্চম এবং অমিতের মহাযজ্ঞ। এবার আর খুব বেশি সময় নেননি অমিত। গানটির ফাইনাল রেকর্ডিং শেষ হয়। নিখুঁত ভাবে গানটি উপস্থাপিত করেন অমিত।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৮: মনে পড়ে পঞ্চমের কণ্ঠে শোলে ছবির সেই বিখ্যাত ‘মেহবুবা মেহবুবা…’ গানটি?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪: সুন্দরবনের লবণ-বৃত্তান্ত

গানের দৃশ্যটি যতবার দেখবেন, ততবারই মনে হবে যেন অভিনেতা শচীন স্বকণ্ঠেই গাইছেন। উপরোক্ত ঘটনাটি একটি সাক্ষাৎকারে আমিতকুমার বলতে গিয়ে যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন অতীতের সেই দিনগুলিতে। সেই স্মৃতিগুলি যেন আজও তাঁর কাছে তাজা হয়ে রয়ে গিয়েছে। আর থাকবে নাই বা কেন। এই গানটি দিয়েই যে অমিতের পঞ্চমের সঙ্গে যাত্রা শুরু। বলাই বাহুল্য, কিশোর কুমার অমিতের ওপর যথেষ্ট খুশি হয়েছিলেন। হয়তো পঞ্চমের সঙ্গে অমিতের এই সাফল্য নিয়ে কথাও হয়েছিল কিশোরের।

‘বুলেট’ ছবির ‘চোরি চোরি চুপকে চুপকে’ গানটি কোথাও যেন একটু অন্যরকম। সুরের বিন্যাসটি একটু আলাদা। আর কিশোর কুমারের আবার সেই স্বভাবসিদ্ধ অভিনয়। অবশ্যই কণ্ঠের মাধ্যমে। সঙ্গে আশার মাদকতায় ভরা কণ্ঠস্বর। আর সবার আড়ালে সেই এক এবং অদ্বিতীয় পঞ্চম।

‘নেহেলে পে দেহেলা’ ছবির ‘সাওয়ান কা মাহিনা আ গয়া’ গানটির ক্ষেত্রে হয়তো নায়ক সুনীল দত্ত এবং নায়িকা শায়রা বানুর কথা মাথায় রেখে একটু যেনো ভিন্ন স্বাদের সুর রচনা করেন পঞ্চম। যদি কোনও কারণে না শুনে থাকেন, একটিবার শুনে দেখবেন। পরিচিত ‘পঞ্চম ঘরানার’ থেকে অনেকটাই আলাদা।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি, একাধিক সমস্যার অব্যর্থ দাওয়াই, বাজিমাত হবে এই ‘অমৃত’ ফলে

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫১: মারীচমায়ায় কি দিগভ্রান্ত সীতা?

‘মেহবুবা’ ছবির ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’ গানটিকে নিয়ে এক মজার কাহিনি শুনিয়েছিলেন পঞ্চম তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে। গানটিতে সুরারোপ করার পর কিশোরের সঙ্গে বসেন তিনি। গানটি শোনান তাঁকে। কিশোর কুমারকে তিনি এটাও বলেন যে, লতাও একই গান ছবির একটি অংশে গাইবেন। ব্যাস। কিশোর কুমার পত্রপাঠ ঘোষণা করেন যে, আগে লতা দিদিকে দিয়ে গানটি গাওয়াতে হবে। রেকর্ডিং শেষ হওয়ার পর লতার গাওয়া গানটি তিনি দিবারাত্র শুনতে থাকবেন। যখন বুঝবেন যে তিনি এবার প্রস্তুত, তখনই তিনি রেকর্ডিংয়ের তারিখ দিতে পারবেন। যেমন কথা, তেমনই কাজ। অগত্যা পঞ্চম আগে লতাকে দিয়েই গাওয়ান গানটি। তারপর সেই গান শুনে শুনে শুরু হয় কিশোরের প্রস্তুতি। খুব বেশি সময় লাগেনি তাঁর।

শিবরঞ্জনী রাগের আশ্রয়ে জন্ম হওয়া সুরে কিশোর যেন সম্পূর্ণরূপে সমর্পিত করেন নিজের কণ্ঠকে। বেস থেকে শুরু করে ক্রেসেন্ডো অবধি অবলীলায় নিজের কণ্ঠকে ব্যবহার করেছেন এই গানটিতে। গানের কিছু জায়গায় আকস্টিক স্প্যানিশ কানে ভেসে আসে। আর ভায়োলিনের থেকে জন্ম নেওয়া অবলিগেটোগুলি গানটিকে যেন এক অপার্থিব সৌন্দর্য প্রদান করে। আর কিশোরের সেই হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সুগভীর কণ্ঠস্বর। তাই হয়তো ১৯৭৬ সালে ভূমিষ্ঠ হওয়া এই গানটি ২০২৩ সালেও একইরকম জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪: আমারে তুমি অশেষ করেছ

মা-বাবার বয়স বাড়ছে, এই সময় পড়ে গেলে বড় বিপদ ঘটতে পারে, সুরক্ষার প্রয়োজনে মানতে হবে কিছু নিয়ম

‘মহা চোর’ ছবির ‘হিন্দু হুঁ ম্যায় না মুসলমান হুঁ’ গানটির কথার গুরুত্ব অনুধাবন করে আরও একবার নিজের ঘরানার থেকে বেরিয়ে এসে একটু অন্যধরনের সুর রচনা করেন পঞ্চম। মাইনর স্কেলকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা গানটির আবেদন শ্রোতাদের নাড়া দিতে বাধ্য। একই ছবির ‘মেরা নাম ইয়ারো মহা চোর হ্যায়’ গানটিতে আবার কানে আসে কিশোরের সেই অভিনয়। রাজেশ খান্নার লিপে ফুটে ওঠে কিশোর কণ্ঠের সেই অভিনয় সত্তা। ‘বন্দল বাজ’ ছবির ‘রুক মেরি জান’ গানটিতে রাজেশ খান্নার লিপে আমরা পাই কিশোর কুমারকে। আর এবার আবার সেই চেনা পঞ্চম। ছন্দ থেকে শুরু করে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। সবটুকুই অতিপরিচিত।

এই গানেও সেই কণ্ঠের দ্বারা নিখুঁত অভিনয়। যুগ যুগ জিও কিশোর কুমার!
‘ঢঙ্গি’ ছবির ‘পেয়ারা সা তেরা মুখরা’ গানটি কি অসাধারণ বলুন তো! আনন্দ বক্সী সাহেবের লেখায় একটি উপযোগী সুর প্রদান করা হয়েছে এবং শেষ কাজটি সম্পন্ন করেছেন কিশোর। শুরু থেকে শেষ অবধি আবেগের ঢেউয়ে ভাসিয়ে রেখেছেন শ্রোতাদের। এক কথায় অসামান্য।

‘আখে মিলায়েঙ্গে বাতে সুনায়েঙ্গে’ গানটি নিশ্চই শুনেছেন। ‘ভাওয়ারা’ ছবির এই গানটির দৃশ্যে নায়ক রণধীর কাপুর এবং নায়িকা পারভিন বাবি একটি বরফে ঢাকা জায়গায় যখন কিশোর এবং লতাকে লিপ দিচ্ছেন, তখন কখনও কি মনে হয়েছে যে তাঁরা স্ব স্ব কণ্ঠে গাইছেন না? গানটির সুর, অ্যারেঞ্জমেন্ট, ফিলার, প্রেলুড, ইন্টারলুড, গায়ক গায়িকার কণ্ঠ এবং নায়ক নায়িকার অসাধারণ অভিনয় — সবে মিলে এক অভিনবত্বের নিদর্শন রাখে আমাদের সামনে। এই ছবিরই একটি দুষ্টুমিষ্টি গানে আবার পাওয়া যায় কিশোরের সেই চেনা অভিনয় সত্তা। গানটি হল ‘পহেলে হর মেহবুবা জানে যা’। আর কতগুলি উদাহরণ দেব বলুনতো?

পিতা-পুত্র।

‘খলিফা’ ছবির ‘দেখ তুঝকো দিলনে কাহা’ গানটি রচনা করেন গুলশন বাওরা। সুরকার পঞ্চম। দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছেন কিশোর-আশা। পঞ্চমের সুরের যাদু আবারও লক্ষ্যণীয়। প্রেলুড কানে পৌঁছতেই পুরো গানটি শোনার জন্য মন যেনো ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর গানটি শুরু হতেই কানে ধরা দেয় পঞ্চম এর সেই সিগনেচার রিদম। এক কথায় অনবদ্য।

একই ছবির ‘দিল মাচল রাহা হ্যায়’ গানটিতে আবার সেই পঞ্চম-কিশোর-আশার মিলিত জাদু। গুলশন বাওরার কলম থেকে বেরিয়ে আসা গানটিকে প্রাণদান করেন পঞ্চম। মাইনর স্কেলে রচিত হয় সুর এবং সেই আবার চেনা একটি ছন্দ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ছবি দিয়েই শুরু হয় পঞ্চম এবং গুলশন সাহেবের এক সঙ্গে পথ চলা।

‘বিশ্বাসঘাত’ ছবিতে আবার পঞ্চম এবং গুলশন বাওরা জুটির এক সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসে। দু’ জনে মিলে কিশোরের জন্য রচনা করেন ‘হাম দো নো কা মেল’ গানটি। কখনও শুনে দেখবেন। খুব সাধারণ সুর অথচ মেলোডির মূর্ছনা যেন আকাশচুম্বি। নায়ক সঞ্জীব কুমারের লিপে গানটি যেন অসামান্য হয়ে উঠেছে। সার্বিক ভাবে গানটি হয়ে উঠেছে ‘পঞ্চমময়’।

মোটের উপর ১৯৭৬ সালটি আর একটি সাফল্যময় বছর হিসেবে প্রমাণিত হয় পঞ্চমের ক্ষেত্রে। ‘ট্রেন্ড-সেটার’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে সক্ষম হন তিনি। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি প্রযোজক এবং নির্দেশকের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠতে শুরু করেন। নিজের গতিপ্রকৃতি নিজের কাছেও পরিষ্কার হয়ে যায়। আরও বেশি মাত্রায় যত্নবান হয়ে ওঠেন নিজেকে মেলে ধরার ক্ষেত্রে। নিজের মতো করে চালিয়ে নিয়ে যান সুর সঙ্গীত নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা। সুরসৃষ্টির সঙ্গে নিজের উদ্ভাবন ক্ষমতাকে পাশাপাশি রেখে চলতে থাকে রাজসূয়যোগ্য।—চলবে।

Skip to content