শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


হিট জুটি।

সাল ১৯৭৪। শুরু হয় পঞ্চমের আরও একটি সম্ভাবনাময় বছর। বলাই বাহুল্য, শচীনকর্তা বাবা হিসেবে যথেষ্টই আশাবাদী হয়ে ওঠেন পুত্রের সাফল্যের বিষয়ে। স্ত্রী মীরার সঙ্গেও তাঁর অনেক কথা হতো পঞ্চমকে নিয়ে। দু’ জনই ছেলের সাফল্যের বিষয়ে যথেষ্টই প্রত্যয়ী ছিলেন। তৎকালীন বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও পঞ্চমের প্রতি ধীরে ধীরে নির্ভরশীল হয়ে উঠছিল। সেই খবরও পৌঁছেছিল শচীনকর্তার কানে। তাই সার্বিকভাবে তাঁর সন্তানকে নিয়ে গর্ববোধ করার বিষয়টি যথার্তই যুক্তিযুক্ত।

মুক্তি পায় ঋষি কাপুর অভিনীত ‘জাহরিলা ইনসান’। ‘ও হানসিনি মেরি হানসিনি’ গানটি যারপরনাই জনপ্রিয়তা পায়। প্রেলুডে স্যাক্সোফোন এবং ভায়োলিন অদ্ভুত একটি ভাবের সৃষ্টি করে। আর তারপরই শুরু হয় হোমি মুল্লানের সেই ছন্দের যাদু। একটি বঙ্গের ওপর ডান হাতের চারটি আঙুল দিয়ে পুরো গানটি জুড়ে এক অভিনব কায়দায় বাজিয়ে গিয়েছেন তিনি। এমন ভাবে বাজিয়েছেন যাতে হাতের নখগুলি বঙ্গর ড্রাম-হেডকে স্পর্শ করে এবং একটি মেটালিক সাউন্ড সৃষ্টি হয়। এক বার ভালো করে শুনে দেখবেন গানটি। ঠিক বুঝতে পারবেন কী বলতে চাইছি। আড়ালে সেই পঞ্চম। এ ক্ষেত্রে কিশোরও যথারীতি রাজত্ব করে গিয়েছেন পুরো গানটি জুড়ে।

‘উজালা হি উজালা’ ছবির ‘সভেরে সভেরে তেরে পেয়ার মে’ গানটিতে মেহমুদের লিপে কিশোর কণ্ঠে আমরা আবার খুজে পাই তাঁর সেই অভিনয় ক্ষমতা। সেই কারণেই হয়তো এই গানটির দায়িত্ব কিশোরকে সঁপেছিলেন পঞ্চম।
‘হামসকল’ ছবির ‘রাস্তা দেখে তেরা’ গানটি রাজেশ খান্নার লিপে কিশোর কুমারের একটি অনবদ্য উপস্থাপনা। সুরের কাঠামো, ছন্দ এবং প্রবাহের মধ্যে আমরা খুজে পাই সেই চেনা পঞ্চমকে। ছন্দের মাধুর্য এবং মেলোডি এই দুইয়ের সাহায্যে আনন্দ বক্সীর লেখায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন পঞ্চম। একটু হায়ার অকটেভে গাইয়েছেন কিশোরকে দিয়ে। ফলস্বরূপ কিছু জায়গায় তাঁর গলা প্রায় ক্রেসেনডোতে পৌঁছে গিয়েছে। অসম্ভব সুন্দর একটি গান।

এই ছবির আর একটি গান যেটি কিশোর-আশার ডুয়েট, সেটিও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। গানটি হল ‘হাম তুম গুমসুম রাত মিলন কি’। এই ক্ষেত্রে সুরের এক অপূর্ব মডিউলেশন বিশেষভাবে কানে ধরা দেয়। গায়ক-গায়িকা এই গানটির ক্ষেত্রেও কিছু জায়গায় ক্রেসেনডোর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন।
‘দিল দিওয়ানা’ ছবির কিশোরের গাওয়া ‘শুন নীতা ম্যায় তেরে পেয়ারকে গীত’ গানটির প্রেলুডটি শুনলে মনে হয় বুঝি কোনও ক্যাবারে শুরু হতে চলেছে। কিন্তু কিছু পরেই সেই ধারণা পালটে যায় যখন কিশোর গানটি শুরু করেন। ছন্দটি অনেকাংশে ‘পার্টি রিদম’-এর মতো শোনালেও পঞ্চমের মেলোডি এবং কিশোরের পরিবেশনা এই দুইয়ে মিলে গানটি শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে।

কিশোরের অভিনয় সত্তাকে আরও একবার ব্যবহার করেন পঞ্চম ‘ইমান’ ছবির একটি গানে। গানটি হল ‘পাইসে বিনা পেয়ার ফিজুল হ্যায়’। কখনও শুনে দেখবেন। গানটি সে ভাবে জনপ্রিয় হয়নি ঠিকই, কিন্তু এই গানটিতে কিশোর কণ্ঠের অভিনয় আরও একবার সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৫: পঞ্চমের অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে একটি কিশোরের গাওয়া জনপ্রিয় ‘নদিয়া সে দরিয়া’ গানটি

মধ্যমানের ভিএফএক্স আর সবাইকে সন্তুষ্ট করতে যাওয়াই কাল হল আদিপুরুষের

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-২: আইজেনস্টাইন, যুদ্ধজাহাজ ও মন্তাজ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

আসলে শুধু গান নয়। পঞ্চম কিশোরের কাছ থেকে হয়তো আরও বেশি কিছু আশা করতেন। যতো দিন গিয়েছে, সেই আশা বেড়েছে বই কমেনি। পঞ্চম যখনই কিশোরের কথা মাথায় রেখে কোনও সুর তৈরি করতেন তখনই অভিনব কিছু করার নেশায় মেতে উঠতেন। সেটি গানের মাধ্যমে অভিনয়ই বলুন, সুরের চড়াই উৎরাই-ই বলুন, ইয়র্ডলিংই অথবা সার্বিক উপস্থাপনা বলুন। এগুলি ছাড়াও কিশোরের স্পষ্ট উচ্চারণ, গানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে একাত্ম করে নিয়ে সঠিক আবেগ সঞ্চার করে তোলার অপরিসীম ক্ষমতা ছিল। নায়কের ব্যাক্তিত্বের কথা মাথায় রেখে নিজের কণ্ঠকে ব্যবহার করতেন। সর্বোপরি, একটি ম্যানলি ভয়েস। এই সবকিছুকেই পঞ্চম কাজে লাগিয়েছেন যথাযত ভাবে। কিছুই ছাড়েননি। সবটুকু নিয়েছেন। আর কিশোরও দিয়ে গিয়েছেন প্রাণভরে।

উদাহরণ স্বরূপ ধরা যেতে পারে ‘ফির কব মিলোগি’ ছবির ‘খিট পিট খিট করে’ গানটি। নায়ক বিশ্বজিৎ-এর লিপে কিশোরের গাওয়ার ঢং এক বার ভালোভাবে লক্ষ্য করুন। পুরোটাই আলাদা। শুনলে আপনারা ঠিক বুঝে যাবেন। তাই নায়ক যিনিই হন, কিশোরকে নিয়ে পঞ্চম যেন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিন্তে থাকতেন।

কিন্তু পাশাপাশি যদি ‘খোটে সিক্কে’ ছবির ‘জীবন মে তু ডরনা নেহি’ গানটি শোনা যায়, সেই গানটিতে ফিরোজ খানের লিপে আমরা পাই এক অন্য কিশোরকে। সেই ম্যানলি ভয়েস। সিম্ফনির আকারে সাজানো ইন্টার লুড, পুরুষ এবং মহিলা কণ্ঠে কোরাস এবং সেই পঞ্চমের চিরপরিচিত রিদম গানটির আবেদনকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।
‘আজনবি’ ছবির ‘এক আজনবি হাসিনা সে’ গানটিতে নায়ক রাজেশ খান্না নায়িকা জিনাত আমনকে প্রেম নিবেদন করছেন। আর লিপ দিচ্ছেন কিশোর কণ্ঠকে। মেজর স্কেলে গানটির সুর রচনা করা হয়েছে। কিন্তু অন্তরাগুলিতে রিলেটিভ মাইনরের ছোঁয়া কানে ধরা পরে। যেটি গানটিকে একটি অভিনব সৌন্দর্য প্রদান করতে সক্ষম হয়। সেই আবার পঞ্চম যাদু। আর সেই সঙ্গে কিশোরের গায়কী। শুধু নির্বাক হয়ে শুনতে হয়।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩: গায়ে আমার পুলক লাগে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১: সুন্দরবনের শেকড়ের খোঁজে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৪: মাথায় চোট মানেই কি ইন্টারনাল হেমারেজ?

‘ভিগি ভিগি রাতো মে’ গানটিতে এক অদ্ভুত ছন্দ ব্যবহার করেছেন পঞ্চম। মাদল বেজে গিয়েছে সমান ব্যবধানে। অঝোরে পড়ে যাওয়া বৃষ্টির মধ্যে নায়ক রাজেশ খান্না এবং নায়িকা জিনাত আমন লিপ দিয়েছেন যথাক্রমে কিশোর এবং লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে। কিন্তু গানটির একদম শুরুতে বাজ পড়ার শব্দটি কীভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে জানেন? সেটি সৃষ্টি করা হয়েছে খুব বড় এবং পাতলা একটি টিনের পাতকে মাইক্রোফোনের সামনে খুব জোরে ঝাকিয়ে। কৃতিত্বের দাবিদার হমি মুল্লান সাহেব। আর অবশ্যই সেই প্রবাদ প্রতিম পঞ্চম, যিনি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ সৃষ্টি করার নেশায় মেতে থাকতেন।

একই ছবির ‘হাম দোনো দো প্রেমী’ গানটিতে নায়ক নায়িকা একটি ট্রেনে করে চলেছেন অজানা কোনও একটি জায়গায়। আর তাই, ট্রেনের ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গানের মূল ছন্দটি সৃষ্টি করা হয়েছে ।একটি রেসো রেসো এফেক্ট ব্যবহারের পাশাপাশি রাখা হয়েছে পঞ্চম এর পছন্দের আরও একটি বাদ্যযন্ত্র। অর্থাৎ মাদল। সেটি বাজিয়েছেন মাদলের জাদুকর কাঞ্চা।

‘ইশক ইশক ইশক’ ছবির ‘আচ্ছে বাচ্চে নেহি রোতে হ্যায়’ গানটিতে দেবানন্দের লিপে কী অসাধারণ গেয়েছেন কিশোর। সেই সঙ্গে সুরের কাঠামো, ছন্দ এবং কোরাস মিলে মিশে এক নতুনত্বের ছোঁয়া এনে দিয়েছে। কিশোরের কণ্ঠ পুরোপুরি মিশে গিয়েছে দেবানন্দের ব্যক্তিত্বের মধ্যে।

খুব বেশি জনপ্রিয় না হওয়া সত্বেও ‘মনোরঞ্জন’ ছবির ‘আয়া হুঁ ম্যায় তুঝকো লে জাউঙ্গা’ গানটি সত্যি অভিনব। আপ টেম্পোতে শুরু হয়। মাঝপথে টেম্পোটি অনেকটা নেমে যায়। আবার ফিরে যায় আগের গতিতে। এহেন গবেষণা করার দুঃসাহস দেখানোর ক্ষমতা বোধহয় পঞ্চোমেরই ছিল। বিশেষ করে এমন একটি ছবিতে যেটির নির্দেশক শাম্মী কাপুরের মতো কেউ। কিন্তু উল্লেখ্য, এই ছবির পর থেকেই পঞ্চম শাম্মী দু’ জনের সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই গানটি তেমন ভাবে নজির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি।

অথচ একটি পাহাড়ি ধুনকে আশ্রয় করে জন্ম নেওয়া ‘চরিত্রহীন’ ছবির একটি গান ‘দিল সে দিল মিলনে কি কই কারণ হোগা’ অসম্ভব সাড়া ফেলে দেয়। গানটির প্রেক্ষাপট যেহেতু একটি পাহাড়ি অঞ্চল, তাই এমনই একটি ধুনের কথা মাথায় আসে পঞ্চমের। আনন্দ বক্সীর লেখাটিকে মন-প্রাণ ঢেলে সাজিয়ে তোলেন পঞ্চম। আর কিশোর-লতা? আমি কিছু বলব না। গানটি শুনে আপনারাই বলুন।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি: অযোধ্যা— প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রাণকেন্দ্র/১

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫০: আমার সোনার হরিণ চাই—সীতার চাওয়া কি সত্যি হবে?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৯: যোগ্য বা অযোগ্য—যে মানুষই রাজার আশেপাশে থাকেন, রাজা তারই কথায় ওঠেন-বসেন

‘মদহোশ’ ছবির ‘কসম খাও তুম একবার’ গানটি যেন একটু আলাদা। এই গানটি কিশোর আশা দুজনেরই ভয়েস মডিউলেশনের এক অকাট্য প্রমাণ বহন করে। সুরটি যেন অসম্ভব চঞ্চল। কখনও এক জায়গায় থাকে না। পুরো গানটি জুড়ে খুব দ্রুত নিজের স্থান পরিবর্তন করে চলে। গায়ক-গায়িকা দু’ জনকে দিয়েই কয়েকটি জায়গায় ‘স্ট্যাকাটো’ ফর্মে গাওয়ানো হয়েছে। এক কথায় অনবদ্য।

একই ছবির আরেকটি কিশোর-আশা ডুয়েট ‘মেরা ছোটা সা দিল’ গানটির সুরটি একইরকম চঞ্চলতায় ভরা। একটি দ্রুত ছন্দ ব্যবহার করার পাশাপাশি পঞ্চম সুরটিকেও যেন ব্যস্ত রেখেছেন পুরো গানটি জুড়ে। আর গায়ক-গায়িকা ও নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। শুরুর দিকে ছন্দটি বুঝে নিতে হয়তো একটু অসুবিধে হয়। কিন্তু মুখরা শুরু হওয়ার কিছু পরেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে।

বেশিরভাগ গানের ক্ষেত্রেই ‘আলাপ’ ব্যাপারটিকে অসম্ভব গুরুত্ব দিতেন পঞ্চম। ধ্রুপদ সঙ্গীতে ‘আলাপ’ আমাদের কর্ণযুগলকে বাকি গানটি শোনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে। অথবা, চলতি কথায় বলতে গেলে একটি মুডের সঞ্চার করে। অর্থাৎ, আলাপ হল গানের একদম শুরুর অংশ। উদাহরণ হিসেবে ‘আপ কি কসম’ ছবির ‘কার বটে বদলতে রহে সারি রাত হাম’ গানটির কথা বলা যেতেই পারে। শুনে দেখবেন, একদম প্রথমে কিশোর-আশা আলাপ করছেন। তারপর শুরু হচ্ছে প্রায় সিম্ফনির মাত্রায় পৌঁছে যাওয়া একটি প্রেলুড। তারপর সবরকম বাদ্যযন্ত্র থেমে যাচ্ছে। ঠিক তারপরই আশা গানের প্রথম লাইনটি খালি গলায় শুরু করছেন। হালকা করে ছন্দ ধরে রাখছে একটি আকস্টিক স্প্যানিশ। প্রায় কানে না আসার মতো করেই। আসল ছন্দ শুরু হচ্ছে গানটির দ্বিতীয় লাইন থেকে। আর ইন্টারলুডগুলিও কী অসাধারণ ভাবে সাজানো হয়েছে ভাবুন একবার। গানটি শোনার সময় অন্য কিছু ভাবার যেন কোন অবকাশই থাকে না।

এই ছবির আরও একটি গান, ‘জিন্দেগী কে সফর মে গুজার জাতে হ্যায় জো মাকাম’, যেটিতে পঞ্চম, নায়কের অনুতাপ অথবা উপলব্ধি যাই বলুন, সুরের মাধ্যমে কী অসাধারণ ভাবেই না তুলে ধরেছেন। আর আনন্দ বক্সীর লেখা? ওঁকে শতকোটি প্রণাম। ওই লেখার সঙ্গে অন্য কোনও ধাঁচের সুর? এক কথায় অসম্ভব। ওই কথার সঙ্গে একমাত্র যেন এই সুরটিই বসানো যেতে পারে। আর যেকোনও সুর যেন বেমানান হতে বাধ্য। আর এই গানটির ক্ষেত্রে কিশোর কুমারের কথা নতুন করে কী বলি বলুনতো। সেটি নিতান্তই কি বাতুলতা হয়ে যাবে না?—চলবে
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content