শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ম্যাজিক জুটি।

১৯৭৩ সালে আসে আরেকটি ছবি। নাম ‘জশিলা’। যশ চোপড়া পরিচালিত এই ছবিতে কিশোরের গাওয়া ‘কিসকা রাস্তা দেখে’ গানটির আবেদন শ্রোতাদের আঁখিযুগলকে যেন অশ্রুসিক্ত করে তোলে। দৈনন্দিন কাজে ভুলে থাকা বেদনাগুলি যেন একে একে মাথাচাড়া দেয়। মনে করিয়ে দেয়, পিছনে ফেলে আসা আবেগঘন বিশেষ কিছু মুহূর্তগুলি। যেগুলি অনেক কষ্টে আমরা ভুলে থাকতে শিখেছিলাম। কিন্তু এই গানটি যেন আমাদের সেই বেদনাময় স্মৃতিগুলি ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।

সুরের কাঠামো, গানটি জুড়ে থাকা প্যাথস, জায়গা বুঝে অব্লিগেটোর ব্যবহার, ১২ স্ট্রিং গিটারের কিছু ফিলার, ভায়োলিনের মূর্ছনা এবং সর্বোপরি সুরস্রষ্টা পঞ্চমের ‘যাদুকাঠি’ কিশোর কুমার। শুনেছেন তো বটেই। তবু আরও একবার শুনবেন গানটি। তবে ব্যস্ততার মধ্যে নয়। শুনবেন অবসর সময়ে। অথবা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে। যখন চারিদিক নিস্তব্ধ। যখন সেদিনের মতো সব কথা শেষ হয়ে গিয়েছে। মোবাইল ফোন বেজে ওঠার আর কোনও সম্ভাবনা নেই, এমন একটি সময়ে। কথা দিলাম, এই গানটি আপনাকে মনে করিয়ে দেবে অনেক কিছু…অনেক অনেক কিছু।
একই ছবির ‘কুছ ভি করলো এক দিন তুমকো’ গানটির সুরের মডিউলেশন এর ধরনটি ভালো করে খেয়াল করুন। কিশোর এবং লতা দু’ জনেই গানটির সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে সমান ভাবে সফল। দুটি কণ্ঠ যেন একে অন্যের মধ্যে মিশে যায় ধীরে ধীরে। গানটির রেকর্ডিং শেষ হওয়ার পর পঞ্চম যে তৃপ্তির হাসি হাসবেন সেটাই তো স্বাভাবিক!

মুক্তি পায় ‘নমক হারাম’। নির্দেশক ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায়। সঙ্গত কারণেই হয়তো বেছে নিয়েছিলেন পঞ্চমকে। আনন্দ বক্সীর কথায় সুর বসানোর কাজটি করানোর ক্ষেত্রে হয়তো আরডি ছাড়া আর কারও নাম মাথায় আসেনি তাঁর। এক বন্ধুর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ আর এক বন্ধু গাইছেন ‘দিয়ে জ্বলতে হ্যায়, ফুল খিলতে হ্যায়’। ইনস্ট্রুমেন্টের কোনও আড়ম্বর নেই। যতটুকু না থাকলেই নয়, ঠিক ততটুকুই ব্যবহার করা হয়েছে। কিশোর যেন নেহাতই আপন মনে গানটি গেয়েছেন। হাতেগোনা কিছু বাদ্যযন্ত্র শুধু সঙ্গত করে গিয়েছে মাত্র। অকল্পনীয় উপস্থাপনা।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৪: কিশোরের শুধু কণ্ঠই নয়, তাঁর অভিনয় ক্ষমতাকেও গানের নেপথ্যে সুকৌশলে কাজে লাগাতেন পঞ্চম

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-১: কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়…

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৮: জীবনে উন্নতি করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আপনাকে থাকতে হবে

হোলির উৎসবে ভাং-এর নেশায় চুড় হয়ে থাকা একটি চরিত্রে রাজেশ খান্নার লিপে কিশোরের গাওয়া ‘নদিয়া সে দরিয়া’ গানটি বোধহয় পঞ্চমের অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে একটি। প্রেলুডটি গানটি শোনার জন্য একটি মুড তৈরি করে দেয় তো বটেই। পাশাপাশি অন্তরাগুলিতে ব্যবহার করা তাল এবং মাত্রাগুলি যেন অনেকটাই আলাদা। এক কথা অতুলনীয়।

মৃত্যুপথযাত্রী একটি চরিত্রের লিপে কিশোরের গাওয়া ‘ম্যায় শায়ার বদনাম’ গানটি শ্রোতাদের হৃদয়ে যে পরিমাণ আবেগ সঞ্চার করে তার কৃতিত্ব পঞ্চম, কিশোর এবং অবশ্যই আনন্দ বক্সী তিনজনই সমান ভাবে ভাগ করে নেওয়ার দাবি রাখেন। যেমন গানটির কথা, তেমন সুর এবং তেমন গায়কের উপস্থাপনা। ছবিটিতে চরিত্রটির মৃত্যু হয় ঠিকই, কিন্তু তাঁর গানটি স্বমহিমায় বেঁচে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এবং যুগের পর যুগ।

‘ডবল ক্রস’ ছবির কিশোর-আশার একটি ডুয়েট গান ‘কহে দো জামানে সে’ গানটিতে আমরা পাই পঞ্চমের সেই বহুপরচিত রিদম। এই ছবির আরেকটি গান যেটি কিশোর-ভূপিন্দেরের যৌথভাবে গাওয়া সেটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গানটি হল ‘দেখো হাম দনো কি ইয়ারি’। পঞ্চমের আবার সেই পরিচিত ছন্দ এবং সবচেয়ে প্রসংশার দাবি রাখে কিশোর কুমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভুপজির ইয়র্ডলিং। পঞ্চম ভুপিকে দিয়ে ইয়র্ডলিংও করিয়ে নিয়েছেন এই গানটিতে। বুঝুন! একই ছবির ‘ম্যায় নে তুমকো চাহা পাহেলিবার’ গানটিতেও আমরা খুজে পাই একটু অন্য কিশোরকে। অপেক্ষাকৃত স্লো রিদমের এই গানটি যেন একটু অন্যভাবে গেয়েছেন কিশোর। ছন্দটি খুব চেনা অথচ একটু যেন ধীর গতির।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৭: স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ‘সাগরিকা’

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২: “যে ‘কেবল’ পালিয়ে বেড়ায়”

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৮: বুধন উধাও

‘পাঁচ দুশমন’ ছবির ‘জিনা তো হ্যায় পর এ দিল কাঁহা’ গানটিতে মেজর এবং মাইনর স্কেল একই সঙ্গে ব্যবহারের এক অসাধারণ নিদর্শন আমাদের কানে ধরা পড়ে। গানটির সুর এবং প্যাথস দুটিই যেন একটু অন্যরকম। আর কিশোরের হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসা গানটি তাঁর প্রতিভার সাক্ষ্য বহন করে গিয়েছে গানটি জুড়ে। আসলে, কিশোর পঞ্চমের যৌথ সাফল্যের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অথবা অনুধাবন করতে গেলে তাঁদের যৌথ কর্মকাণ্ডগুলির চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়োজন। তবেই পরিষ্কার হয়ে যাবে সব কিছু। তবেই তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব।

‘মিস্টার রোমিও’ ছবির দুটি গানের কথাই যদি ধরা যায়। একটি হল ‘না সোয়েঙ্গে না সোনে দেঙ্গে’ যেটি লতা কিশোর জুটি গেয়েছেন। আরেকটি গান ‘ইয়াহা নেহি কাহুঙ্গি’ যেটি আশা-কিশোর জুটি গেয়েছেন। খেয়াল করে দেখবেন, ডুয়েট হলেও, দুটি গানের ক্ষেত্রেই কিশোর কিন্তু নায়ক শশী কাপুরের অভিনয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই গান দুটি পরিবেশন করেছেন। আগেই বলেছি, এটি কিশোরের লক্ষ্যণীয় একটি গুণ। যেটিকে যথাযতভাবে কাজে লাগিয়েছেন পঞ্চম। একবার নয়। প্রতিবার।

‘জ্যায়সে কো ত্যায়সা’ ছবির ‘চলতে চলতে পিছে মুড়কে দেখো’ গানটি সেই একই প্রমাণ তুলে ধরে আমাদের চোখের সামনে। এই ক্ষেত্রে নায়ক হলেন জিতেন্দ্র।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৭: গরমে পান্তা ভাত কি সত্যিই শরীর ঠান্ডা করে?

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৯: রাবণ-মারীচ সংবাদ এগোল কোন পথে?

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৩: বিবাহ প্রতিষ্ঠানে অবিশ্বাস কিংবা সম্পর্কে দাঁড়ি

‘আ গলে লাগ যা’ ছবির গানগুলিকে যদি আমরা ধরি, প্রত্যেকটি গান একে অপরের থেকে আলাদা কিন্তু প্রত্যেকটির সুর এবং গায়কী দুটিই অনবদ্য। ‘না কই দিল মে সামায়া’ গানটির কথা এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ক্ষেত্রেও মেজর এবং মাইনর স্কেল ব্যবহার করে অন্তরা এবং মুখরাকে নিপুণ হাতে সৃষ্টি করেছেন পঞ্চম। ফলস্বরূপ, গানের কথার মধ্যে লুকিয়ে থাকা যে বেদনা, সেটি একশো শতাংশ ফুটে উঠেছে। সুরের পাশাপাশি তুরুপের তাস সেই এক এবং অদ্বিতীয় কিশোর কণ্ঠ। ভায়োলিন, আ্যকরডিয়ান এবং ইলেকট্রিক গিটারের মূর্ছনায় গানটির প্রেলুডটিকে সাজিয়ে তোলার পর পঞ্চম জায়গা করে দিয়েছেন কিশোরকে। তারপর কিশোর যেন হয়ে উঠেছেন অপ্রতিরোধ্য।

এই ছবির ‘তেরা মুঝ সে হ্যায় পাহেলে কা নাতা কই’ গানটি কি অসাধারণ একটি সৃষ্টি একবার ভাবুনতো। ভায়োলিন এবং ইলেকট্রিক গিটারকে কাজে লাগিয়ে প্রেলুডটিকে কিছুটা দীর্ঘায়িত করে তারপর জায়গা করে দেওয়া হয় কিশোর কণ্ঠকে। যে কণ্ঠ তারপর আমাদের নির্বাক করে রাখে গানের শেষ অবধি। ঠিক সেই ছেলেবেলায় পড়া পাইড পাইপারের গল্পের মতো। এ ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ কৃতিত্বের দাবিদার সেই পঞ্চম-কিশোর জুটি।

এই ভাবে একের পর এক কালজয়ী সুরের জন্ম দিয়ে আরডি বর্মণ উঠে আসতে থাকেন খ্যাতির শিখরে। ১৯৭৩ সালটি পেশাগত ভাবে পঞ্চমের যথেষ্টই ব্যস্ততায় কাটে। ততদিনে তাঁর একটি ফ্যান বেসও তৈরি হয়ে গিয়েছে। কোনও ছবি বাণিজ্যিকভাবে সেই মাত্রায় সফল না হলেও সেই ছবির পঞ্চমের সুরারোপিত গানগুলির জনপ্রিয়তার ঘাটতি চোখে পড়ে না। বলাই বাহুল্য, ১৯৭৩ সালটি নিঃসন্দেহে পঞ্চমকে অনেকটাই সাফল্য এনে দিতে সক্ষম।—চলবে
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content