বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


কিশোর, আশা ও পঞ্চম। ছবি: সংগৃহীত।

এগোতে থাকে পঞ্চমের বিজয়রথ। তাঁর সুরের মাদকতায় আসক্ত হতে থাকে আপামর সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ। তাঁর সুর করা গানগুলি জায়গা করে নিতে থাকে তাঁদের হৃদয়ে। বিশেষ করে পঞ্চম-কিশোর জুটির কাছে তাঁদের দাবি যেন বেড়েই চলে দিনের পর দিন। বেশ বুঝতে পারছিলেন দুজনে যে, তাঁদের দায়িত্ব এখন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। অন্যদিকে শচীন কর্তা এবং মীরা দেব বর্মন দুজনেই যেন সর্বদা অত্যুৎসাহী হয়ে অপেক্ষায় থাকতেন তাঁদের একমাত্র পুত্রের পরের কাজটির জন্য। এবার নতুন কী করবেন তিনি। কোন কোন সুরের জন্ম দেবেন। কেমন হবে সেই সুরগুলি। মানুষের কতখানি ভালো লাগবে সেগুলি। সুরের মাধ্যমে শ্রোতাদের কাছাকাছি কতখানি পৌঁছতে পারবেন পঞ্চম। দু’জনে অধীর আগ্রহে সেই দিকেই তাকিয়ে থাকতেন।

তবে পঞ্চম নিজে অনেক ক্ষেত্রেই স্বীকার করেছেন একটি চরম সত্য। সেটি হল বাবার কাছে তাঁর ঋণ। তিনি সেই ছেলেবেলা থেকে সুর নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে দেখেছেন তাঁর বাবাকে। এমনকি প্রাথমিক ভাবে বাবার হাত ধরেই তাঁর সঙ্গীতের হাতেখড়ি। সঙ্গীতের অ-আ-ক-খ বাবার কাছ থেকেই শেখা। এমন একজন শিক্ষাগুরুর জন্য কোনও গুরুদক্ষিণাই হয়তো যথেষ্ট নয়। এই সহজ কথাটি হয়তো পঞ্চম নিজেও অনুধাবন করেছিলেন। তবু বাবার পথে হেঁটে পরবর্তীকালে নিজের একটি স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি করে নেওয়ার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে ছিল বাবাকে দেওয়া পঞ্চমের সর্বশ্রেষ্ট গুরুদক্ষিণা।

বাবার কাছ থেকে অর্জন করা জ্ঞান, জন্মগত সঙ্গীত মনস্কতা, নিজের প্রতিভা এবং অধ্যবসায়, শেখার চরম আগ্রহ এবং সর্বোপরি নতুন কিছু জন্ম দেওয়ার এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি। এগুলিকে সঠিক ভাবে কাজে লাগিয়ে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মধ্যে দিয়েই হয়তো পঞ্চম যথাযত ভাবে তাঁর জন্মদাতাকে স্রধ্যাজ্ঞাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সন্তানের সাফল্য যে কোনও বাবা মায়ের কাছেই তাঁদের সন্তানের কাছ থেকে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। তাই পঞ্চমের অত্যবধি যে সাফল্য, সেটি তাঁর বাবা-মা’কে যারপরনাই গর্বিত করে তুলেছিল।
আসে পরের ছবি। সাল ১৯৭৩। ছবির নাম ‘ঝিল কে উস পার’। ধর্মেন্দ্রর লিপে কিশোরের সেই বিখ্যাত গান ‘কেয়া নজারে কেয়া সিতারে’। যেখানে একটি উন্মুক্ত উদ্যানে নায়ক ধর্মেন্দ্র তাঁর দৃষ্টিহীন নায়িকা মমতাজের উদ্যেশ্যে কিশোর কণ্ঠে লিপ দিচ্ছেন। গানের একদম শুরুতে খোলামেলা পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিশোরের গলায় একটু ‘ইকো ইফেক্ট’ ব্যবহার করেন পঞ্চম। একটি মুড তৈরি করে দেওয়ার উদ্যেশ্যে প্রেলুডটিকে ভায়োলিন এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে খানিকটা দীর্ঘায়িত করেন। মূল ছন্দটিকে গানটি জুড়ে ধরে রাখে একটি তবলা। আর ইন্টারলুডগুলিকে সাজানো হয় বাঁশি, সন্তুর, ১২ স্ট্রিং গিটার দিয়ে। কোথাও কোনও ফাঁক কানে ধরা পড়ে না। গানটি যখন এক সময় মিলিয়ে যায়, তখন মন যেন সেটি আরও একটিবার শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সুরের আবেদন এতটাই।

‘বন্ধে হাত’ ছবির ‘দেখো ইয়ে মেরে বন্ধে হাত’ গানটির কথাই যদি ধরা যায়, কিশোরের কি অসাধারণ উপস্থাপনা। সুরের মধ্যে অসাধারণ কিছু মডিউলেশন কানে ধরা পরে যেগুলিকে কিশোর তাঁর গায়কীর মাধ্যমে যথাযত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

এর পর আসে ‘হীরা পান্না’ ছবিটি। কিশোরের সঙ্গে বেশিরভাগ গানই ভাগ করে নেন লতা এবং আশা। ‘বহত দুর মুঝে চলে যানা হ্যায়’ অথবা ‘পান্না কি তামান্না’ গান দুটির ক্ষেত্রে কিশোর এবং লতা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন। আর গানদুটির সুর? সে দুটি যেন মা সরস্বতী স্বপ্নে উপহার দিয়েছিলেন পঞ্চমকে। তাই ঢেলে সাজিয়েছিলেন নিজের মনের মতো করে। একটু খেয়াল করে দেখবেন, যখন আপনি এই দুটি গান মনে মনে গুনগুন করছেন, তখনও যেন ভেসে আসে গানটিতে ব্যবহার করা বাদ্যযন্ত্রগুলির সুমধুর শব্দ, প্রে লুড, ইন্টারলুড সব যেন নির্ভুল ভাবে একে একে মনে পড়তে থাকে। দুটি গানের ক্ষেত্রে যে ভিন্ন দুটি ছন্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেই দুটির প্রসংশার ভাষা খুজে পাওয়া সত্যিই বড় কঠিন। এই ছবির আরেকটি গান ‘এক পহেলি হ্যায় তু’ কিশোরের সঙ্গে গাওয়ানো হয়েছে আশাকে দিয়ে শুধু দৃশ্যপটের কথা মাথায় রেখে। নায়িকার খুনসুটিগুলি বিশেষভাবে প্রতিফলিত করতে পঞ্চম বেছে নিয়েছিলেন আশা কণ্ঠকে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৩: ‘ওই দেখ, রাহুল দেব বর্মণের বাবা হেঁটে যাচ্ছেন’

দশভুজা: তিনি ‘অরণ্যের বিশ্বকোষ’, ৭৯ বছর বয়সেও পরিবেশ সংরক্ষণে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন তুলসী

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৫: যখন ‘ওরা থাকে ওধারে’

আসলে খুব ছোট ছোট কিছু ব্যাপারেও পঞ্চম যথেষ্ট খুঁতখুঁতে ছিলেন। শুধু ছবির ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা মাথায় রেখে চটকদার সুর রচনা করে প্রযোজক পরিচালকদের খুশি রাখার ব্যাপারটিকে তিনি সেইভাবে কোনওদিনই গুরুত্ব দেননি। ‘দেয়ার ইস নো শর্ট কাট টু সাকসেস’ প্রবাদটি পঞ্চম এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছিল।এবং এটির প্রধান কারণ তাঁর বাবা স্বয়ং। তাই যেকোনও সুর রচনার ক্ষেত্রে অনেক কিছু একসঙ্গে মাথায় রাখতেন। দৃশ্যটি কি, কোথায় শুট করা হবে, ইনডোর না আউটডোর, নায়ক নায়িকা কারা, গানটি নায়ক বা নায়িকা (অথবা দু’ জনেই) কীভাবে লিপ দেবেন-অর্থাৎ, হেঁটে, দৌড়ে না কোনও চলমান গাড়ির মধ্যে থেকে নাকি ছুটন্ত ঘোড়ার উপর থেকে।

এমনকি দিনের কোন সময়ে শুট করা হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে দিনের সেই সময়ের রাগ ব্যবহার। এতো রকমের গবেষণার পর জন্ম নিত একটি গান। বারবার শুনতেন সেটি। সতীর্থদেরও শোনাতেন। এতো কিছুর পরেও অনেক ক্ষেত্রে নিজের কানে যদি কোনও ত্রুটি ধরা পড়ত, সেটিকে শুধরে নিয়ে আবার রেকর্ডিং করতেন। শুধু তাই নয়, প্রযোজক, পরিচালক, নায়ক এবং নায়িকাদেরও শোনাতেন। তাঁদের দেওয়া কোনও পরামর্শকে যদি সঠিক বলে মনে হতো, সেই মতো সুরের পরিবর্তন করে সেটিকে আরও কয়েকবার শুনতেন। তারপর শুরু হতো ফাইনাল রেকর্ডিং। এছাড়াও ‘হিফাজত’ ছবির কিশোরের গাওয়া ‘জানে জাহা রুঠা না কারো’ গানটি একটু আপ-টেম্পোতে তৈরি করা হয়েছে, দৃশ্যের কথা মাথায় রেখে। শুনে দেখবেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

একটু ভেবে দেখুন। প্রেম চোপড়া কিশোর কুমারের কণ্ঠে লিপ দিচ্ছেন। তাও একটা গোটা গান জুড়ে। হ্যাঁ। ঠিকই বলছি। ‘নফরত’ ছবির একটি গানের দৃশ্যে সেইটাই সম্ভব করেছেন পঞ্চম। গানটি হল ‘রাহো মে কালিয়া খিলাকে ইয়ার’। একটি চলমান রেল গাড়ির মধ্যে রেলের গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে গানটির সুর তৈরি করেন পঞ্চম। আর প্রেম চোপড়ার ব্যাক্তিত্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গানটি অসম্ভব সুন্দর ভাবে উপস্থাপনা করেন কিশোর।

একই ছবির ‘মেরে ইয়ার দিলদার’ গানটিতে নায়ক নায়িকার খুনসুটিকে সঠিক ভাবে তুলে ধরতে আবারও পঞ্চম ব্যবহার করেন কিশোর এবং আশা কণ্ঠ। রাকেশ রোশন এবং যোগিতা বালির প্রাণোচ্ছলতাকে প্রতিফলিত করার ব্যাপারে গায়ক গায়িকা জুটি এই গানে একশো ভাগ সফল।

এখানে একটি বাস্তবকে হয়তো আমাদের মানতেই হবে। সেটি হল, পঞ্চমের সুরে কোনও গান কিশোর একাই গান বা কারও সঙ্গে ডুয়েটে গান, দুটি ক্ষেত্রেই কিন্তু কিশোরের অভিনবত্ব আমাদের কানে ধরা দেয়। কারণ, কিশোরের কণ্ঠই শুধু নয়, তাঁর অভিনয় ক্ষমতাকেও গানের নেপথ্যে সুকৌশলে কাজে লাগাতেন পঞ্চম। তাই গানটি চলাকালীন নায়কের দুঃখ, হতাশা, আনন্দ, উচ্ছাস, প্রেম আরও স্পষ্ট হয়ে উঠত আমাদের কাছে। আজও ওঠে, যখন গানগুলি সিনেমা অথবা ইউটিউব এ আমরা দেখি। নায়কের অভিব্যক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিশোরের গায়কী, ব্যাপারটিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতেন পঞ্চম।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭: ঝুঁকি না নিলে জীবনে বড় কিছুই অর্জন করা যায় না

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৫: চেয়ারে বসতে গিয়ে নজর গেল বিছানায়, দেখি সেই পুতুলের সবুজ চোখ দুটো আমাকে দেখছে

পরের ছবি ‘বড়া কবুতর’। এই ছবির ‘হায় রে হায় রে’ গানটি যদি খুব ভালো করে শোনেন দেখবেন খুব খুব কম ইনস্ট্রুমেন্ট কাজে লাগিয়েছেন পঞ্চম। গম গম করছে কিশোরের গলা এবং তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আশার কণ্ঠ। অব্লিগেটো তো আছেই এবং এই গানের দুটি অংশে কিশোর-আশাকে দিয়ে হার্মোনাইজও করিয়েছেন পঞ্চম। অর্থাৎ বলা যায়, আবার সেই সলিল চৌধুরী ইফেক্ট। সলিল বাবুর সুরারোপিত বহু গানে আমরা ‘হার্মোনাইজেশন’ ব্যাপারটি খুজে পাই। প্রসঙ্গত বলি, যখন কোনও গানের একটি লাইনকে (সেটি যে স্কেলেই থাক) যদি একজন গায়ক ‘হায়ার অক্টেভ’ এ গান এবং একই সময় আরেকজন গায়ক সেই একই লাইনটিকে ‘লোয়ার অক্টেভ’ এ গান তখন সেটিকে হার্মোনাইজেশন বলা হয়ে থাকে। এটি পাশ্চাত্য থেকেই মূলত শিখেছি আমরা। আর পাশ্চাত্য সঙ্গীতের একজন প্রবল এবং একনিষ্ঠ অনুরাগী সলিলবাবু তাঁর বহু গানে এটিকে ব্যবহার করেছেন।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে ‘সুরেরও এই ঝড় ঝড় ঝর্না’ অথবা ‘মর্জিনা আবদুল্লা’ ছবির ‘ও ভাই রে ভাই’ গান দুটির কথা। অসম্ভব দক্ষ হাতে সলিলবাবুর তৈরি দুটি গান। প্রথমটি গেয়েছিলেন তাঁর সহধর্মিণী সবীতা চৌধুরী এবং পরেরটি গেয়েছিলেন কালজয়ী শিল্পী মান্না দে। দুটি গানের ক্ষেত্রেই সহশিল্পীদের দিয়ে হার্মোনাইজ করিয়েছেন চৌধুরী মহাশয়। আর আগেই বলেছি, সলিল চৌধুরীকে গুরু মানতেন পঞ্চম। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন পঞ্চমের অনুপ্রেরণা। তাই ‘বড়া কবুতর’ ছবির ‘হায় তে হায় রে’ গানটিতে সেই অনুপ্রেরণারই একটি নিদর্শন আমরা দেখতে পাই।—চলবে
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content