রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


পিতা-পুত্র। ছবি: সংগৃহীত।

পঞ্চম যে এতদিনে নিজের একটি সতন্ত্র জায়গা তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন সেটি তিনি উপলব্ধি করতে পারেন একদিনের একটি ঘটনা থেকে।যে ঘটনার কথা আমরা জানতে পারি তাঁরই একটি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে।

শচীন দেব বর্মন স্বাস্থ্য রক্ষার খাতিরে সেই সময় নিয়ম করে প্রতিদিনই প্রাতঃভ্রমণে বেরোতেন। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি ফিরে এসে পঞ্চমকে প্রাতভ্রমণে না বেরোনোর জন্য তিরস্কার করতেন। এটি ছিল পঞ্চমের জীবনের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তাই পঞ্চম সেই তিরস্কারে কর্ণপাত ও করতেন না। কিন্তু একদিন একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফেরেন শচীন কর্তা। কিন্তু সেদিন তাঁকে দেখে খুব খুশি বলে মনে হয়।পঞ্চমকে তিরস্কার তো দূরের কথা, সটান চলে যান স্ত্রী মীরার কাছে। পঞ্চমও স্বাভাবিক কারণেই খুবই অবাক হন। তাঁর কানে আসে মাকে বলা বাবার কিছু কথা।

শচীন কর্তা মীরা দেব বর্মণকে বলেন, সেদিন যখন তিনি রাস্তায় হাঁটছিলেন, জনাকয়েক লোক নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন এই বলে যে ‘ওই দেখ, রাহুল দেব বর্মণের বাবা হেঁটে যাচ্ছেন’। এই ঘটনাটি শচীন কর্তাকে নতুন করে নাড়া দেয়।তিনি যথার্থই অনুধাবন করেন যে, তাঁর সেই ছোট্ট টুবলু এখন আর শুধু বাবার পরিচয়ে পরিচিত নয়। সেই পরিচয় ছাপিয়ে সে নিজের একটি পরিচয় তৈরি করে ফেলেছে। সম্পূর্ণ নিজগুণে। হাসি ফোটে মীরার মুখে।সেদিন মীরাও হয়তো নিজের অশ্রুসিক্ত চোখ দিয়ে শচীনকর্তার চোখে জড়ো হওয়া আনন্দস্রু লক্ষ্য করেছিলেন। সেদিনই হয়তো পঞ্চম মনে মনে আরও বড় কোনও সংকল্প নিয়ে ফেলেন।

বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বলতর করার কোনও বিশেষ তাগিদ হয়তো অনুভব করেন নতুন করে। বেশ বুঝতে পারেন যে, এবার থেকে তাঁর দায়িত্ব আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
১৯৭৩ সাল। প্রায় সারা বছরের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন পঞ্চম।একের পর এক ছবিতে খুব স্বাভাবিক কারণেই ডাক পেতে থাকেন। নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকেনা। আসে ‘শরিফ বদমাশ’ ছবিতে কাজের সুযোগ। দেবানন্দ প্রযোজিত এই ছবিতে আবার বেছে নেওয়া হয় কিশোর কুমারকে। আবারও আনন্দ বক্সির লেখা গানে সুরারোপ করেন পঞ্চম। আর বিশেষ করে কিশোরের জন্য তৈরি করেন দুটি গান। ‘তেরে শ দিওয়ানে’ এবং ‘ম্যায় নিকাল জাউঙ্গা’।আর ‘নিন্দ চুরাকে রাত ওমে’ (কিশোর আশা ডুয়েট) গানটি তৈরি করেনশুধু নায়ক নায়িকার কথা মাথায় রেখেই নয়, গানের প্রেক্ষাপটের কথাও মাথায় রেখে।

হেমা মালিনী এবং দেবানন্দ পাহাড়ঘেরা একটি সুবজ মাঠে হেঁটে হেঁটে ঘুরছেন আর গানটিতে লিপ দিচ্ছেন। তাই গানের টেম্পো একদমই বাড়াননি পঞ্চম। কারণ সেটি বাড়িয়ে দিলে হাঁটার গতির সঙ্গে সেই ছন্দ একেবারেই খাপ খাবেনা।দ্বিতীয়ত, দেবানন্দ এর হাঁটার যে স্বভাবসিদ্ধ, চিরপরিচিত ভঙ্গি, তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই কিশোরের উপস্থাপনা। আর একই ভাবে হেমা ঠোঁট মিলিয়েছেন আশাবাইয়ের গলায়। আরসুর? সার্বিকভাবে সেটি অনবদ্য।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১২: হঠাৎ স্নানঘর থেকে পঞ্চমের চিৎকার ‘মিল গয়া মিল গয়া’, সৃষ্টি হল সেই জনপ্রিয় গান ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৬: আবার নুনিয়া

‘অনামিকা’ ছবির ‘মেরি ভিগি ভিগি সি’ গানটির সুর তাঁর নিজেরই গাওয়া ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ গানটি থেকে নিয়েছেন পঞ্চম। কিশোর কণ্ঠে যেন আরও বেশি মাত্রায় আলোকিত হয়েছে গানটি। সঞ্জিব কুমারের লিপে এই গানটি এক প্রতারিত প্রেমিকের সুগভীর বেদনাকে যেন যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। কিশোর পঞ্চম জুটি আবারও একশভাগ সফল।

‘রিকশাওয়ালা’ ছবির ‘কই তরাহকি হাসি হতি হ্যায়’ গানটিতে চোখে পড়ে পঞ্চমের সুরের বৈচিত্র্য, কিশোর কণ্ঠের অভিনয় এবং একটি অসামান্য গানকে সাধারণভাবে শ্রোতাদের কানে পৌঁছে দেওয়ার পারদর্শিতা। ইন্টারলুড গানের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় ‘আপ টেম্পো’। কিন্তু কিশোর যেই গানটি শুরু করছেন, গানটি ফিরে আসছে তার নিজস্ব ছন্দে। সেই যুগে সাহস করে এই ধরনের গবেষণা (তাও আবার বাণিজ্যিক ছবিতে) বোধহয় পঞ্চমের পক্ষেই সম্ভব ছিল।একই ছবির আরও একটি গান ‘ম্যায়নে কাহা জিদ ছড়দে’। দেখবেন, গানটির দৃশ্যায়ণ যেভাবে করা হয়েছে, সেখানে নায়ক অথবা নায়িকা কাউকেই খুব একটা নড়াচড়া করতে অথবা দৌড়তে দেখা যায় না। অথচ গানের টেম্পোটি খেয়াল করুন। সেটি যেন নায়ক নায়িকার গতিকে অনেক পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় বহু দূরে। লতা-কিশোর অনবদ্য।

‘ফুলো কি দুনিয়া সে তারও কি দুনিয়া মে’ গানটিও একই ভাবে সাড়া ফেলে সেই সময়। এই গানের ছন্দটিও উপরোক্ত গানটির মতো অনেকটাই গতিময় তবু তার তুলনায় নায়ক নায়িকা যেন একটু শিথিল। আরও একটি অভিনবত্ব হল, শুনে দেখবেন, গানের প্রথম দুটি ইন্টারলুডের ছন্দ এবং গানের ছন্দ সম্পূর্ণ ভিন্ন। অথচ দুইয়ের মধ্যেই একটি গভীর যোগাযোগ আশ্চর্যজনক ভাবে পরিলক্ষিত হয়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৭: গরমে পান্তা ভাত কি সত্যিই শরীর ঠান্ডা করে?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’

‘ইয়াদো কিবারাত’ এর কথায় যদি আসি, সেই সময় তুমুল সাড়া ফেলে দেয় ছবিটি।নাসির হোসেনের ছবি। তাই পঞ্চম যেন অতিরিক্ত যত্ন নেন এই ছবির গানগুলির সুর রচনার ক্ষেত্রে। মাজরুহ সুলতানপুরিকে সঙ্গে নিয়ে বসেন।গানগুলি নিয়ে চর্চা চলে বেশ সময় নিয়ে। প্রতিটি গানের প্রেক্ষাপট গভীর ভাবে বুঝতে চেষ্টা করেন। তারপর সুলতানপুরি সাহেবের লেখাগুলিকে প্রাণদান করেন নিজের সুরের মাধ্যমে। ‘আপ কে কামরে মে কই রহেতা হ্যায়’ গানটি তৈরি হয়। যে গানটিতে কিশোর এবং আশার সঙ্গে গলা মেলান পঞ্চম স্বয়ং। শুনে দেখবেন, গানটিতে তিনটি অংশ আছে। তিনটি অংশের ছন্দ গুলি তিনটি ভিন্ন ধাঁচের। অংশগুলি একের পর এক চলে এসেছে অনেকটাই আজকের দিনের ‘মেডলে’র মতো করে। ভাবতে পারেন?

মেডলে, তাও আবার ১৯৭৩সালে! একজন সুরকার কতোটা আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ হলে সেই যুগে এমন কথা ভাবা এবং সেই ভাবনাটিকে সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করা সম্ভব। আর এর সঙ্গে রয়েছে আবার সেই কণ্ঠের মাধ্যমে নির্ভুল অভিনয়। নিশ্চই বলে দিতে হবেনা কার কথা বলছি। হ্যাঁ, তিনি কিশোর কুমার।‘ লেকার হাম দিওয়ানা দিল’ গানটির কথা ভাবুন। বঙ্গ, ইলেকট্রিক গিটার, ভায়োলিন, পারকাসান, যত আধুনিকভাবে সম্ভব ব্যবহার করা হয়েছে। তার সঙ্গে কিশোর এবং আশার সঙ্গীত পরিবেশনা শ্রোতাদের আজও এক-সমুদ্র উত্তেজনায় ডুবিয়ে রাখে। এই গানের বয়স বাড়ে না। এই ছবির ‘মেরি সনি মেরি তামান্না’ গানটি আরও একটি যুগান্তারী সৃষ্টি। সুরের ভেরিয়েশন, তাল, মাত্রা, পরিচিত অব্লিগেটো আর কিশোর এবং আশার প্রাণোচ্ছল কণ্ঠ। সব কিছু একত্র হয়ে জন্ম দেয় এক চিরসবুজ গানের।

মজা করে বলতে গেলে, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যদি কোনও প্রেমিক তার প্রেমিকার মান ভাঙাতে চায়, সে নির্দ্বিধায় এই গানটির আশ্রয় নিতে পারে। সুফল সে পাবেই। আর এই ছবির টাইটেল সং অর্থাৎ ‘ইয়াদো কি বারাত’? কি অসাধারণ মেলোডি।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: পিকনিক দল থেকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু: তাঁর লেন্সের বিস্তৃতি ছিল বিস্ময়কর

চলো যাই ঘুরে আসি: অযোধ্যা—প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রাণকেন্দ্র/১

মাইনর স্কেল দিয়ে শুরু হয়ে মেজর স্কেলে গিয়ে আবার মাইনর স্কেলে ফিরে আসে গানটি। সেটিশোনার সময় কেউ নস্টালজিক হয়ে পড়েননি, অথবা ফেলে আসা দিনগুলি স্মৃতিরপাতা থেকে উঠে আসেনি, কিংবা শৈশবের খুব ছোট ছোট ঘটনা মনের কোণে উকি দেয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বোধহয় অসম্ভব। কিশোর এবং রফি সাহেবের গলার আবেগ পঞ্চমের সুরে মিশে গিয়ে গানটিকে যেই মাত্রায় আবেগঘন করে তুলেছে তাতে যে কেউ পিছনে ফিরে তাকাতে বাধ্য।

পিছনে ফেলে আসা দিনগুলির আনন্দ, দুঃখ, প্রেম, হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়, বন্ধু, সবুজ মাঠ, পড়ন্ত বিকেল, ভোরের শিশির, কোকিলের ডাক, জোনাকির আলো সব যেন এক নিমেষে তরতাজা হয়ে ওঠে। সব কিছুর নেপথ্যে বসে পঞ্চম যেন আমাদের মনে করিয়ে দেন যে মানুষকে স্মৃতি নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। সেটি শুধু রোমন্থনের জন্য। আমাদের ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্মৃতির দর্পণগুলি থেকে বিস্মৃতির ধুলো মুছে দিয়ে সেগুলিকে স্পষ্ট করে তোলে পঞ্চমের এই সৃষ্টি।এই গানটি যেন যে কোনও বিস্মৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর।—চলবে
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content