রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


যতই তুফান আসুক, জীবন থেমে থাকে না। জীবন এগিয়ে চলে প্রকৃতির নিয়মেই। একই ভাবে পঞ্চমও নিজেকে ধীরে ধীরে সামলে নিয়ে এগিয়ে চলতে থাকেন তাঁর সুরসৃষ্টির পথে। বৈবাহিক জীবন থেকে পাওয়া বেদনা পঞ্চমের শিল্পসত্তার সঙ্গে মিশে গিয়ে তাঁর সৃজনশীলতাকে যেন আরও ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে। এটি হয়তো যেকোনও প্রকৃত শিল্পীর ক্ষেত্রেই সত্যি। রীতার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আমরা পেতে শুরু করি এক অন্য পঞ্চমকে। তার প্রতিফলনই হয়তো পাওয়া যায় ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘পরিচয়’ ছবির, ‘মুসাফির হু ইয়ারোঁ’ গানটিতে।

‘মুসাফির হু ইয়ারোঁ’ গানটি দিয়েই পঞ্চম-গুলজার জুটির যাত্রা শুরু। গুলজার সাহেবের লেখা এই গানটির সঙ্গে কোথাও হয়তো পঞ্চম নিজের জীবনের কোনও মিল খুজে পেয়েছিলেন। তাই এই গানটির জন্য যে সুর তিনি রচনা করেন সেটির মধ্যে কোথাও যেন ছিল এক অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা। বলিপাড়ায় শোনা যায়, পঞ্চমের সেই দিনগুলি বেশিরভাগ সময়ই হোটেলে হোটেলে কাটত। হোটেলের ঘরের নিস্তব্ধতা আর এক অপরিসীম একাকিত্বই হয়তো পঞ্চমকে একটু একটু করে আরও পরিণত হতে সাহায্য করেছিল। এও শোনা যায়, গানটির জন্য সুর রচনা করার পর আরডি মধ্যরাতে নিজে গাড়ি চালিয়ে গুলজার সাহেবের বাড়িতে পৌঁছন। তাঁকে তিনি নিচে আসতে বলেন। গুলজার সাহেব নিচে এলে তাঁকে গাড়িতে বসিয়ে পঞ্চম বম্বে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকেন এবং গানটি তাঁকে বারবার শোনাতে থাকেন।
বলা বাহুল্য, গুলজার সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অসম্ভব অভিভূত হয়েছিলেন এবং পঞ্চমের অনেক প্রসংশাও করেছিলেন। শুধু এই গানটিই নয়, এই ছবির ‘বিতি না বিতাই রায়না’ গানটি শোনামাত্র আমাদের মনের গভীরে আজও যে আবেগ সঞ্চারিত হয়, তার কৃতিত্ব হয়তো অনেকাংশে পঞ্চমের। গুলজার সাহেব রচিত ওই গানটির সঙ্গে পঞ্চমের ওই সুর যেন রাজযটক। কথা এবং সুর যেন একে অপরের পরিপূরক। এই একই ছবির আরও একটি গানের কথা না বললেই নয়। সেটি হল শিশুদের জন্য রচিত ‘সারে কে সারে গামা কো লেকার গাতে চলে’ গানটি। এই ছবির একটি বেড়াতে যাওয়ার দৃশ্যে জয়া ভাদুড়ি এবং জিতেন্দ্রর লিপেআশা এবং কিশোরের এই গানটি আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। যে গানটিকে আরও শ্রুতিমধুর করে তুলেছে শিশুশিল্পীদের গলায় কোরাসের এর অংশগুলি। শিশুদের জন্য সুর রচনা করতে গেলে হয়তো মনটাকেও শিশুদের মতোই নির্মল রাখতে হয়। পঞ্চম সেই নিদর্শন অনেকবারই রেখেছেন।
এই প্রসঙ্গে বলি, ‘দার্জিলিং যাত্রা’ গানটির কথা একবার ভাবুন তো! সেই যুগের প্রযুক্তি আজকের মতো উন্নত না হওয়া সত্ত্বেও কি অবলীলায় শিশুকণ্ঠগুলি তৈরি করা হয়েছিল। পঞ্চম নিজে গেয়েছিলেন এই বাংলা গানটি। আর শিশুকণ্ঠ হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিল সেই সময়ের অতি সাধারণ প্রযুক্তির কিছু কারিকুরি। আরও একটি শিশুদের জন্য তৈরি গুলজার সাহেব রচিত মজার গান ‘আ আ ই ই মাস্টার জি কি আ গেই চিটঠি’, যার এক অভিনব সুর রচনা করেন পঞ্চম। গানটি ১৯৭৭ সালে ‘কিতাব’ ছবির জন্য তৈরি করা হয়। কি অসাধারণ উপস্থাপনা।

১৯৮৩ সালে ‘মাসুম’ ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ গানটি মনে পড়ে? আজকের দিনের ইন্টারনেট, মোবাইল-গেম এবং কার্টুনের যুগেও যে কোনও শিশুকে এই গানটি আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। এটাই তো আরডির জাদু। পরিণত বয়সে এসেও নিজের মনের বয়সকে বাড়তে না দেওয়ার এগুলিই হয়তো শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪: পঞ্চমকে সিনেমা হলে বসিয়েই বেরিয়ে যান রীতা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৯: সুরের আকাশে ঘটালে তুমি স্বপ্নের ‘শাপমোচন’

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়

যদি আর একটু পিছিয়ে আসা যায়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে।সেই বছর মুক্তি পায় শক্তি সামন্ত প্রযোজিত এবং পরিচালিত ছবি ‘কাটি পতঙ্গ’। এই ছবির ‘মেরা নাম হ্যায় শবনম’ গানটির অভিনবত্ব কোথায় জানেন? এই গানটি আশা একটি গল্প বলার ছলে গেয়ে গিয়েছেন। নেপথ্যে যে সংগীত বেজে চলেছে তার সঙ্গে গানের যেন কোথাও কোনও সম্পর্ক নেই। তবু আশার উপস্থাপনার সঙ্গে নেপথ্যে বেজে চলা সঙ্গীতের কোথাও যেন একটি সুসংযোগ রয়ে গিয়েছে গোটা গানটি জুড়ে। এটাই পঞ্চমের অভিনবত্ব।

প্রথাগত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নতুন কিছু তৈরি করে শ্রোতাদেরকে উপহার দেওয়ার প্রচেষ্টা। এই অভিনবত্বই হয়তো পঞ্চমকে সবার থেকে একটু হলেও (হয়তো অনেকটাই) আলাদা করে রাখে। আজও। একই ছবির ‘পেয়ার দিওয়ানা হোতা হ্যায়’ গানটির কথা নতুন করে উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। একটি গ্র্যান্ড পিয়ানোর সামনে বসে মেগাস্টার রাজেশ খান্না লিপ দিচ্ছেন কালজয়ী এবং কিংবদন্তি শিল্পী কিশোর কুমারের কণ্ঠে। নেপথ্যে পঞ্চমের সৃষ্টি করা সুরে এবং ছন্দে সুসজ্জিত সেই গান। এবং গানের শুরু থেকে শেষ অবধি বেজে চলা রেসো-রেসো গানটিকে এক অন্য স্তরে নিয়ে গিয়েছে। শুধু এটাই কেন? ‘ইয়ে শাম মাস্তানি’ র আবেদনটির কথা একবার ভাবুন তো! রাজেশ খান্নার মতো একজন প্রাণোচ্ছল নায়কের কথা মাথায় রেখে কি অসাধারণ সুরই না সৃষ্টি করেছিলেন পঞ্চম।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৩: বাইগা বস্তি হয়ে ভোরামদেব মন্দির

দশভুজা: দু’শো বছর আগে হলে তিনি ইঞ্জিনিয়ারের বদলে সতী হতেন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৩: সারাদিন যত পারেন জল খান! এতে শরীরের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না তো? কী করে বুঝবেন?

১৯৭২ সালে মুক্তি পায় ‘অমর প্রেম’। এ যেন একটু অন্য পঞ্চম। ‘রয়না বিত যায় শাম না আয়’ গানটির বিন্যাসের কথা একটিবার ভাবুন। জানা যায়, রাগ টডি এবং খামাজ —এই দুই রাগে মিলে এই সুরের জন্ম। আর জন্মদাতা সেই পঞ্চম। আর প্রয়াত সনামধন্যা লতা মঙ্গেশকর যেন কণ্ঠ দিয়ে একটি ছবি এঁকে গিয়েছেন এই গানটির মাধ্যমে। যতবার শোনা যায়, ততবারই এই গানটিকে যেন নতুন বলে মনে হয়। জানা যায়, এই গানটির প্রথম লাইনটি পঞ্চম নিয়েছিলেন সচিন কর্তার গাওয়া একটি বাংলা গান ‘বেলা বয়ে যায়’-র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। সারেঙ্গী, সন্তুর, তবলা, গিটার সব কিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে এই গানে। এক অপরিসীম মাতৃস্নেহ প্রকাশ পায় ‘বড়া নটখট হ্যায় য়ে কিষান কানহাইয়া’ গানটিতে। কি মিষ্টি সুর ভাবুনতো! এই সুরটি যেন পঞ্চম রচনা করে গিয়েছেন পৃথিবীর সব মায়েদের জন্য। এই সুরটির ওপর যেন শুধু মায়েদের অধিকার।
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: ঘি খেতে ভালোবাসেন? ঘিয়ের এই ১০টি গুণ জানতেন?

সকালে উঠে এক কাপ চায়ে চুমুক না দিলে সকালটাই শুরু হয় না? এর ফলে শরীরের কী ক্ষতি হচ্ছে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮: ‘বাইরে বেরুলেই বিপদ!’

তবে এই ছবির পঞ্চম-সুরারোপিত প্রথম গান ‘ডোলি মে বিঠাইকে কাঁহা’, যেটি গেয়েছিলেন শচীন কর্তা স্বয়ং, সেটির সুরের কিছু পরিবর্তন ঘটান তিনি। পঞ্চমকে তার কারণগুলিও বুঝিয়ে বলেছিলেন শচীনদেব। মাটির গন্ধ মাখানো কি অসামান্য একটি গান। এই ছবির ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে’ গানটি রাগ খামাজ থেকে গিয়ে রাগ কলাবতীতে মিশে গিয়েছে। রাগ রাগিণীর উপর কতটা প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা থাকলে এমন একটি গবেষণা সাফল্যের সঙ্গে করা সম্ভব সেটি আপনারাই নির্ণয় করবেন। ‘চিঙ্গারি কই ভরকে’ গানটিতে রাগ ভৈরবীকে যে ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেটি যেন পঞ্চম এর পক্ষেই সম্ভব।

১৯৭১ সালে মুক্তি পাওয়া আরও বেশ কিছু ছবির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ক্যারাভান, পারায়া ধন, বুদ্ধা মিল গয়া প্রভৃতি। ক্যারাভান ছবির ‘পিয়া তু আব তো আজা’ গানটিতে পঞ্চম নিজের নিশ্বাস-প্রশ্বাসকে যে ভাবে ফিলারের কাজে লাগিয়েছেন সেটি হয়তো আর কেউ সাহস করে করবেন না। নিজের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের উপর কি অসামান্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। সেই যুগে এটি ছিল যে কারও ভাবনার অতীত। পঞ্চম কিন্তু ফিলার হিসেবে কোনও বাদ্যযন্ত্রকে ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। এখানেই তিনি অনন্য।
পারায়া ধন ছবির ‘আজ উনসে পহেলি মুলাকাত হোগি’ গানটির কথাই যদি ধরি। নায়ক রাকেশ রোশন একটি ঘোড়ায় চেপে ছুটে চলেছেন তার প্রেয়সীর সঙ্গে দেখা করতে। সেই ছুটন্ত ঘোড়ার যে ছন্দ তার সঙ্গে যেন অদ্ভুতভাবে খাপ খেয়ে যায় এই গানটি। ইন্টারলুড শুরু হয় বাঁশি, মাউথ-অর্গান আর গিটার দিয়ে এবং তারপরই গানটিকে ছন্দপ্রদান করে কঙ্গো এবং সমান ব্যবধানে বেজে চলা মাদল। মাদলটি বাজিয়েছিলেন পঞ্চমের সংগীতসভার একজন মহামূল্যবান রত্ন যাকে আমরা ‘কাঞ্চা’ নামে চিনি। যাঁর আসল নাম রণজিৎ গজমের। গানটির ইন্টারলুডে নারীকণ্ঠে কোরাস গানটিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।

লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া...

বুদ্ধা মিল গয়া ছবির ‘রাত কলি এক খোয়াব মে আয়ি’ গানটির অভিনবত্ব কিশোর কুমারের কণ্ঠে তো বটেই, একই ভাবে পঞ্চমের সুরেও লুকিয়ে আছে। ছন্দ ধরে রেখেছে আকস্টিক স্প্যানিশ গিটার, তবলা আর রেসো-রেসো আর প্রায় গোটা গানটি জুড়ে ভায়োলিনে বেজে চলা অব্লিগেটো।

১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া একটি ছবি ‘দি ট্রেন’ এর ‘গুলাবি আঁখে জো তেরি দেখি’ গানটির কথাও এখানে উল্লেখ্য। স্বর্গীয় মহম্মদ রফির কণ্ঠে এই গানে লিপ দিয়েছেন সেই রাজেশ খান্না। ভাবুন তো! এই গানটিতে রাজেশ খান্নার সঙ্গে রফি সাহেবের কণ্ঠকে কোথাও বিন্দুমাত্র বেমানান বলে মনে হয়নি। তার প্রধান কারণ হয়তো পঞ্চম। গানটির সুর রচনা থেকে শুরু করে গানটির বিন্যাস, সবকিছুতেই এক অভিনবত্বের নিদর্শন পাওয়া যায়।—চলবে
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content