শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


পঞ্চম পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে থাকেন সুরসৃষ্টিতে। এবার আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যখন ১৯৬৬ সালে বিজয় আনন্দ (গোল্ডি আনন্দ) পরিচালিত এবং নাসির হোসেন প্রযোজিত ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছবির সংগীত পরিচালনার ডাক আসে। শাম্মি কাপুর এবং আশা পারেখ অভিনীত এই ছবির গানগুলিতে পঞ্চম যেন নিজেকে উজাড় করে দেন। ‘ও মেরে সোনা রে’, ‘ও হাসিনা যুলফাওয়ালি জানে যাহা’, ‘দেখিয়ে সাহেবও’, ‘তুমনে মুঝে দেখা’, ‘আজা আজা মে হু প্যার তেরা’, ‘মে ইনপে মরতা হু’, ‘দিওয়ানা মুঝসা নেহি’ গানগুলি এই প্রথম পঞ্চমকে তুলে নিয়ে আসে খ্যাতির শিখরে। আরডি-র সঙ্গীতের এই নতুন ধারা শ্রোতাদের যেন সম্মোহিত করতে শুরু করে। লোকের মুখে মুখে ফিরতে থাকে পঞ্চমের নাম।
তবে সেটা শচীন দেব বর্মনের পুত্র হিসেবে নয়, রাহুল দেব বর্মন হিসেবেই। এই প্রথমবার বাবার ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ছবির মিউজিক সিটিং থেকেই নবীন গিটারিস্ট ভানু গুপ্তর সঙ্গে পঞ্চমের সম্পর্ক পাকাপাকি ভাবে তৈরি হয়। প্রয়াত ভানু গুপ্তর পঞ্চমের সঙ্গে স্থায়ী ভাবে পথ চলা শুরু ‘তিসরি মঞ্জিল’ থেকেই। ‘দেখিয়ে সাহেবো’ গানটিতে ভানু গুপ্তর অবদান অনেকখানি।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৭: অ্যাকোয়াপোনিক্স প্রযুক্তির প্রয়োগে উৎকৃষ্টমানের মাছ এবং গাছ বেড়ে উঠতে পারে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২: রামকথার পটভূমি এবং মহাভারতে কথকের কথাসূত্র

‘তিসরি মঞ্জিল’ ছবিটি ছিল পঞ্চমের অগ্নিপরীক্ষা। শাম্মি কাপুর কিন্তু এককথায় পঞ্চমকে সুযোগ দিতে মোটেও রাজি হননি। তিনি সংগীত পরিচালক হিসেবে মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন শঙ্কর-জয়কিষণ জুটিকে। তাঁর পছন্দের তালিকায় ছিলেন ওপি নাইয়ারও। তাই পরিচালক বিজয় আনন্দের পক্ষে শাম্মি কাপুরকে রাজি করানোর কাজটি ছিল যথেষ্ট কঠিন। যদিও তিনি নিশ্চিত ছিলেন, পঞ্চম তাঁর বিশ্বাসের যথাযথ মর্যাদা দেবেন। বিজয়জি পঞ্চমকে ছোটবেলা থেকে চিনতেন। তিনি নিজের চোখে দেখেছেন কীভাবে পঞ্চম তাঁর বাবার সুযোগ্য সহকারী হিসেবে একের পর এক কাজ করেছেন। তিনি পঞ্চমের প্রতিভা এবং সঙ্গীতের তালিম সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬: দুয়ারে অপচ্ছায়া

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৯: উড়িয়ে…বম্বের তাজ হোটেলে, তাজমহল টাওয়ার নয়, তাজমহল প্যালেসে

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৯: ফেরেন্তস পুসকাস: দুটি দেশের হয়েই বিশ্বকাপ খেলেছেন

বিজয়জি খুব ভালো করে জানতেন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ওপর পঞ্চমের দখলের কথা। তাই এবার তিনি প্রযোজক নাসির হোসেনের স্মরণাপন্ন হলেন। নাসির সাহেব শাম্মিকে অনুরোধ করলেন এই ছবির জন্য পঞ্চমের তৈরি গানগুলি অন্তত একটিবার শুনতে। শেষমেশ শাম্মিজিও রাজি হলেন। একদিন বসলেন সবাই। পঞ্চম শুরু করলেন ‘দিওয়ানা মুঝসা নেহি’ গানটি দিয়ে। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন যে, শাম্মির একটু হলেও পছন্দ হয়েছে। তারপর ‘ও হাসিনা জুলফওয়ালি জানে জাহান’ গানটি শোনার পর শাম্মি অসম্ভব উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন। বুঝতে পারেন এই সুরগুলি শুধু তাঁরই জন্য পঞ্চম জন্ম দিয়েছেন। ব্যাস, পঞ্চমের সামনে খুলে যায় ভাগ্যের দরজা। হাসি ফোটে নাসির ভাই আর বিজয়জির মুখে। আর তারপরই জন্ম হয় যুগান্তকারী ছবি ‘তিসরি মঞ্জিল’ এর।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: কুলের আচারের নাম শুনলে জিভে জল আসে? রইল সহজ রেসিপি

দশভুজা: সেই ষোলো মিনিটের দূরত্ব কোনওদিন পূরণ হয়নি

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১১: বন থেকে বনান্তরে

এরপর থেকে পঞ্চমের জনপ্রিয়তা মহীরুহে পরিণত হয় আলোর গতিতে। ছেলের এই অসামান্য কীর্তি বাবা শচীনদেব বর্মণকে যারপরনাই গর্বিত করেছিল। এই ছবিটিই ছিল আরডি-র জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।

এর পর আরও কয়েকটি ছবিতে কাজ করেন পঞ্চম। পতি পত্নী, অভিলাষা প্রভৃতি। এই সব ছবিতে তিনি তাঁর নিজস্বতার প্রমাণ রাখেন যথাযথ ভাবেই। এরপর আসে আরেকটি যুগান্তকারী ছবি ‘পড়োশন’। সাল ১৯৬৮। আগেই বলেছি, এই ছবিতে প্রযোজক মেহমুদ পঞ্চমকে অভিনয়েরও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু পঞ্চম মেহমুদকে বুঝিয়েছিলেন যে, অভিনয়ে মন দিলে তাঁর সুরসৃষ্টিতে মনোনিবেশ করা হয়ে উঠবে না। মেহমুদও আর তাঁকে জোর করেননি। আর পঞ্চমও এই ছবিতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। এই ছবিতে পঞ্চমের উদ্ভাবন ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে আরও একবার।
‘পড়োশন’-এর সেই বিখ্যাত‘মেরে সামনেওয়ালি খিড়কি মে’ গানে ‘রেসো-রেসো’ নামে একটি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেন আরডি। ‘রেসো-রেসো’ বাদ্যযন্ত্রটি মূলত আফ্রিকায় তৈরি। এই ছবিতে সেটি বাজিয়েছিলেন প্রয়াত আমরুত রাও কাৎকার। সেটি কোনটি জানেন? গানটির প্রিলুড মিউজিকে একটি জায়গায় প্রয়াত কৌতুকাভিনেতা কেষ্ট মুখোপাধ্যায়কে একটি ঝাড়ুর উপর চিরুনি দিয়ে যে শব্দটি সৃষ্টি করতে দেখা যায় সেটি ‘রেসো-রেসো’ থেকে জন্ম নেওয়া শব্দ। আর সেটি বাজিয়েছিলেন আমরুত রাও কাৎকার। শুধু ইন্টারলিউডেই নয়, পুরো গানটিতেই নেপথ্যে বেজে গিয়েছে ‘রেসো-রেসো’। সেই সঙ্গে গানের ছন্দকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রেখেছে। একজন সুদক্ষ তবলাবাদক হিসেবে অতি পরিচিত আমরুত ‘রেসো-রেসো’ বাজিয়ে শ্রোতাদের তাক লাগিয়ে দেন। নেপথ্যে সেই পঞ্চমই।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১০: ব্যস্ত পৃথিবী ছাড়িয়ে কোথায় যেন চলে এলাম উত্তরমেরুর জনমানবহীন এই জঙ্গলে, যেখানে এখন শুধুই রাত

হেলদি ডায়েট: বেশি কলা খাওয়ার অভ্যাস কি স্বাস্থ্যকর? মারাত্মক কোনও রোগের কারণ হয়ে উঠবে না তো?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১১: লিকার চা খাওয়া কি সত্যই শরীরের পক্ষে ভালো?

এই ছবির আরও একটি গানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সেটি হল ‘এক চতুরনার করকে শৃঙ্গার’। একবার রসায়নটি ভেবে দেখুন। কিশোর কুমার, মান্না দে এবং স্বয়ং মেহমুদ। এই ত্রয়ীর গলাকে একসঙ্গে মিলিয়ে একটি কমেডি দৃশ্যের জন্য রচিত এই রাগভিত্তিক গান! কিশোর কুমার এবং মান্না দে যেন নিজেদের কণ্ঠ দিয়ে অভিনয় করেছেন এই দৃশ্যে। কি অসাধারণ! এখানেই পাওয়া যায় পঞ্চমের চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস এবং দক্ষতার নিদর্শন। আজও যার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই গানটির জনপ্রিয়তা। এই ছবির ‘কেহেনা হ্যায় কেহেনা হ্যায়’ গানটির সুরের মাধুর্য আজও আমাদের এক মাদকতায় আচ্ছন্ন করে রাখে। পঞ্চম-কিশোর জুটির এ এক অভিনব নিদর্শন। এ ছাড়াও ‘আও আও সাওয়ারিয়া’, ‘শরম আতি হ্যায় মগর’, ‘মে চলি মে চলি’ গানগুলিও বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো।—চলবে

ছবি সংগৃহীত
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content