শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


কোকিল।

‘কাকের কঠোর স্বর বিষ ঢালে কানে,
কোকিল অখিল প্রিয় সুমধুর তানে’


বসন্তের দূত হল কোকিল। শীতের কঠোরতা শেষে যখন আসে বসন্ত তখনই মধুর কণ্ঠী কোকিলের আবির্ভাব ঘটে এই বাংলায়। পল্লবীত বৃক্ষরাজিতে, দুপুরে নিস্তব্ধতা ভেঙে কোকিলের কুহু ধ্বনি শোনা যায়। এই ধ্বনি গ্রামবাংলার একান্ত নিজস্ব ধ্বনি। নীলাভ কৃষ্ণবর্ণের পুরুষ কোকিলের কণ্ঠস্বরই হল মধুর। কিছুটা খইরি বর্ণের, তার ওপর সাদা ডোরা বা ছিটেফোঁটা দাগযুক্ত তিলে কোকিলই হলো স্ত্রীকোকিল। এর কণ্ঠস্বর মধুর নয়। যৌন দ্বিরুপতা যুক্ত আংশিক যাযাবর এই পাখিটি হল কুকুলিডি গোত্রভুক্ত। এদের সমগ্র বিশ্বব্যাপী মোট ২৬টি গন বর্তমান। মরু ও মেরু অঞ্চল বাদ দিয়ে প্রায় সমগ্র পৃথিবীই এদের আবাসস্থল।

তবে বিষুবীয় অঞ্চলে এদের সংখ্যাধিক্য দেখা যায়। অধিকাংশ বৃক্ষচর হলেও কিছু ক্ষেত্রে ভূচর এই প্রাণীটি কিন্তু নিজের বাসা তৈরি করতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। তাই এদের বলে ব্রুড প্যারাসাইট বা বাসা পরজীবী। জীবনের প্রথম লগ্নে এরা যখন কাকের বাসায় বাস করে, তখন থাকে সর্বভুক। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এরা শুয়োপোকা ব্যতীত ফলমূলই খেতে পছন্দ করে। এদের প্রিয় ফল হল বট গাছের পাকা ফল।
একটি পূর্ণবয়স্ক কোকিল ১৭ ইঞ্চির কম নয়, তবে লেজটিই শরীরের অর্ধেকের বেশি অংশ জুড়ে থাকে। এরা উন্মুক্ত এবং জনবহুল স্থান পছন্দ করে না। এদের সর্বাপেক্ষা প্রিয় স্থান হল কোনও নির্জন স্থান। আম, জাম, কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, নিম, কুল ইত্যাদি গাছের পাতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকে এই লাজুক স্বভাবের প্রাণীটি। এই লুকিয়ে থাকার আরেকটি কারণ হতে পারে কাক এবং ছাতার পাখি। কারণ কোকিল দেখলেই এই পাখি দুটি এদের ধাওয়া করে।

প্রাণীটি খুব ঠান্ডা স্থান পছন্দ করে না। তাই এরা খাদ্য এবং উষ্ণতার জন্য যাযাবর বৃত্তি গ্রহণ করেছে। বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি এর মতে পাখিটি হল আভ্যন্তরীণ বা আংশিক যাযাবর। পক্ষী বিশারদদের মতে, কোকিল ভারতের মধ্যেই সারা বছর থাকে। আবার কোনও কোনও প্রজাতি গ্রীষ্ম থেকে শীত পর্যন্ত আফ্রিকাতে বাস করে এবং বসন্তের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলা তথা ভারতে আসে।
আরও পড়ুন:

হারিয়ে যাওয়া টেলিগ্রাম

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

ভারত তথা বাংলার লোককথায় ও সাহিত্যে এদের অবাধ বিচরণ হলেও বর্তমানে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গে এদের যাতায়াত কমেছে, যা পরিবেশবিদ এবং পক্ষীবিশারদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। আইইউসিএন-এর সংরক্ষণ তালিকায় এদের স্থান হল ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত প্রাণী বা লিস্ট কনসার্ন অ্যানিমেল। এদের সংখ্যা হ্রাস বা পশ্চিমবঙ্গের আগমনের হ্রাসের অনেক কারণ আছে। কোকিল হ্রাসের অন্যতম কারণ হল কোকিল একটি পরিযায়ী পাখি। একে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয় কেবলমাত্র খাদ্য ও বাসস্থান ঠিক করতে। এই দীর্ঘপথের ক্লান্তি, খাদ্যাভাব ও পাখি শিকারিদের লোভের বশীভূত হয়ে এদের মৃত্যু ঘটে শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১২: সুখলতা রাও— ছোটদের পরী

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা

পরিযায়ী পাখি হওয়ার জন্য এরা যেমন বিভিন্ন রোগের জীবাণু বহন করে, তেমনি বিভিন্ন রোগে মৃত্যুও ঘটে এদের। শীতের শুরু এবং গ্রীষ্মকালে শুষ্কতার জন্য বহু জঙ্গলের দাবানল ঘটে, এর ফলে অন্যান্য পশু-পাখির মতো কোকিলেরও মৃত্যু ঘটে প্রতিবছর। অপরিকল্পিত নগরায়ন, কলকারখানা স্থাপন, ঘরবাড়ি নির্মাণের ফলে সমগ্র ভারতের মতো পশ্চিমবঙ্গ ও জঙ্গল এবং গাছপালার সংখ্যা কমছে। ঘনপল্লবিত বৃক্ষের সংখ্যা হ্রাস এবং এর ফলস্বরূপ কোকিলের বাসস্থান হ্রাস পাচ্ছে। নির্জনতা প্রিয় কোকিল তাই মুখ ফেরাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে।

জৈব কৃষিকাজের পরিবর্তে ফসল এবং সবজিতে ব্যাপক পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগের ফলে কোকিল যে খাবার খায় তা থেকে তাদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে ও তাদের মৃত্যুও ঘটছে। জাঙ্গল ক্রো বা দাঁড় কাক সংখ্যা বিভিন্ন কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ার জন্য তাদের বাসার সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে কোকিল তাদের ডিম পাড়ার উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছে না। ফলে তাদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বিভিন্ন মানুষ পাখি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোকিল কিনে তাদের খাঁচায় বন্দি করে রেখে দেয় হলে কোকিলের সংখ্যা কমে যায়। তাদের অত্যন্ত প্রিয় খাবার বটফল।
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: ঠাকুরবাড়ির বাঙালিয়ানা‌

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: তোমার ভাষা বোঝার আশা

এই বটগাছ এবং অশ্বত্থ গাছের সংখ্যা হ্রাস এবং বিভিন্ন বহিঃ প্রজাতি বৃক্ষের আগমন তাদের মৃত্যুর একটি কারণ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন। বসন্তকালের সময় কমে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন গাছের ফুল ও ফল আসতে দেরি করছে বা কমে যাচ্ছে। তার ফলে কোকিলের স্বাভাবিক খাদ্য কমে যাওয়া তাদের কম আগমনের একটি কারণ হতে পারে।

এই কোকিলের অমিল হয়ে যাওয়া প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন কোকিল বিভিন্ন ফুলের পরাগ সংযোগ ঘটায় এবং বিভিন্ন গাছের বীজকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে দেয়, যেটি ইংরেজিতে বলে সিড ডিসপার্সাল ঘটায়। এছাড়াও এমনও অনেক বীজ আছে যাদের অঙ্কুরোদগম কোকিলের পেটে না গেলে হয় না। ফলে কোকিলের আসা-যাওয়ার ওপর প্রকৃতির ভালো-মন্দ নির্ভর করে অনেকখানি। তাই প্রকৃতি তথা পৃথিবীকে সুস্থ রাখার জন্য কোকিলের সুস্থতা একান্তই প্রয়োজন। তাই কোকিল বাঁচানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোনদিনই হয়তো কোকিলের সুমধুর তান শুনতে পাবে না।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content