রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

প্রাচীন ভারতীয় নীতির পণ্ডিতরা শত্রু আর রোগের বাড়বাড়ন্ত—এই দুটোকেই সমান কষ্টকর বলে উল্লেখ করেছেন। সেই জন্যই যে ব্যক্তি নিজের কল্যাণ আর সুস্বাস্থ্য কামনা করেন তার উচিত শত্রু এবং রোগ, কোনওটাকেই উপেক্ষা না করা। আর যে ব্যক্তি নিজের ক্ষমতা এবং সামর্থ বুঝে নিজের আত্মমর্যাদা রক্ষায় উদ্যোগী হন তিনি এই বিশ্বসংসারে আর কারো থেকে কোনও সাহায্য না পেলেও একলাই বহু শত্রুকে হত্যা করতে সমর্থ হন। যেমন ভার্গব পরশুরাম একলা গোটা পৃথিবীকে একাধিকবার ক্ষত্রিয়হীন করেছিলেন। তাই ভাসুরক সিংহ সেই ছোট খরগোশটিকে কেবল সেই অপর সিংহটিকে দেখিয়ে দিতে বললেন মাত্র। তিনি দৃঢ়সঙ্কল্প “দুর্গস্থমপি দর্শয তং চৌরসিংহ যেন ব্যাপাদযামি”—দুর্গের মধ্যে থাকলেও সেই বাটপার সিংহটিকে ভাসুরক হত্যা করতে পারবেন।

কিন্তু শক্তি আর ক্ষমতা থাকলেই যে সব হয় না, পঞ্চতন্ত্রকার এই গল্পটির মাধ্যমে সেইদিকটাই নজরে আনতে চেয়েছেন। যেকোনো কার্যসিদ্ধির জন্যেই যে শক্তি আর ক্ষমতার সঙ্গে বুদ্ধি খরচ করে “স্ট্র্যাটিজি” বা পরিকল্পনাও প্রয়োজন এইটা অনেকেই ভুলে যান। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধিকরণে “মন্ত্রাধিকার” বলে একটি অধ্যায় আছে। সেখানে কৌটিল্য দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “মন্ত্রপূর্বা সর্বারম্ভাঃ”—মন্ত্রীদের সঙ্গে মন্ত্রণা করে তাঁদের বুদ্ধি নিয়ে পরিকল্পনা করেই সবকিছু করা উচিত। কিন্তু ভাসুরক-সিংহের মতো যে রাজা মনে করেন যে শুধু নিজের ক্ষমতার-দম্ভ এবং শক্তিপ্রয়োগ করে ভয় দেখিয়েই সকলকে বশে রাখা যায়, সে ভ্রান্ত। কারণ প্রজাকে বশে রেখে তার থেকে রাজস্বরূপ ফল পেতে গেলে চাই পরিকল্পনা, চাই বুদ্ধিবৃত্তি। সুতরাং ক্ষমতাটাই সব নয়। ভাসুরক সিংহের পতনের কারণটিও ছিল সেইটাই।

শশকটি সিংহকে আরও রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বললে, “অস্ত্যেতৎ। তথাপি বলবান্‌ স মযা দৃষ্টঃ। তন্ন যুজ্যন্তে স্বামিনস্তস্য সামর্থ্যমবিদিত্বা গন্তুম্‌।”—মহারাজ! আপনি যা বলছেন সে কথাগুলোই সত্য। কিন্তু তাও বলবো যে সে সিংহটিকে দেখে আমার কিন্তু বেশ বলবান মনে হয়েছে। তাই আমার অভিমত হল তার ক্ষমতা না জেনে-শুনে আপনার তার সঙ্গে বিরোধে যাওয়াটা উচিত হবে না। কারণ পণ্ডিতরা বলেন—

অবিদিত্বাত্মনঃ শক্তিং পরস্য চ সমুত্সুকঃ।
গচ্ছন্নভিমুখো নাশং যান্তি বহ্নৌ পতঙ্গবৎ।। (মিত্রভেদ, ২৬০)


অর্থাৎ যে মানুষ নিজের এবং তার শত্রুর ক্ষমতাকে বিচার বিশ্লেষণ না করেই আবেগের বশবর্তী হয়ে শত্রুর সম্মুখে বিরোধীতা করতে চলে যায় সে অগ্নিতে ঝাঁপিয়ে পড়া পতঙ্গের মতো সমূলে বিনষ্ট হয়ে যায়। এমনকি যে ব্যক্তি নিজে যথেষ্ট বলবান হওয়া সত্ত্বেও তার থেকেও বলবান শত্রুকে মারবার জন্য এগিয়ে যায়, সে দাঁত ভাঙ্গা হাতির মতো বিফল হয়ে ফিরে আপরাজয় তার নিশ্চিত।

ভাসুরজ সিংহ ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, “ভোঃ কিং তবানেন ব্যাপারেণ?” ওরে তোর এতো কথার কি আছে? —“দর্শয মে তং দুর্গস্থমপি”, দুর্গের মধ্যে থাকলেও সেই জায়গাটা আমায় শুধু একবার দেখিয়ে দে।

খরগোশটি বললে, হে স্বামী! এইটাই যদি আপনার অভিমত হয় তবে আমার সঙ্গে আসুন। এই বলে সে আগে আগে সিংহকে পথ দেখিয়ে চলতে লাগলো। আসবার সময় সেই খরগোশ যে কুঁয়োটি দেখেছিল তার কাছে পৌঁছে সেটি দেখিয়ে ভাসুরককে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী করে তোলবার জন্য কপটতা করে বলল, “স্বামিন্‌ কস্তে প্রতাপং সোঢুং সমর্থঃ।” — হে স্বামী! আপনার দোর্দণ্ডপ্রতাপ সহ্য করবার ক্ষমতা ক’জনেরই বা আছে?
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২৮: ঋণ, অগ্নি ও ব্যাধির শেষ রাখতে নেই

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৫: কানে তালায় কানের ড্রপ?

কূপটিকে দেখিয়ে খরগোশটি বললে, “ত্বাং দৃষ্ট্বা দূরতোঽপি চৌরসিংহঃ প্রবিষ্ট স্বং দুর্গম্‌। তদাগচ্ছ, যেন দর্শযামি।”—মহারাজ! আপনাকে দূর থেকে আসতে দেখেই সে তার এই দুর্গের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, আপনি আসুন আমি এর মধ্যে অবস্থিত সেই জোচ্চোর সিংহটিকে এখনই আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।

ভাসুরক গর্জন করে বলল, “দর্শয মে দুর্গম্‌” —কোথায় সেই দুর্গ এখনই দেখা।

খরগোশটি সেই কুঁয়োটি দেখিয়ে দিল। সেই মূর্খ সিংহও সেই কূপের অনেক নীচে থাকা জলের মধ্যে নিজের ছায়া দেখে গগনবিদারী সিংহনাদ করে উঠলো আর সেই নাদ কূপের ভিতরের আবদ্ধ দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আরও দ্বিগুণ দর্পে ফিরে এলো। সেই প্রতিধ্বনিকে শত্রু সিংহের প্রতিধ্বনি ভেবে ভাসুরক সিংহ কূপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রতিশোধ নিতে এবং তার খেলাও সাঙ্গ হল।

ছোট খরগোশটিও মহানন্দে ফিরে গিয়ে সকল জন্তুদের কাছে সে বৃত্তান্ত জানিয়ে তাদের যেমন আশ্বস্তও করলো এবং নিজেও তাদের দ্বারা বিপুল পরিমাণে প্রশংসিতও হল।
 

৮ম কাহিনি সমাপ্ত

গল্প শেষ করে দমনক করটককে বলল, এই কারণেই আমি বলি “যস্য বুদ্ধির্বলং তস্য”—যার বুদ্ধি আছে, সেই বলবান। তাই তুমি যদি সম্মতি দাও তাহলে সিংহরাজা পিঙ্গলক আর বৃষ-সঞ্জীবকের কাছে গিয়ে “স্ববুদ্ধিপ্রভাবেণ মৈত্রীভেদং করোমি”, নিজের বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে দুজনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাই।

করটক সম্মতি দিয়ে বলল, “ভদ্র, যদ্যেবং তর্হি গচ্ছ। শিবাস্তে পন্থানঃ সন্তু। যথাঽভিপ্রেত্যমনুষ্ঠীযতাম্‌।” – হে ভদ্র! তাই যদি হয় তবে যাও। তোমার পথ মঙ্গলময় হোক। যা মনের ইচ্ছে তাই যেন তোমার পূর্ণতা লাভ করে।

এরপর কোনও একসময় দমনক দেখলো যে সিংহ পিঙ্গলক একা, সঞ্জীবক ধারে কাছে কোথাও নেই। এমনই একটা সুযোগের অপেক্ষা করছিল দমনক। সোজা পিঙ্গলকের কাছে গিয়ে সে তাকে প্রণাম করে পাশে বসলো।

পিঙ্গলকও দমনককে দেখে বললেন, “ভদ্র! চিরাদ্দৃষ্টঃ?” —অনেকদিন দেখা নেই যে?

দমনক অভিমানের সুরে বললে, আসলে মহারাজ আপনার চরণকমলের জন্য আমার কোনও আবশ্যকতা ছিল না, তাই আর আপনাকে বিরক্ত করিনি, আমার আবশ্যকতা থাকলে নিশ্চয় উপস্থিত হতাম। কিন্তু তাও চোখের সামনে রাজকার্যের বিনাশ হতে দেখে দুঃখে মন বিদীর্ণ হওয়ায় ব্যাকুল হৃদয়ে অযাচিত ভাবেই আপনার কাছে কয়েকটা কথা বলবার জন্য এলাম। কারণ পণ্ডিতরা বলেন—

প্রিয বা যদি বা দ্বেষ্যং শুভং বা যদি বাঽশুভম্‌।
অপৃষ্টোঽপি হিতং বক্ষ্যেদ্‌ যস্য নেচ্ছেৎ পরাভবম্‌।। (ঐ, ২৬২)


আপনার ক্ষতি আমরা চাই না, কিন্তু তাও চোখের সামনে আপনার আসন্ন এই বিনাশ আর দেখতে পাচ্ছি না। তাই আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। শাস্ত্রে বলে, যে শুভাকাঙ্খী ব্যক্তি তার নিকট জনের বিনাশ চায় না, তার উচিত ভালো হোক বা মন্দ হোক কিংবা সেই হিতকারী ব্যক্তির উপর বিদ্বেষ উদ্রেগকারীই হোক—না প্রশ্ন করলেও নিকটজনকে সত্য কথাটাই বলা।

পিঙ্গলক দমনকের এই গৌরচন্দ্রিকা শুনেই সাগ্রহে তার কথায় গুরুত্ব দিয়ে বললেন, “কিং বক্তুমনা ভবান্‌? তৎ কথ্যতাং যৎকথনীযমস্তি।”—যা মনে আছে নির্ভয়ে বলো।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৪: কুর্গের সবুজ দুর্গ

দমনক বললেন, হে দেব! যতোই বাইরে মিত্রতা দেখাক না কেন সঞ্জীবক কিন্তু আপনাকে মিত্র ভাবে না। বরং শত্রুতাপূর্ণ মনোভাবই সে পোষণ করে আপনার উপর। আমাকে সে তার খুব নিজের লোক মনে করে নির্জনে একবার বলেছিল, “ভো দমনক দৃষ্টা মযাস্য পিঙ্গলকস্য সারাসরতা। তদহমেনং হত্বা সকলমৃগাধিপত্যং ত্বত্সাচিব্যপদবীসমন্বিতং করিষ্যামি।” —ওহে দমনক। পিঙ্গলকের বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় তো দেখলাম, একেবারেই অন্তঃসারশূন্য। তাই আমি একে হত্যা করে মৃগকুলের রাজা হবো আর তোমাকেই সচীবপদে নিযুক্ত করবো।

পাঠক-পাঠিকাদেরকে বলবো, রাজনীতির এই মজাটা খেয়াল করবেন। কারও সম্পর্কে যদি অন্যের মনে কখনও কোনও বিরূপ মনোভাব তৈরি করাতে হয় তাহলে বাজারে কিছু মিথ্যা গল্প ছেড়ে দিতে হয়। মানে ব্যাপারটা হলো, রামবাবু আর শ্যামবাবু দু’জন অভিন্ন হৃদয়বন্ধু হলেও তৃতীয় ব্যক্তি যদি কূটনীতি করে রামবাবুর কাছে এসে আলাদাভাবে ফিস ফিস করে কানের কাছে এসে বলতে থাকে যে শ্যামবাবু বাইরে শুধু আপনার নিন্দাই করেন, তাহলে সেই তৃতীয় ব্যক্তিটির সংবাদের যথার্থতা বিচার না করেই দেখবেন রামবাবুও শ্যামবাবুকে এড়িয়ে চলতে শুরু করবেন এবং তার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করা শুরু করবেন। কিন্তু এতোদিনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু শ্যামবাবুকে ডেকে একটিবারের জন্যও রামবাবু খবরের সত্যতা জানবার প্রচেষ্টা করবেন না। বরং সেই তৃতীয় ব্যক্তিটিই দেখবেন সহজেই রামবাবুর প্রধান পরামর্শদাতা হয়ে যাবে। সিংহ-পিঙ্গলকের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম হল। দমনকের কাছে প্রাণের বন্ধু সঞ্জীবকের এইরকম মনোভাবের কথা শুনে সে একেবারে বিমর্শ আর মোহগ্রস্ত হয়ে গেল। মুখে সে আর কিছুই বলতে পারলো না।
দমনক পিঙ্গলকের এই নীরবতা দেখে বুঝতে পারলো যে পিঙ্গলকের মন পুরোপুরিই সঞ্জীবকে আসক্ত। পূর্বলব্ধ রাজনীতিবিদ্যাকে স্মরণ করে সেবুঝতে পারলো যে এই মন্ত্রী সঞ্জীবকের কারণেই একদিন পিঙ্গলকেরপতন হবে নিশ্চিতভাবে।পিঙ্গলকে সে বললে, হে রাজন্‌! আপনি অর্থশাস্ত্রের রাজনীতি স্মরণ করুন। পণ্ডিতরা বলেছেন—

একং ভূমিপতিঃ করোতি সচিবং রাজ্যে প্রমাণং যদা
তং মোহাচ্ছ্রযতে মদঃ স চ মদাদ্‌দাস্যেন নির্বেদ্যতে।
নির্বিণ্ণস্য পদং করোতি হৃদযে তস্য স্বতন্ত্রস্পৃহা
স্বাতন্ত্র্যস্পৃহযা ততঃ স নৃপতে প্রাণেষ্বভিদ্রুহ্যতে।। (মিত্রভেদ, ১৬৩)
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৯: ইষ্টদেবী জগদ্ধাত্রী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৩: বাড়ির কাজের লোককে নিজের সম্পত্তির অধিকার দিতে দ্বিজেন্দ্রনাথ দলিল পাল্টেছিলেন

রাজা যখন রাষ্ট্রে একজন মন্ত্রীকেই সর্ববিষয়ে প্রমাণিত করে দেন, অর্থাৎ রাজ্য পরিচালনার সবরকম ব্যবস্থা একজন বিশ্বাসভাজন মন্ত্রীর উপরেই যদি ন্যস্ত করে দেন তাহলে সেই মন্ত্রী মোহগ্রস্ত হয়ে অহঙ্কারী হয়ে যান; আর সেই অহঙ্কারের জন্যই রাজসেবা তার তখন দাসত্ব বলে মনে হয়। তার মনে হয় সব কাজটাই তো সে-ই করছে, বলা যায় ব-কলমে রাজ্যটা সে-ই চালাচ্ছে কিন্তু ফল লাভ করছেন শুধু রাজা। তাই মনে তার বিশাদ জন্মায়, সে দুঃখিত হয় এবং হৃদয়ে তার স্বতন্ত্র হওয়ার ভাবনা জাগে—এইটাই জগতের নিয়ম। এই স্বতন্ত্র হওয়ার ইচ্ছে থেকেই রাজার প্রতি তার দ্রোহভাব উত্পন্ন হয় এবং তার মনে রাজাকে হত্যা করে স্বয়ং রাজা হয়ে বসবার ভাবনা জাগতে থাকে।

আপনি সঞ্জীবকের উপর সমস্ত দ্বায়িত্বভার ন্যস্ত করে সুখে আছেন, তাই তার পক্ষে আপনার প্রতি দ্রোহভাব উত্পন্ন হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক?

দমনক বলল, মহারাজ আপনি কি বুঝতে পারছেন এখন আপনার ঠিক কি করা উচিত?—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content