ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
দমনক বলতে থাকে, রাজশক্তি বা রাজনীতিতে যাঁরা শীর্ষস্থানে থাকেন তাঁদের আবার নির্দিষ্ট কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। রাজশক্তির কেন্দ্রে থাকা রাজা সাধারণত অন্ধ হন—তিনি নিজের চর্মচক্ষুতে নাকি কিছুই দেখতে পান না। অর্থশাস্ত্র বলে “চারৈঃ পশ্যন্তি রাজানঃ”। তিনি যা দেখেন সবটাই দেখেন চরের মাধ্যমে। রাজার আশেপাশে থাকা মানুষজনই রাজার চোখ। রাজা তাঁদের চোখ দিয়েই দেখেন। তাঁরা যা বলেন, যা যা পরামর্শ দেন রাজা সেই মতোই চলেন। পঞ্চতন্ত্রকারের দাবি অনুযায়ী যে রাজার আশেপাশে থাকা সেই মানুষগুলো যদি “বিদ্যাবিহীন”—অশিক্ষিত, “অকুলীন” কিংবা “অসংস্কৃত”ও হন, রাজা তাঁদের কথাই শোনেন। রাজনীতি শাস্ত্রের বিষয়ে তাঁরা চুড়ান্ত অনভিজ্ঞ হলেও, রাজা তাঁদেরকেই ভরসা করেন। লতানো গাছ যেমন তার পাশে থাকা যেকোনও বড় বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরে, বিলাসিনী নারী যেমন পাশে থাকা পুরুষকে অবলম্বন করে, সে পুরুষ যেমনই হোক—রাজাও তেমনই।
যোগ্য বা অযোগ্য—যে মানুষই রাজার সঙ্গে থাকেন, রাজা তারই কথায় ওঠেন-বসেন। এইটাই রাজপদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য—“যৎ পার্শ্বতো ভবতি তৎ পরিবেষ্টযন্তি”। আর যারা রাজার সেবক- রাজসেবা করাই যাদের বৃত্তি তাদেরকেও জানতে হয় কিসের থেকে রাজার ক্রোধ উৎপন্ন হয়, বা কোনও কাজে রাজা প্রসন্ন হন। সোজা কথায় রাজার ভালোলাগা বা মন্দলাগা রাজ সেবকদের একেবারে নখদর্পণে থাকা দরকার। সেই মতোই রাজার সঙ্গেও ব্যবহার করা দরকার। ধরুন আপনার রাজা বা বৃহত্তর অর্থে আজকের দিনে যাকে আমরা মনিব বা নেতা বা অফিসের বড় সাহেবও বলতে বলতে পারি, তিনি হয়তো চিংড়ি মাছ খেতে খুব পছন্দ করেন। কিন্তু সেই চিংড়ি মাছে যদি তার অ্যালার্জি থাকে, মানে চিংড়ি খেলেই যদি তার পেটে ব্যথা হয়।
যে জাত্যাদিমহোত্সাহান্নরেন্দ্রান্নোপাযন্তি।
তেষামামরণং ভিক্ষা প্রাযশ্চিত্তং বিনির্মিতম্।। (মিত্রভেদ ৩৯)
একসঙ্গে এতোগুলো কথা বলে দমনক এবারে প্রথম কূটনীতির সূত্রটি দেয় করটককে। বলে, যে সমস্ত দুর্বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরা বলে রাজাকে তুষ্ট করা যায় না বা রাজাকে প্রসন্ন করে তার কৃপা পাত্র হওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার —তারা শুধু নিজেদের আলস্য বা মূর্খতাকেই প্রকাশ করে মাত্র। কারণ—
সর্পান্ ব্যাঘ্রান্ গজান্ সিংহান্ দৃষ্ট্বোপাযৈর্বশীকৃতাম্।
রাজেতি কিযতী মাত্রা ধীমতামপ্রমাদিনাম্।। (ওই, ৪১)
অর্থাৎ বুদ্ধির জোরে সাপ, বাঘ, হাতি এমনকি সিংহকেও বশে আনা যায়, রাজাকে বশে আনা আর এমন কী ব্যাপার? ছোটবেলায় বাঁশি বাজিয়ে সাপুড়েদের সাপের খেলা বা সার্কাসে রিং মাস্টারের বাঘ-সিংহের খেলা আমরা সকলেই দেখেছি। হাতিতে চড়ে কখনও কখনও জঙ্গল সাফারিও হয়তো করেছি অনেক সময়। দমনক বলতে চায়, মানুষের তাহলে কতখানি ক্ষমতা সেইটা ভাবতে হবে। এইরকম ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব প্রাণীদেরও বিভিন্ন উপায়ে মানুষ যেখানে বশীভূত করতে পারে সেখানে রাজাকে বশ করা আর এমন কী ব্যাপার? সোজা কথায় বুদ্ধিমান মানুষ যদি চায় তো সহজেই রাজাকেও পকেটে ভরে ফেলতে পারেন। আর সত্যি কথা বলতে রাজার হাত মাথার উপর না থাকলে বিদ্বানদের কোন উন্নতিও নেই। আর রাজা যদি প্রসন্ন হন তবে রাজ সেবকদের বাড়ি-গাড়ি-সম্মান সবই জোটে। তাই দমনকের মত হল, আমাদের নিজেদের অবস্থার উন্নতি যদি করতে হয় তাহলে রাজার কাছের লোক হতে হবে।
সব শুনে করটক বলে, তবে তুমি কি করতে চাও—“অথ ভবান্ কিং কর্তুমনাঃ”?
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৮: জীবনে উন্নতি করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আপনাকে থাকতে হবে
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন
এই জায়গায় গল্পটা আবার থামাতে হবে। থামাতে হবে পাঠকদের স্বার্থেই। দমনক এখানে এক নিঃশ্বাসে অর্থশাস্ত্রের যে পারিভাষিক শব্দগুলো বলে গেল সেগুলোর সঙ্গে আপনাদের কিছুটা পরিচিত করিয়ে দিতেই এখানে থামা। “ষাড্গুণ্য” শব্দটার আভিধানিক অর্থ খুব সহজ। “ষাড্গুণ্য” মানে হল ছ’টা গুণ। অর্থশাস্ত্রের ক্ষেত্রে এটা একটা পারিভাষিক শব্দ। মূলত বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেই এই “ষাড্গুণ্য” শব্দটা অর্থশাস্ত্রে ব্যবহার হয়। সোজা করে বলতে গেলে বলতে হয় যে, “ষাড্গুণ্য” বলতে বোঝায় মূলত “সামরিক নীতির ছ’টি উপায়” বা “রাষ্ট্রীয় কূটনীতির ছ’টি কৌশল”। তার মধ্যে প্রথমটি হল “সন্ধি”।
দুই রাজার মধ্যে ভূমি, কোশ এবং সামরিক বলের দান বিষয়ে চুক্তিকে “সন্ধি” বলে। সংস্কৃত ভাষায় একে “পণবন্ধন”ও বলা হয়। “বিগ্রহ” মানে হল, বিবাদ। শত্রু রাজার অপকার সাধন করা বা শত্রুর প্রতি দ্রোহ-আচরণ করাকে বলে “বিগ্রহ”। দ্রোহ মানে হল গালিগালাজ করা। শত্রু রাজার সঙ্গে সন্ধি বা বিগ্রহের ক্ষেত্রে প্রথমে কোনও রকম আগ্রহ না দেখানোকেই অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় বলে “আসন”। আবার নিজের শক্তিবৃদ্ধি করার জন্য শত্রুরাজার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করবার অভিপ্রায়ে অভিযান করাকে বলে “যান”। বলবান রাজার কাছে নিজের স্ত্রী-পুত্র, নিজের দ্রব্যাদি অর্পণ করে শরণাগত হওয়ার নাম “সংশ্রয়”। আর দু’জন বলবান রাজার মধ্যে একজনের সঙ্গে সন্ধি করা এবং অপরজনের সঙ্গে বিবাদ বাঁধানো বা যুদ্ধ করাকে “দ্বৈধীভাব” বলে। কোনও কোনও পণ্ডিত আবার “দ্বৈধীভাব” বলতে একরকম ‘ডুপ্লিসিটি’কেও বুঝিয়েছেন; শত্রুর সঙ্গে উপর উপর মুখে “সন্ধি” করে সেই শত্রুর বিরুদ্ধেই গোপনে গোপনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নাম “দ্বৈধীভাব” (অর্থশাস্ত্র ৭/১)।
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২: “যে ‘কেবল’ পালিয়ে বেড়ায়”
লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-১: কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়…
তবে শত্রুরাজার থেকে নিজের রক্ষা করার জন্য বলবত্তর কোনও রাজার সংশ্রয় কামনা করবেন। আবার যদি কোনও কারণে বিজিগীষু রাজাকে মিত্র প্রভৃতির সহায়তা লাভের অপেক্ষায় থাকতে হয় তাহলে কৌটিল্যের পরামর্শ হল তখন বিজিগীষু রাজা “দ্বৈধীভাব” অবলম্বন করবেন—
পরস্পরাদ্ ভীযমানঃ সন্দধীত। অভ্যুচ্চীযমানো বিগৃহ্নীযা। ন মাং পরো নাহং পরমুপহন্তুং শক্ত ইত্যাসীত। গুণাতিশযযুক্তো যাযাৎ। শক্তিহীনঃ সংশ্রযেত। সহাযসাধ্যে কর্মে দ্বৈধীভাবং গচ্ছেদ্। (ঐ ৭/১)
এই সব ভেবেই দমনক বলে, পিঙ্গলকের কাছে গিয়ে তার ভয়ের কারণ সবটা বুঝে নিজের হারিয়ে যাওয়া মন্ত্রিপদ ফিরে পাওয়ার জন্য “সন্ধি”, “বিগ্রহ”, “যান”, “আসন”, “সংশ্রয়” এবং “দ্বৈধীভাব”—এই ষাড্গুণ্যের মধ্যে কোনটিকে প্রয়োগ করতে হবে, সেটা চিন্তা করতে হবে।
করটক তখন বলে, ভাই দমনক! তুমি কেমন করে বুঝলে যে আমাদের রাজা পিঙ্গলক ভয় পেয়ে আছে?
দমনক তখন ভাই করটককে কিছুটা ঠোকা দিয়েই বলে, ভাইরে মুখে উচ্চারণ করে বললে তো হাতি-ঘোড়াও বুঝতে পারে। তোমার মতো বুদ্ধিমানের সিংহের হাব-ভাব দেখেই এটা বোঝা উচিত ছিল। সমঝদারদের জন্য তো ইশারাই যথেষ্ট—
“অনুক্তমপ্যুহতি পণ্ডিতো জনঃ পরেঙ্গিতজ্ঞানফলা হি বুদ্ধযঃ”।
এমনকিস্বয়ং মনু মহারাজও বলেছেন—
আকারৈরিঙ্গিতৈর্গত্যা চেষ্টযা ভাষণেন চ।
নেত্রবক্ত্রবিকারৈশ্চ লক্ষ্যন্তেঽন্তর্গত মনঃ।। (মিত্রভেদ ৪৫; মনুস্মৃতি ৮/২৬)
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৯: রাবণ-মারীচ সংবাদ এগোল কোন পথে?
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৮: বুধন উধাও
“তদদ্যৈনং ভযাকুলং প্রাপ্য স্ববুদ্ধিপ্রভাবেন নির্ভযং কৃত্বা বশীকৃত্য চ নিজাং সাচিব্যপদবীং সমাসাদযিষ্যামি”
ভয়ে থাকা এই সিংহকে নিজের বুদ্ধির জোরে নির্ভয় করে নিজের বশে এনে সচিবের পদটাকে আবার ফিরে পেতে হবে।
করটক তখন বলে, সে না হয় সবই বুঝলাম কিন্তু “সেবাধর্ম” বিষয়ে তো ভাই তোমার তেমন কোন অনভিজ্ঞতা নেই—“অনভিজ্ঞো ভবান্ সেবা ধর্মস্য”। তবে তুমি কীভাবে পিঙ্গলককে বশে আনতে পারবে? সেবাধর্ম বলতে এখানে তৈলমর্দনকেও বুঝতে হবে, যা করলে বা যা বললে প্রভু খুশি হন সে সব কিছুই সেবা ধর্মেরই অন্তর্গত।
দমনক তখন বলে, আমি সেবাধর্মে অনভিজ্ঞ হব কেন? শিশুকালে মন্ত্রী-পিতার কোলে থাকাকালীনই রাজনীতি শাস্ত্রবিদদের বহু আলোচনা আমি শুনেছি এই সেবাধর্ম সম্পর্কে। তাঁরা বলেন এই সোনায় ঢাকা পৃথিবীকে তিন প্রকারের লোকই শুধু ভোগ করতে পারেন, একজন যিনি বিদ্বান্,দ্বিতীয় জন যিনি শূরবীর অর্থাৎ বাহুবলে যিনি পৃথিবী জয় করেন আর অবশিষ্ট মানুষটি হলেন সেই ব্যক্তি যিনি “সেবাধর্ম” জানেন—
সুবর্ণপুষ্পিতাং পৃথ্বীং বিচিন্বন্তি নরাস্ত্রযঃ।
শূরশ্চ কৃতবিদ্যশ্চ যশ্চ জানাতি সেবিতুম্।।(মিত্রভেদ ৪৬)
এরপর দমনক এই “সেবাধর্ম” নিয়ে প্রাচীন ভারতের রাজনীতির গ্রন্থগুলোতে লেখা তত্ত্বগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরে করটককে রীতিমত নাতিদীর্ঘ একটি বক্তৃতা দিতে শুরু করল।—চলবে