ছবি: সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
শিশুকাল থেকে আপনি যদি এমন একটা পরিবারে বড় হয়ে ওঠেন যেখানে আপনার বাবা কিংবা মায়ের মধ্যে একজন ডাক্তার, তাহলে দেখবেন বহু রোগ বা ওষুধ সম্পর্কে আপনার অজান্তেই একটা সাধারণ জ্ঞান জন্মে যায়। তেমনই যে পরিবার সঙ্গীতচর্চায় গভীরভাবে মগ্ন হয় সে পরিবারের সন্তানদের দেখবেন শিশুকাল থেকেই তাদের কেমন সঙ্গীতের কান তৈরি হয়ে যায়। রাগ-রাগিনীর পথে স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে তারা। বিষয়টা হল, আপনার ভাবনা-চিন্তা, কর্মদক্ষতা বা রুচিশীলতা এসব কিছুই নির্ভর করে মূলত আপনি ছোটবেলা থেকে কোন পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছেন তার উপরেই। তাই জন্ম থেকেই যে মানুষটি এক ব্যবসায়ী পরিবারে বড় হয়ে উঠেছে, তার কাছে ব্যবসার ধারণাও থাকে বিভিন্ন রকমের। কারণ ছোটবেলা থেকেই “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ”—এই শুনেই বড় হয়েছে সে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেই যে একমাত্র প্রভূত ধনসংগ্রহ করা যেতে পারে, এটা নিশ্চয় আর আলাদা করে ব্যাখ্যা করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই আপনাদের কাছে।
যাইহোক, রাতের অন্ধকারে সুস্থির মনে সেই বণিকপুত্র বর্ধমান চিন্তা করে দেখলো যে মোট ছ’টি উপায়ে ধনসংগ্রহ করা যেতে পারে—
“ভিক্ষযা, নৃপসেবযা, কৃষিকর্মণা, বিদ্যোপার্জনেন, ব্যবহারেণ, বণিক্কর্মণা বা।”
সবার প্রথমে হল ভিক্ষা। মানে ধনসংগ্রহ করবার প্রথম উপায়টি হল ভিক্ষা করা। তবে ‘ভিক্ষা’ কথাটা শুনেই আবার নাক সিটকাবেন না যেন। আসলে সেটা আপনারও দোষ নয়; কারণ, ‘ভিক্ষা’—কথাটি শুনেই আপনার মনে রেল স্টেশনে বা মন্দিরের সামনে জীর্ণ পোশাক পরা দুর্দশাগ্রস্ত যে সমস্ত ভিক্ষুকের ছবিগুলো ভেসে ওঠে, সে ব্যাপারটা আন্দাজ করেই এমনটা বললাম। আসলে ‘ভিক্ষা’ বলতে আজকের দিনের প্যাকেজিং-এর ভাষায় যেটাকে আমরা ‘Crowd Funding’ বলি—এ তাই।
আজকাল ফেসবুক, ট্যুইটারের মতো সমাজমাধ্যমগুলোতেও বলতে পারেন এই ‘Crowd Funding’-এর বড় এক-একটা প্ল্যাটফর্ম। ইদানীং তো কর্পোরেট সেক্টরও নেমে গিয়েছে এই ‘Crowd Funding’-এর ব্যবসায়। সেখানে আপনি টাকা দিলে (পড়ুন ভিক্ষা দিলে) কর ছাড়ের ব্যবস্থাও করা আছে। আর অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আজকাল বহু সমাজসেবামূলক ভালো কাজ হচ্ছে এই ‘Crowd Finding’- এর মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গেই একটা খবর আপনাকে জানিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। ১৯৭৬ এই সালে এইরকম ‘Crowd Funding’ করেই বিখ্যাত পরিচালক শ্যাম বেনেগাল ‘মন্থন’ নামে একটি সিনেমা তৈরি করেছিলেন। মূলত ‘আমূল’ নিয়ে যে ‘White Revolution’ ডাঃ ভার্গিস কুরিয়েনের নেতৃত্বে গুজরাতে হয়েছিল—এ সিনেমার বিষয়ও ছিল সেইটাই।
দ্বিতীয় পন্থাটি হল রাজার সেবা করা বা সোজা কথায় যেটাকে আমরা সরকারি চাকরি বলি সেইটা। আজকের মতো সে আমলেও রাজকর্মচারী হওয়াটা বেশ লোভনীয় ব্যাপারই ছিল। অন্যান্য চাকরির থেকে রাজার চাকরিতে সে আমলেও রোজগার বা অন্যান্য সুযোগ ছিল অনেক বেশি। পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলোতে আমরা যতো প্রবেশ করতে শুরু করব, দেখতে পাবেন যে রাজার সেবা করবার জন্য কেমন প্রতিযোগিতা লেগে থাকতো লোকেদের মধ্যে। কিন্তু রাজকর্মচারী হয়েও যে খুব শান্তি আছে তা নয়। কারণ অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় যে, “বিতরতি নৃপো নোচিতম্”—রাজা তাঁর কর্মচারীদের তাদের কাজের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেন না। আজকের দিনেও সরকারী কর্মচারীদের কাছে গিয়ে একটু খোঁজ খবর নিলে আপনিও বুঝতেই পারবেন যে রাজা সব সময়েই নাকি অভাবে চলেন। বিলাস-ব্যসনে কিংবা দান-খয়রাতি করে রাজার রাজকীয় চালচলনটা বজায় থাকলেও যত কার্পণ্য রাজার তাঁর কর্মচারীদের প্রতি। এ অভিযোগ চিরকালীন। কখনই নাকি রাজা তার কর্মচারীদের উচিত বেতনটি দেন না।
উপার্জনের তৃতীয় পন্থাটি হল কৃষিকর্ম। কৃষি প্রধান দেশ ভারতে চাষবাস করা যে নিঃসন্দেহে অর্থকরী ছিল এ নিয়ে দ্বিমতের জায়গা নেই। কিন্তু “কৃষিঃ ক্লিষ্টা”—খুবই কষ্ট করতে হয় কৃষি থেকে লাভ পেতে গেলে। কৃষিতে লাভ হবে কিন্তু সেক্ষেত্রে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩: যার কাছে টাকা-পয়সা থাকে এ জগতে সেই হল পণ্ডিত
গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১: জলের তলায় তার শরীরের কোনও অস্তিত্ব নেই!
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৮: গৃহ-সহায়িকার পাঁচালি এবং আমাদের ভদ্র সমাজ
অজানার সন্ধানে: মিথ্যার সঙ্গে আপোষ না করে ছাড়েন চাকরি, দিন কাটে অনাহারে, কে এই ভারতের ফেভিকল ম্যান?
পঞ্চম উপায়টি হল সুদের কারবার করা, মানে ধারে টাকা খাটানো। শুদ্ধ বাংলায় যাকে বলে “কুসীদবৃত্তি”। কিন্তু তাতেও বিপদ—“কুসীদাদ্দারিদ্র্যং পরকরগতগ্রন্থিশমনাৎ”। কারণ, সুদের কারবারে পুঁজির টাকা পয়সা অন্যের হাতে দিতে হয় আর সে সব তাগাদা করে ফিরে পেতে ঝঞ্ঝাট প্রচুর। তাই ধন সংগ্রহের অবশিষ্ট শ্রেষ্ঠ উপায়টি হল ব্যবসা করা।
এবার মজার ব্যাপারটা আপনাকে খেয়াল করতে বলবো। দেখুন টাকাপয়সা করবার উপায়গুলোকে উল্টো দিক থেকে পর পর যদি আরেকবার দেখেন তাহলে দেখবেন ব্যবসা-বাণিজ্যই হল শ্রেষ্ঠ উপায়। তারপর হল সুদের কারবার, তৃতীয় স্থানে হল বিদ্যাচর্চা বা ‘Academic line’, সেটি না হলে তবে কৃষিকর্ম, না হলে রাজকর্মচারী, আর সবার শেষে রইল ভিক্ষাবৃত্তি।
মানেটা ধরতে পারলেন কি? যে রাজার ছেলেদের রাজনীতি শেখাতে এই গ্রন্থটি লেখা হয়েছিল, তার প্রথম গল্পেই তাঁদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হল যে, দেশে সহজে সম্পদ গড়ে ওঠে একমাত্র ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেই। তাহলে, এবার নিশ্চয়ই আপনাকে আলাদা করে আর ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে হবে না যে, একজন জ্ঞানী পণ্ডিত এবং ব্যবসায়ীর মধ্যে রাজা কাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন? পঞ্চতন্ত্রের গল্পে ঠিক এই কথাটা এতটা স্পষ্টভাবে বলা না থাকলেও, ধনসম্পদ বৃদ্ধি করবার উপায়গুলিকে পর পর বিশ্লেষণ করলেই আপনি সবটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরে যাবেন।
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৩: আচমকা রাতের পার্টিতে হাজির পুলিশ
দশভুজা: জীবনে যা কিছু করেছি, প্রত্যয়ের সঙ্গে করেছি: কানন দেবী/২
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৮: কোষার ভান্ডার ছররি থেকে কুঠাঘাট হয়ে কুরদার
বাণিজ্যশাস্ত্র বলে সাত ধরণের ব্যবসায় সহজে টাকা আসে—
তচ্চ বাণিজ্যং সপ্তবিত্তমর্থায স্যাৎ। তদ্যথা–গান্ধিকব্যবহারঃ, নিক্ষেপপ্রবেশঃ. গোষ্ঠিককর্ম, পরিচিতগ্রাহকাগমঃ, মিথ্যাক্রয়কথনং, কূটতুলামানম্, দেশান্তরাদ্ভাণ্ডানযনং বেতি।
প্রথমত: গন্ধদ্রব্যের ব্যবসায় লাভ ভালো থাকে। প্রাচীন ভারতে চন্দন আর সেই সঙ্গে আগরকাঠ, মানে যা দিয়ে অগুরু তৈরি হতো, সেগুলোর রপ্তানি হতো দূর দূরান্তে। বহু প্রাচীনকাল থেকেই গোলাপ, জুঁই, চন্দন এবং কস্তুরীমৃগের নাভি (অর্থাৎ Musk) দিয়ে সুগন্ধি (perfume) নির্মাণে ভারতীয় নির্মাতারা সুদক্ষ ছিলেন। আনুমানিক খ্রিস্টিয় ১ম শতাব্দীর গ্রন্থ বাত্স্যায়নের কামসূত্রে চৌষট্টি কলা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে “গন্ধযুক্তি” বলে একটি কলার উল্লেখ করেছেন, যেখানে এই গন্ধদ্রব্য প্রস্তুত করার প্রণালী সম্পর্কে আলোচনা করা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আবার এইটাও বলা হয়েছে যে নারী-পুরুষ উভয়কেই এই চৌষট্টি কলায় পারদর্শী হতে হবে; যার মধ্যে একটি কলা হল এইসব সুগন্ধি প্রস্তুত প্রণালী, যে সুগন্ধি পণ্যরূপে রেশমপথ এবং জলপথে পারস্য ও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে রপ্তানি করা হতো। তাহলে এবার নিশ্চয় বুঝতেই পারছেন যে, প্রাচীন ভারতের অভিজাত পরিবারগুলোতে এই গন্ধদ্রব্য প্রস্তুতের এক পরম্পরা এবং সংস্কৃতি বহু প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। খ্রিস্টিয় ৫ম শতাব্দীর তামিল কাব্য সিলাপ্পতিকারমের (Cilappatikāram) তথ্য অনুযায়ী তত্কালীন পাণ্ড্য রাজ্যের রাজধানী মাদুরাই চন্দন, কস্তুরী এবং অগুরুর গন্ধে এমন ভরপুর থাকতো যে তার সুঘ্রাণ বহুদূর থেকে পথিকরা পেতেন। মধ্যযুগীয় আরব ঐতিহাসিক ভূগোলবিদ আল-মাসূদি (খ্রিস্টিয় ৮৯৬–৯৫৬ অব্দ) তাঁর লেখা “কিতাব-আল-মুরাজ-আল-ধাহাব” গ্রন্থে বলেছেন যে, সাসানীয় সাম্রাজ্যের অধিপতি খসরু অনুশির্বনের (খ্রিস্টিয় ৫৩১–৫৭৯ অব্দ) সময়ে ভারত থেকে পারস্যে গন্ধদ্রব্য আমদানী করা হতো। আর নিশ্চয় আপনার কাছে ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজন নেই যে, এই গন্ধদ্রব্যের সে আমলে কতটা বাণিজ্যিক মূল্য ছিল। ফলে এর থেকে যে বিপুল অর্থাগম হতো তাতে সন্দেহ নেই। পঞ্চতন্ত্র পরিষ্কার তো বলছে—
পণ্যানাং গান্ধিকং পণ্যং কিমন্যৈঃ কাঞ্চনাদিভিঃ।
যত্রৈকেন চ যৎ ক্রীতং তচ্ছতেন প্রদীযতে।।
মানেটা হল, বিক্রি করার মতো পণ্যবস্তুর ব্যবসার মধ্যে গন্ধদ্রব্যের ব্যবসা সোনা-রূপোর থেকেও বেশি লাভ জনক। কারণ সেগুলো একে কিনে একশোতে বিক্রি করা যায়।