ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
যথা সময়ে টিট্টিভি সমুদ্রবেলায় বেশ কতগুলি ডিম পাড়ল। এরপর সারাদিনের খাবার-দাবারের খোঁজে সে যখন আশে পাশে উড়ে গেল, তখন সুযোগ বুঝে সমুদ্র তার ঢেউ দিয়ে সেই ডিমগুলোকে লুকিয়ে ফেলল। সায়াহ্নকালে সমুদ্রের বেলা ভূমিতে সেই প্রসব স্থানে ফিরে এসে ডিমগুলোকে দেখতে না পেয়ে টিট্টিভি কান্নাকাটি শুরু করল। মা যদি তার সন্তানদের খুঁজে না পায় তার যন্ত্রণা যে কেমন হতে পারে সে নিশ্চয়ই আর ব্যাখ্যা করে বোঝানোর দরকার নেই। সন্তানহারা টিট্টিভি বিলাপ করতে করতে ক্রুদ্ধ হয়ে টিট্টিভকে বললে, “ভো মূর্খ! কথিতমাসীন্মযা তে যৎ সমুদ্রবেলযাণ্ডানাং বিনাশো ভবিষ্যতি”। আমি বলেছিলাম যে, সমুদ্রের বেলাভূমিতে ডিম নষ্ট হয়ে যাবে। এ বার দূরে কোথাও চলো। শুধু তোমার মূর্খতা আর একগুঁয়েমির জন্যই তুমি আমার কথাগুলো শুনলে না। লোকে ঠিকই বলে—
স কূর্ম ইব দুর্বুদ্ধিঃ কাষ্ঠাদ্ ভ্রষ্টো বিনশ্যতি॥ (মিত্রভেদ ৩৪৪)
অর্থাৎ এ জগতে যে লোকেরা নিজের হিতৈষী বন্ধুদের কথা শোনে না তাদের সেই দুর্বুদ্ধি কচ্ছপটার মতো অবস্থা হয় যে মুখের কাঠটা ছেড়ে দেওয়ায় পড়ে মরে গিয়েছিল।
টিট্টিভ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কথমেতৎ”, ব্যাপারটা ঠিক কেমন? কী করে এমন হল?
টিট্টিভি তখন বলতে শুরু করল—
১৩: দুই হাঁস আর এক কচ্ছপের কাহিনি
কোনও এক নাম না জানা প্রদেশে বিশাল এক জলাশয় ছিল। সেখানে কম্বুগীব বলে এক কচ্ছপ বাস করতো। তার সংকট আর বিকট নামে দুই হাঁসের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব ছিল। সেই কম্বুগ্রীব প্রতিদিন সকাল বেলায় তাদের দু’ জনের সঙ্গে সরোবরের প্রান্তে ডাঙ্গায় উঠে রোদ পোয়াতো আর সেখানে আশা মুনি-ঋষিদের মুখে ধর্ম কথা শুনে আর বন্ধুদের সঙ্গে গল্প-গুজব করে ভালোই সময় কাটাতো। সূর্যাস্ত হলেই তারা নিজ নিজ বাসায় ফিরে আসতো। দিন কাটছিল এই ভাবেই। একবার সময়ে ঠিক-ঠাক বৃষ্টি না হওয়ায় সেই সরোবরের জল সূর্যের প্রখর তাপে শুকিয়ে যেতে শুরু করল। তখন সেই হাঁদ দুটি গভীর দুঃখের সঙ্গে কম্বুগ্রীবকে বললে, ওহে মিত্র! এই বিরাট জলাশয়ে তো কাদাজল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন আপনাদের দু’জনের কী হবে? জলের প্রাণী বলতে তো আর কিছুই পড়ে নেই, আপনার এখন কি হবে সেইসব ভেবেই আমরা ব্যাকুল হচ্ছি। খাবার-দাবারের সংস্থান তো কিছু একটা তো থাকতে হবে।
কম্বুগ্রীব বললে, বন্ধু! আপনারা সঠিকই অনুমান করেছেন, এই জলাভাবে সত্যিই আমি হয়তো বেঁচে থাকবো না। কিন্তু মুনি-ঋষিরা কি বলেন মনে আছে—
ধৈর্যাৎ কদাচিদ্গতিমাপ্নুযাৎ সঃ।
যথা সমুদ্রেঽপি চ পোতভঙ্গে
সাংযাত্রিকো বাঞ্ছতি তর্তুমেব॥ (ঐ, ৩৪৫)
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৭: যুদ্ধ করার থেকে তা এড়িয়ে যাওয়াটাও রণনীতিরই বড় অঙ্গ
এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৭: সুন্দরবনের নদীবাঁধের ভবিতব্য
নীচে গোলমাল শুনে কম্বুগ্রীব স্বভাবস্বরূপ ভঙ্গীতে বলতে গেল, “ভোঃ কিমেষ কোলাহলঃ”—ওহে! এতো সব কোলাহল কিসের?
সে বাক্য আর পূর্ণ হল না। মুখ থেকে সেই কাষ্ঠখণ্ডটি ছেড়ে যাওয়ায় উপর থেকে সে কচ্ছপটি নীচে পড়তেই নাগরিকরা তাকে খাবার জন্য টুকরো টুকরো করে ফেলল।
১৩তম কাহিনি সমাপ্ত।
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮১: কবির ‘গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ বৈষয়িক-কারণে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছিলেন
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা
কিছু সময় চিন্তা করে বোধিসত্ত্ব বললেন, মহারাজ! যাঁরা অতি মুখর এবং নিজের জিহ্বাকে সংযত রাখতে পারে না তাদের এইরকম কচ্ছপের মতনই দুর্দশা হয়ে থাকে।
রাজা বুঝলেন যে, বোধিসত্ত্ব তাঁকে উদ্দেশ্য করেই শেষের কথাগুলো বললেন। তিনি বোধিসত্ত্বকে জিজ্ঞাসা করলেন, পণ্ডিতবর! আপনি কি আমাকেই লক্ষ্য করে বললেন?
বোধিসত্ত্ব উত্তর দিলেন, “মহারাজ! আপনিই হন বা অন্য যে কেউ—অপরিমিতভাষীদের এইরকম দুর্গতিই ঘটে।
জাতকের কাহিনি অনুযায়ী বোধিসত্ত্ব এ ভাবে সমস্ত কথা খুলে বলায় রাজা নাকি মিতভাষী হয়েছিলেন।
সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১২: সুখলতা রাও— ছোটদের পরী
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি
নালন্দা থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টিয় ৭ম শতাব্দীর ভাস্কর্য।
টিট্টিভকে সবটা কাহিনি শুনিয়ে টিট্টিভী বললে, সেই জন্যই আমি বলেছিলাম, এ জগতে যে লোকেরা নিজের হিতৈষী বন্ধুদের কথা শোনে না তাদের সেই দুর্বুদ্ধি কচ্ছপটার মতন অবস্থা হয়। শুধু কি তাই? —
দ্বাবেতৌ সুখমেধতে যদ্ভবিষ্যো বিনশ্যতি॥ (ঐ, ৩৪৭)
অনাগতবিধাতা আর প্রত্যুত্পন্নমতি — এ দুজনেই সুখে থাকে, শুধু যদ্ভবিষ্যই বিনষ্ট হয়ে যায়।
টিট্টিভ বলল— “কথমেতৎ”। ব্যাপারটা ঠিক কি রকম?
টিট্টিভী তখন আবার বলতে শুরু করে।— চলবে