রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

সাপ বিষ উদ্গার করে। কিন্তু সাপের বিষের মজাটা হল যার উপর সে বিষ-প্রয়োগ করে মৃত্যু শুধু তারই হয়। কিন্তু দুষ্ট ব্যক্তি বিষ প্রয়োগ করেন একজনের কানে কিন্তু পতন ঘটান অন্যজনের—এইটুকুই শুধু ব্যতিক্রম একজন সাপ আর একজন দুষ্টলোকের বিষপ্রয়োগের ক্ষেত্রে।

সঞ্জীবক গভীরভাবে চিন্তা করে অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে গেল। চতুর দমনককে সে জিজ্ঞাসা করল, ওহে মিত্র! আপনার কি মনে হয়; এই পরিস্থিতিতে আমার ঠিক কী করা উচিত? তুমি আমার মিত্র! সেই জন্যই তোমার কাছে এই প্রশ্ন রাখলাম।

দমনক বললে, আমার তো মনে হয় এই পরিস্থিতিতে এই জায়গা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়াটাই হয়তো তোমার উচিত হবে। শাস্ত্রে বলে, কুপথগামী উদ্ধত স্বভাবের লোক, যিনি কোনটা কর্তব্য আর কোনটা নয় তার মধ্যে তফাৎ টুকুও করেন না। তিনি গুরুজন হলেও তাকে পরিত্যাগ করাটাই উচিত। কারণ, এইরকম মানুষের সঙ্গে সহাবস্থানটা খুব একটা সুবিধাজনক হয় না। যার উপর এনারা ক্রুদ্ধ হন তাদের অনায়াসে তারা বিপদের মুখে ফেলে দেয়। তাই দুষ্টস্বামীর সেবা করাটা কখনই উচিত হবে না তোমার।

সঞ্জীবক বলল, স্বামী পিঙ্গলক এখন আমার উপর ক্রুদ্ধ। তাই কোথাও পালিয়ে গিয়েও আমার এখন আর রক্ষা নেই। আসলে বলবান তথা বুদ্ধিমানের প্রতি যদি কোন অপরাধ হয়ে যায় তাহলে তার থেকে দূরে সরে গিয়েও আশ্বস্ত হওয়ার উপায় নেই। কারণ, বুদ্ধিমানের হাত খুব লম্বা হয়। এইরকম লোকেরা নিজের থেকে বহুদূরে থাকা শত্রুকেও হত্যা করতে সমর্থ হয়।

সঞ্জীবক বিষণ্ণ হয়ে বললে, আমার কাছে এখন আর তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পন্থা নেই। ধর্মশাস্ত্র বলে, স্বর্গফল কামনাকারী ব্যক্তিরা তীর্থযাত্রা, তপস্যা কিংবা সহস্র দান বা সদাচার পালন করেও সেই লোক লাভ করতে পারে না যা ধৈর্যবান তথা সুশীল ব্যক্তিরা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করে তৎক্ষণাৎ লাভ করে। পণ্ডিতেরা বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে কারও মৃত্যু হলে তার স্বর্গলাভ নিশ্চিত; তিনি যদি জীবিতও থাকেন, বিজয়ী হলে এই জগতেই তাঁর গুণকীর্তন সর্বত্র প্রসারিত হয়। পরলোকে স্বর্গ প্রাপ্তি বলুন বা ইহলোক যশ লাভ—এই দুটিই বীরেদের কপালেই একমাত্র জোটে। অন্য লোকেদের এমন সৌভাগ্য ঘটে না।

শাস্ত্রকারেরা বলেছেন সম্মুখযুদ্ধে আঘাতপ্রাপ্ত বীরপুরুষের মাথা থেকে যে রক্ত প্রবাহিত হয়ে তার মুখে প্রবেশ করে, সে রক্তপান করাটা সোমযাগে বিধিপূর্বক সোমরস পান করার মতোই পুণ্যজনক। শুধু কি এইটুকুই? শাস্ত্রকারেরা আরও বলেছেন, নিয়ম মেনে যাগযজ্ঞ, দান-ধ্যান, বিদ্বান্‌ ব্রাহ্মণদের পূজা, সর্বদক্ষিণ প্রভৃতি প্রভূত ব্যয়সাধ্য যজ্ঞ, আশ্রমে নিবাস বা হোম কিংবা চান্দ্রায়ণাদি ব্রত পালন করেও সেই ফল পাওয়া যায় না, যেটা সম্মুখ সমরে নিহত একজন বীরপুরুষ তৎক্ষণাৎ লাভ করেন— “তত্ফলমাহবে বিনিহতৈঃ সম্প্রাপ্যতে তৎক্ষণাৎ”।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৬: শুদ্ধ স্বভাবের রাজাও পরিত্যাজ্য যদি তাঁর পার্শ্বচরেরা শকুনের মতো কুটিল হন

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৫: সুন্দরবনের নদীবাঁধের অতীত

সঞ্জীবকের মুখে এইরকম সম্মুখ সমরের কথা শুনে দমনক একটু চিন্তায় পড়ে গেল— “যুদ্ধায কৃতনিশ্চযোঽযং দৃশ্যতে দুরাত্মা”। এ দুরাত্মা তো দেখছি যুদ্ধ করতে একেবারে কৃতসঙ্কল্প। যদি এর তীক্ষ্ণ শিং দিয়ে স্বামী পিঙ্গলকে এ প্রহার করে, তাহলে তো অনর্থ হয়ে যাবে। স্বামীর প্রাণনাশেরও সম্ভাবনা আছে। তাই পিঙ্গলকের সঙ্গে একে সরাসরি যুদ্ধ করতে দেওয়া যাবে না একে একেবারেই; বরং এমন কোনও বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে যাতে একে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অন্যত্র কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া যায়। সঞ্জীবককে বলল, “ভো মিত্র! সম্যগভিহিতং ভবতা”—কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন বন্ধু। কিন্তু স্বামী আর সেবকের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি বা মারামারি হওয়াটা ভালো দেখায় না। কথায় আছে—
বলবন্তং রিপুং দৃষ্ট্বা কিলাত্মানং প্রগোপযেৎ।
বলবদ্ভিশ্চ কর্তব্যা শরচ্চন্দ্রপ্রকাশতা॥ (মিত্রভেদ, ৩৩৬)

অর্থাৎ শত্রু যদি নিজের থেকে বলবান হয় তবে তার উচিত নিজেকে শত্রুর থেকে লুকিয়ে ফেলা। বলবান শত্রুর সঙ্গে বিবাদ করার চেয়ে দুর্বলের তার সঙ্গে সন্ধি করে নেওয়াটাই শ্রেয়। অন্যদিকে বলবানের কর্তব্য হল শরত্কালীন চন্দ্রমার মতো দুর্বলের কাছে নিজের পৌরুষকে প্রতিষ্ঠা করা। সোজা কথায় রাজনীতিতে অন্যের কাছে নিজের ক্ষমতা দেখানোটার প্রয়োজন আছে, তাহলে অনেক ক্ষুদ্র শত্রুর অকারণ ঝামেলা এড়িয়ে চলা যায়। আসলে যুদ্ধ করার থেকে যুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়াটাও রণনীতিরই একটা অঙ্গ।
আরও পড়ুন:

দাঁত তোলার পর আবার দাঁত সেট করছেন? সমস্যা ডেকে আনছেন না তো?

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি

পাঠক-পাঠিকাদের মহাভারতের উদ্যোগপর্বের আখ্যানকে স্মরণ করতে বলবো। কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গণে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে পাণ্ডবপক্ষ থেকে একাধিকবার দূত প্রেরণ করা হয়েছিল কৌরব নরেশ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যাতে শান্তি স্থাপনা করা যায়—যুদ্ধকে অতিক্রম করা যায়। এমনকি বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণও স্বয়ং শান্তিদূত হিসেবে পাঁচটি গ্রাম কামনা করেছিলেন মাত্র তাঁদের কাছে; কিন্তু সন্ধির সমস্তরকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কুমতি দুর্যোধন কারারুদ্ধ করবার চেষ্টা করেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ করে। যুদ্ধ অবধারিত হয়ে যায়। ফলে ইতিহাস অন্তত পাণ্ডব পক্ষকে দোষ দিতে পারে না যে যুদ্ধকে অতিক্রম করার প্রচেষ্টা তাঁরা করেননি, যে যুদ্ধে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। যুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়াও কিন্তু একটা যুদ্ধ কৌশল। কারণ যুদ্ধের ফলাফল কি হতে পারে সেটা কেউই সঠিক ভাবে বলতে পারেন না। তাই প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার আগে সন্ধির প্রচেষ্টা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দুষ্ট অভিসন্ধি থাকলেও দমনক কিন্তু সঞ্জীবককে যথার্থ উপদেশটাই দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, আলোকের ঝর্ণাধারায়

দমনক একটি গল্পের সূত্র দিয়ে বললে, যে ব্যক্তি শত্রুর পরাক্রমকে না বুঝেই যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে যায় সে নিজে বলবান হলেও শত্রুর কাছে সে নিশ্চিতভাবে পরাজিত হয়; যেমন সমুদ্র স্বয়ং টিট্টিভ (হট্টিটি) পক্ষীর কাছে পরাজিত হয়ে গিয়েছিলেন —
শত্রোর্বিক্রমজ্ঞাত্বা বৈরমারভতে হি যঃ।
স পরাভবমাপ্নোতি সমুদ্রটিট্টিভাদ্‌ যথা॥ (ঐ, ৩৩৭)


সঞ্জীবক বললে, ব্যাপারটা ঠিক কী রকম?
দমনক তখন বলতে শুরু করল—
 

১২: সমুদ্র আর টিট্টিভের কাহিনি

সমুদ্রতীরে এক টিট্টিভ দম্পতি বাস করতো। যথা সময়ে ঋতুকাল উপস্থিত হলে টিট্টিভীটি গর্ভধারণ করলো। ক্রমশ যখন তার প্রবসের সময় কাছে এল তখন তার স্বামী টিট্টিভকে বলল, “ভোঃ কান্ত, মম প্রসবসমযো বর্ততে। তদ্বিচিন্ত্যতাং কিমপি নিরুপদ্রবংস্থানম্” —হে প্রিয়! আমার প্রসব সময় আসন্ন। তাই একটি নির্জন আর নিরুপদ্রব স্থান খোঁজ করতে অনুরোধ করি, যেখানে আমি নিশ্চিন্তে ডিমগুলি পেড়ে তাতে তাপ দিতে পারবো। টিট্টিভটি বলল, হে কল্যাণী! এই সমুদ্রতটটি তো খুবই সুন্দর, রমণীয় এবং নির্জন, এখানেই তুমি অণ্ড প্রসব করো।

টিট্টিভীটি বললে, কিন্তু পূর্ণিমার দিনে এখানে তো সমুদ্রের ঢেউ এসে যায় যে ঢেউয়ের ধাক্কায় মৃত হাতিদেরও সে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাই আমার মনে হয় এই স্থানটা ডিম পাড়ার জন্য নিরাপদ নয়; দূরে কোনও নির্জনস্থান অনুসন্ধান করা দরকার।

আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৯: মহাকাব্যের রাক্ষস ও মানুষের কাহিনিতে আধুনিক জীবনচিত্রের প্রতিফলন রয়েছে কি?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৯: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

টিট্টিভীর কথা শুনে পুরুষ পাখিটি ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললে, হে কল্যাণী! তুমি যথার্থই বলেছো।“কা মাত্রা সমুদ্রস্য যা মম দূষযিষ্যতি প্রসূতিম্‌”। কিন্তু সমুদ্রের ক্ষমতাই বা কতটা যে আমার সন্তানদের ক্ষতি করতে পারবে? এমন কোন মূর্খ আছে যে পাখীদের গমনাগমনের পথ নিরুদ্ধকারী আকাশচুম্বী ধূমহীন প্রজ্জ্বলিত দারুণ অগ্নিতে স্বেচ্ছায় প্রবেশ করে? বা যমলোক দর্শনেচ্ছু এমন কোনও ব্যক্তি আছে কি যে মদমত্ত হস্তীর গণ্ডস্থল বিদারণ করে শ্রান্ত হয়ে নিদ্রিত পশুরাজ সিংহের ঘুম ভাঙাতে চায়? কিংবা ভালোমন্দ বিচারে অক্ষম এমন কেউ আছে কি যে সূক্ষ্ম তুষারকণায় পরিপূর্ণ অতীব শীতল প্রাতঃকালীন বায়ুর শীতলতাকে জল দিয়ে দূরীভূত করবার প্রচেষ্টা করে? হে টিট্টিভী! তুমি নিশ্চিন্তে এখানে অণ্ড প্রসব করো। তাছাড়া পণ্ডিতেরা এটাও বলেন—
যঃ পরাভবসন্ত্রস্তঃ স্বস্থানং সন্ত্যজেন্নরঃ।
তেন চেত্পুত্রিণী মাত্রা তদ্বন্ধ্যা কেন কথ্যতে?॥ (ঐ, ৩৪২)


অর্থাৎ যে ব্যক্তি পরাজয়ের ভয়ে নিজের স্থান ছেড়ে দেয়, সেইরকম ব্যক্তির জন্মদাত্রী মাতাকে বন্ধ্যা বলবো না তো আর কাকে বলবো?

একটা সামান্য টিট্টিভ-পাখীর ছোট মুখে এইরকম বড় বড় কথা শুনে সমুদ্রের ভারী রাগ হল। একটা পোকা-মাকড়ের মতন তুচ্ছ পাখির এত অভিমান? লোকে আসলে ঠিকই বলে, পাছে আকাশ টিট্টিভ-পাখির উপরে না পড়ে যায় তাই সে পা উপরে করে তাকে ঠেকাবার চেষ্টা করে; এর থেকে এইটাই প্রমাণ হয় যে এই সংসারে লোকে মূর্খ হোক বা পণ্ডিত—সকলেই নিজ নিজ কল্পনা অনুসারেই গর্ব করতে ওস্তাদ। তাই একটু মজা করেই না হয় এর ক্ষমতাটা দেখা যাক। আমি বরং এর ডিমগুলোকে
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content