বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

টাকা-পয়সার বিনিময়ে যে সেবকরা রাজার অধীনে [প্রতিরক্ষার] কাজ করেন, বলা যায় রাজা তাদের প্রাণটিকেও প্রায় কিনেই নেন। সেই কারণেই রাজনীতিবিদরাও মনে করেন রাজকার্যের প্রয়োজনে রাজা যদি তার সেবকদের প্রাণটিও গ্রহণ করেন তাহলেও নীতিগতভাবে সেটা খুব একটা অন্যায়ের হবে না।

শেয়ালের বক্তব্য শেষ হলে চিতা বাঘটি এসে তাকে সড়িয়ে বলল, আপনি কথাটা ভালোই বলেছেন। কিন্তু তাহলেও বলব আপনি স্বল্পকায়—কাকের থেকে আকারে আপনি কিছুটা বড় হলেও খুব একটা বিশাল শরীর কিন্তু আপনার নয়। এছাড়াও পণ্ডিতেরা বলেন—

নাভক্ষ্যং ভক্ষযেৎ প্রাজ্ঞঃ প্রাণৈঃ কণ্ঠগতৈরপি।
বিশেষাত্তদপি স্তোকং লোকদ্বযবিনাশকম্॥ (মিত্রভেদ, ৩১৯)


অর্থাৎ পণ্ডিত লোকেরা বলেন যে সব দ্রব্য ভোজনের অনুপযোগী প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও সেগুলি না খাওয়াটাই উচিত—প্রাজ্ঞ ব্যক্তি যাঁরা, তাঁরাও এটাই করেন; বিশেষতঃ সেই বিশেষ সময়ে, যখন খিদেও প্রবল এবং সেই খাওয়ার অযোগ্য বস্তুটিও পরিমানে স্বল্প, যা খেলে খিদেটুকুও মিটবে না। তাই অভক্ষ্য-ভক্ষণ করায় পরলোকের নিষ্কৃতি তো মিলবেই না, তার উপর সেটি পরিমানে সামান্য হওয়ায় কারণে এ জীবনে তৃপ্তিটুকুও পাবেন না। বলা যেতে পারে ইহকাল কিংবা পরকাল, কোনও কালেই শান্তি পাওয়া যাবে না।
কিছুটা সময় নিয়ে চিতা আবার বললে, ওহে মিত্র শৃগাল! আপনি আপনার কৌলিন্য দেখিয়েছেন, আপনার মহত্ত্বের পরিচয় আপনি দিয়েছেন। আমাদের রাজা মদোত্কটের যে আপনি একজন যথার্থ হিতৈষী, সে প্রমাণা আপনি দিয়েছেন। শাস্ত্রেও বলে— ঠিক এই কারণেই রাজারাও আপনার মতো কুলীন ব্যক্তিকেই রাজকীয় কার্য পরিচালনার জন্য নিযুক্ত করেন। কারণ আপনার মতো মানুষেরা কর্ম জীবনের শুরুতে বলুন কিংবা মধ্যে বা অন্তে, কোনও সময়েই বিকারগ্রস্ত হন না। অর্থাৎ স্বামীর প্রতি তাঁদের সদ্ভাব সর্বদা বিদ্যমান থাকে। কখনোই তাঁরা নিজস্বার্থে স্বামী বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ করেন না —
এতদর্থং কুলীনানাং নৃপাঃ কুর্বন্তি সংগ্রহম্।
আদিমধ্যাবসানেষু ন তে গচ্ছন্তি বিক্রিযাম্॥ (ঐ, ৩২০)


চিতাবাঘটি বন্ধু শেয়ালের প্রশংসা করে তাকে আবার বললেন, “তদপসরতঃ, যেনাহং স্বামিনং বিজ্ঞাপযামি”। তাহলে এ বার আপনি একটি সড়ে দাঁড়ান যাতে আমি এখন স্বামী মদোত্কটের কাছে কিছু নিবেদন করতে পারি।

শেয়াল সড়ে গেলে চিতাবাঘটি রাজার সামনে এসে তাঁকে প্রণাম করে বলল, হে রাজন! আপনি আজ আমার শরীরটিকে গ্রহণ করেই আপনার প্রাণযাত্রা নির্বাহ করুন। আমাকে গ্রহণ করে স্বর্গে আমার অক্ষয় বাসকে আপনি নিশ্চিত করুন। এই ভূপৃষ্ঠেও আপনি আমার যশ বৃদ্ধির সহায়ক হোক। আপনি মনের মধ্যে আর দ্বিধা রাখবেন না মহারাজ। সত্যি বলতে রাজকার্য করতে গিয়ে বা রাজার আজ্ঞা পালন করতে গিয়ে যদি কারো মৃত্যুও হয় তাহলে সেবকের এই সংসারে যশ প্রাপ্তি এবং পরলোকে অক্ষয় স্বর্গবাস নিশ্চিত।

কাক, শেয়াল আর চিতা বাঘের কাণ্ডকারখানা দেখে উষ্ট্র-ক্রথনকও চিন্তা করল—
“এতৈস্তাবত্সর্বৈরপি শোভনানি বাক্যানি প্রোক্তানি। ন চৈকোঽপি স্বামিনা বিনাশিত।”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৫: রাজা সবকিছু হাতে করে প্রজার মুখে তুলে দেবেন এমনটা ভাবার আর সময় নেই

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

এরা সকলেই স্বামীর কাছে গিয়ে ভালো ভালো কথা বলছে, স্বামীভক্তি দেখাচ্ছে, কিন্তু স্বামী এদের কিছূই করছেন না। তাই আমারও মনে হয় এইটাই সঠিক সময়, সকলের মতো তাঁর কাছে গিয়ে আমারও এখন দুটো ভালো ভালো কথা বলে এই প্রমাণটা দেওয়া উচিত যে আমিও তাঁর কতো কাছের। তাঁর জন্য আমিও কতোই না চিন্তা করি। এরা তিনজনও তখন নিশ্চয়ই আমাকে সমর্থন করবে।

মনে মনে এইসব চিন্তা করে ক্রথনক সকলের মাঝে এসে বললে, “ভোঃ সত্যমুক্তং ভবতা”। আপনারা সত্য কথাই বলেছেন, কিন্তু মুশকিলটা কী জানেন? আপনাদের তিনজনেরই নখ আছে। আপনারা নখায়ুধ যুক্ত, আমাদের স্বামী মদোত্কট যেমন; একে অপরের স্বজাতি আপনারা। তাই কি করে ভাবলেন যে উনি আপনাদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন? লোকে বলে—
মনসাপি স্বজাত্যানাং যোঽনিষ্টানি প্রচিন্তযেৎ।
ভবন্তি তস্য তান্যেব ইহ লোকে পরত্র চ॥ (ঐ, ৩২২)


অর্থাৎ মনে মনেও যিনি নিজের নিজের জাতির মানুষদের অনিষ্ট চিন্তা করেন তার ইহলোক বা পরলোক কোথাও সুখ মেলে না। সবটুকুই তার নষ্ট হয়ে যায়। তাই আপনারা এবার যদি একটু সড়ে দাঁড়ান আমি মহারাজকে কিছু নিবেদন করতে চাই।

সকলে ক্রথনককে রাজার কাছে আসবার জন্য পথ ছেড়ে দিলে মুহূর্তে। ক্রথনক মদোত্কটের সামনে এসে তাকে প্রমাণ নিবেদন করে বললেন, “স্বামিন্, এতে তাবদভক্ষ্যা ভবতাম্। তন্মম প্রাণৈঃ প্রাণযাত্রাং বিধীযতাম্” — হে রাজন্! এনারা সকলেই আপনার অভক্ষ্য। এদের খাওয়াটা আপনার উচিত হবে না। তাই আমার প্রাণ গ্রহণ করেই আপনি আপনার প্রাণযাত্রা নির্বাহ করুন। আমার উভয়লোকের প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করুন। পণ্ডিতেরা বলেন, হাজার যাগ-যজ্ঞ করলে যে গতি লাভ করা যায় একমাত্র শ্রেষ্ঠ সেবকই তার স্বামীর জন্য প্রাণত্যাগ করলে সেই গতি প্রাপ্ত হন। সে পরম ফল যোগীরাও লাভ করতে পারেন না।

ক্রথনক এইটুকু মাত্র বলবার সুযোগ পেয়েছিল। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই পাশের থেকে চিতা আর শেয়াল তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পেটটা দুখণ্ড করে দেয়। তখন সকলে মিলে তাকে পরম তৃপ্তি সহকারে কদিন ধরে ভক্ষণ করলো।
 

১১তম কাহিনি সমাপ্ত।

আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?

সঞ্জীবক গল্প শেষ করে দমনককে বললে, এই জন্যই আমি বলেছিলাম যে পণ্ডিত হোক বা মূর্খ, সকলেই ছলনা করে। তাই, হে ভদ্র দমনক! একটা বিষয় আমার কাছে একেবারে জলের মতো পরিষ্কার, তোমার এই রাজার পরিবারে চারিদিক থেকে নীচ লোকে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। আসলে চারিদিকে শকুনের মাঝে থাকা রাজহংস যেমন চাইলেও সুস্বভাবের হতে পারে না। অর্থাৎ চাইলেও তখন যেমন সেই রাজহংসের উত্তম গুণগুলি শকুনের দলের মাঝে বিকশিত হতে পারে না, তেমনই করে রাজার আশেপাশে থাকা তাঁর মন্ত্রী প্রভৃতি আধিকারিকেরা যদি দুষ্ট হয়। তবে তাদের মাঝে থেকে রাজাও সদাচারণ করতে পারেন না আর এটা সর্বজনবিদিত যে রাজা স্বয়ং সদাচারী না হলে তিনি প্রজাকেও খুশি রাখতে পারেন না। আর রাজনীতিবিদরা কি বলেন জানেন ভাই দমনক! তাঁরা বলেন—
গৃধ্রাকারোঽপি সেব্যঃ স্যাদ্ধংসাকারৈঃ সভাসদৈঃ।
হংসাকারোঽপি সন্ত্যাজ্যো গৃধ্রাকারৈঃ স তৈর্নৃপঃ॥ (ঐ, ৩২৫)


মানে রাজা যদি শকু্নের মতো কুটিল এবং কঠোর স্বভাবের হন কিন্তু তার সভাসদরা যদি হংসের মতো কোমল স্বভাবেরও হন, তাহলেও অবশ্যই তার সেবা করা উচিত। কিন্তু রাজা যদি হংসের মতো আকৃতি বিশিষ্ট শুদ্ধ মানুষ হন এবং তার পার্শ্ববর্তী অনুচরেরা যদি শকুনের মতো তঞ্চক হয়, তবে সে রাজাকে ত্যাগ করাই সঙ্গত। কারণ দুষ্ট অনুচরেরা রাজাকে ঘিরে রাখলে চাইলেও রাজা সুশাসন দিতে পারেন না। তিনি তখন সেই দুষ্টদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৮: ষাট-বাষট্টি, বড়োজোর সত্তর বছর বাঁচবেন রবীন্দ্রনাথ, বলেছিল এক গণৎকার

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সঞ্জীবক বিষণ্ণ মনে বললেন, সেইজন্য আমি নিশ্চিত যে কেউ নিশ্চয়ই আমাদের রাজা পিঙ্গলককে কেউ আমার বিরুদ্ধে প্রকুপিত করেছে। পাহাড়ের কঠিন পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কোমল জল যেমন সেই পাথরকেও ভেঙ্গে দিতে পারে, সেইরকমই ভেদবুদ্ধিতে কুশল দুষ্ট লোক যদি কাউকে খারপ প্রতিপন্ন করবার ইচ্ছায় রাজার কাছে সবসময় জপ করতে থাকে, তাহলে কোমল হৃদয়ও যে বিচলিত হতেই পারে। এতে আর আশ্চর্যের কী আছে? নিরন্তর কেউ যদি কারো কানের মধ্যে সর্বক্ষণ বিষ ঢালতে থাকে তাহলে সেই ব্যক্তির কি আর মাথা ঠিক থাকতে পারে? সেই অদূরদর্শী ব্যক্তির বুদ্ধিবিকার হওয়াই স্বাভাবিক। ঠিক যেমন কানের কাছে সংসারের অসারতার কথা শুনতে শুনতে লোকে ক্ষপনক অর্থাৎ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়ে যায়।

পাঠকদের বলবো, গল্প শুনতে শুনতে সেই সময়ের সামাজিক ইতিহাসটাকে কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না। এই পঞ্চতন্ত্র শুধু যে রাজনীতি-কূটনীতির কথা বলেছে তাই নয়, এটা কিন্তু একটা সময়ের দলিলও বটে। সুন্দর এই সংসারের অসারতার কথা পথে ঘাটে শুনে শুনে সে সময়ে লোকে যে সর্বধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়ে যাচ্ছেন। এটাকে সে সময়ে অধিকাংশ লোকেই কিন্তু কান ভাঙানোর মতো একটা ষড়যন্ত্র বলেই মনে করতেন। অন্তত পঞ্চতন্ত্রকার আমাদেরকে সেই খবরই দিচ্ছেন।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content