রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

নদী তীরের কচি সবুজ ঘাস খেয়ে পশুরাজ মদোৎকটের আশ্রয়ে থেকে বন্যজীবন ভালোই দিন কাটছিল ক্রথনকের। কিন্তু সময় কখনও একরকম থাকে না। একদিন এক বিশাল হাতির সঙ্গে যুদ্ধ হল মদোৎকটের। প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই হাতির তীক্ষ্ণ দাঁতের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে শয্যাশায়ী হল মদোৎকট আর সমস্যার শুরুও তখন থেকেই। ক্রমশ সে এমনই শক্তিহীন হয়ে গেল যে এক-পা হাঁটবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। শিকার ধরাও বন্ধ হয়ে গেল তার। ফলে কাক থেকে শুরু করে সিংহের অনুচর বাকি সব মাংসাশী প্রাণীরা সকলে খিদের জ্বালায় ছটফট করা শুরু করল— মন মেজাজ সকলেরই খারাপ। পেটে খাবার-দাবার না থাকলে যা হয় আর কি। তাদেরকে ডেকে সিংহ বলল, চুপচাপ এভাবে সকলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থেকো না — আত্মনির্ভর হও। রাজা সবকিছু হাতে করে তোমাদের মুখে তুলে দেবে এমনটা ভাবার আর সময় নেই, আমি এখন আহত, শক্তিহীন। বরং যাও, সকলে মিলে বনের মধ্যে গিয়ে পশু খুঁজে সেটাকে তাড়িয়ে আমার কাছে নিয়ে এসো; যাতে এই অবস্থাতেও সেটাকে মেরে তোমাদের একটা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি।

তখন উট ক্রথনককে সঙ্গে নিয়ে কাক, চিতা আর শেয়াল বনের মধ্যে এদিক-সেদিক উদ্দেশ্যহীনের মতন ঘুরে বেরোতে লাগল। কিন্তু কোথাও কোনও শিকার খুঁজে পেলো না। কাক আর শেয়ালে মিলে মিশে তখন গোপনে এক মন্ত্রণা করল। শেয়াল বলল, “ভো বাযস! কিং প্রভূতভ্রান্তেন?” চারিদিকে এ ভাবে পাগলের মতো ঘুরে হবেটা কি? এই ক্রথনক উটটা তো আছে— “তদেনং হত্বা প্রাণযাত্রাং কুর্মঃ”। এটাকেই মেরে প্রাণ রক্ষা করা যাক, উটের মাংস তো বেশ ভালোই হবে।

কাকটি সমর্থন জানিয়ে বলল— কথাটা আপনি মন্দ বলনি ভায়া! কিন্তু সমস্যাটা হল আমাদের স্বামী মদোত্কট তাকে অভয়-প্রদান করেছেন— “ন বধ্যোঽযমিতি”, একে তো মারা যাবে না ভাই।

শেয়াল তখন বলল—ওহে এসব নিয়ে আপনি একদম ভাববেন না। সিংহ মদোৎকটকে বলেই যা করার আমি করবো, দেখবেন স্বামী নিজেই তাকে কেমন হত্যা করে। আপনারা এখানেই থাকুন। আমি গিয়ে সিংহ মদোৎকটের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসি।

শেয়ালের কথায় সকলে বেশ বিস্মিত হল। শেয়াল মদোৎকটের কাছে নির্জনে গিয়ে বলল, হে রাজন্! সমস্ত জঙ্গল ঘুরেও বধযোগ্য একটা পশুও চোখে পড়লো না। আপনিই এবার বলুন কি করতে পারি? “সম্প্রতি বযং বুভুক্ষযা পদমেকং প্রচলিতুং ন শক্নুমঃ”—বেশ কিছুদিন খাওয়া-দাওয়া কিছুই জোটেনি; খিদের জ্বালায় এক পা চলবারও আর ক্ষমতা নেই আমাদের। কিন্তু তার থেকেও গুরুতর সমস্যা যেটা সেটা হল “দেবোঽপি পথ্যাশী বর্ততে”— আপনার নিজেরও এবার কিছু না কিছু খাওয়া প্রয়োজন। আপনি অনুমতি দিলে এই ক্রথনক-উটের মাংস দিয়েই আপনার একটা ভোজনের ব্যবস্থা করি।

সিংহ মদোৎকটক এইরকম কঠোর কথা শুনে রীতিমত ক্ষুব্ধ হয়ে শেয়ালকে বলল—“ধিক্ পাপাধম! যদ্যেবং ভূযোঽপি বদসি ততস্ত্বাং তত্ক্ষণমেব বধিষ্যামি।” ওরে পাপাধম! এইরকম কথা যদি আরেকবার শুনি তখনই তোকে হত্যা করবো। তাকে আমি অভয় দিয়েছি, তাকে কি করে হত্যা করব? এমন চিন্তা মনের মধ্যে আসাটাও মহাপাপ। পণ্ডিতরা বলেন—
ন গোপ্রদানং ন মহীপ্রদানং ন চান্নদানং হি তথা প্রধানম্।
যথা বদন্তীহ বুধাঃ প্রধানং সর্বপ্রদানেষ্বভযপ্রদানম্॥ (মিত্রভেদ, ৩১২)


মানেটা হল, গোদান, ভূমিদান বা অন্নদান— কোনওটাই এতটাও বড় কিছু নয়। কারণ, বিদ্যানরা বলেন এই সংসারে সকলে দানের থেকে বড়ো দান হল “অভয়দান”।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৪: রাজসহায়ে সুবিধা পাওয়া ব্যক্তিদের, রাজারই প্রয়োজনে বিপদের মুখে পড়তে হয়

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৭: পলায়নপর পঞ্চপাণ্ডব-ভীমসেনের গতিময়তায় কোন মহাভারতীয় দিগদর্শন?

মদোৎকটের কথা শুনে শেয়াল বললে— “স্বামিন্! যদ্যভযপ্রদাং দত্ত্বা বধঃ ক্রিযতে তদৈষ দোষো ভবতি।” হে রাজন্! আপনি সঠিকই বলেছেন। যদি কাউকে অভয়প্রদান করে তারপর বধ করা হয় সেটা নিশ্চয়ই দোষের হবে। “ততো যদি স স্বযমেবাত্মানং বধায নিযোজযতি তদ্বধ্যঃ।” কিন্তু সে যদি আপনার কাছে বধ হওয়ার জন্য নিজে থেকেই এসে নিজেকে উৎসর্গ করে, তাহলে ব্যাপারটা কিন্তু দোষের হবে না। আর এ প্রস্তাব যদি আপনার পছন্দ হয় না তাহলে বলব আমাদের মধ্যেই কাউকে হত্যা করে আপনি পথ্য করুন। আপনার কিছু একটা এবার অন্ততঃ খাওয়া দরকার, না হলে আপনার মৃত্যু নিশ্চিত। সত্যি কথা বলতে আপনার কিছু হয়ে গেলে আমাদের বেঁচে থেকে আর হবেটা কি, যদি প্রয়োজনে আপনার কোনও কাজেই না আসতে পারি? আপনার কিছু অনিষ্ট ঘটলে আমাদের অগ্নিতে প্রবেশ ছাড়া আর কোনও পথ দেখতে পাচ্ছি না! শাস্ত্রে বলে—
যস্মিন্ কুলে যঃ পুরুষঃ প্রধানঃ স সর্বযত্নৈঃ পরিরক্ষণীযঃ।
তস্মিন্ বিনষ্টে কুলসারভূতে ন নাভিষঙ্গে হ্যরযো বহন্তি॥ (ঐ, ৩১৪)

অর্থাৎ, পরিবারের প্রধান পুরুষ, যিনি সমস্ত পরিবারকে ধরে রেখেছেন, তাঁকে সব রকম ভাবে রক্ষা করা উচিত। কারণ তাঁর যদি কখনও রকম অনিষ্ট হয় তবে কুলনাশের সম্ভাবনা নিশ্চিত। এমনকি শত্রুরাও সে কুলকে সহজেই জয় করে নেয়।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১০: রেমন্ড কোপা এক কিংবদন্তি ফুটবল বাদশা

মদোৎকট সব শুনে বলল— “যদ্যেবং তত্কুরুষ্ব যদ্রোচতে”, তুমি যদি তাই মনে করো তাহলে যেটা সঠিক মনে হয় সেটাই করো।

সিংহের কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পেয়ে শেয়াল দ্রুত গিয়ে তার বাকি অনুচরেদের কাছে গিয়ে বলল, মহারাজের অন্তিম দশা আসন্ন। এখন এদিক-সেদিক ঘুরে সময় নষ্ট করার কোনোও মানেই হয় না। ওঁনাকে ছাড়া আমরা অনাথ, আমাদের রক্ষা করার মতন কেউ নেই। তাই আমার মনে হয় আমরা এক এক করে গিয়ে মৃত্যুপথ যাত্রী স্বামী মদোৎকটের কাছে নিজের নিজের শরীরকে সমর্পণ করি। আমাদের মধ্যে কাউকে যদি তিনি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে স্বামী সেবার ঋণ থেকে আমরা মুক্ত হবো।

শাস্ত্রেও বলে— প্রাণ থাকতেও যে ভৃত্যের চোখের সামনে তাঁর স্বামী যদি কোনও গুরুতর বিপদের মধ্যে ফেঁসে যান তাহলে সেই ভৃত্যের নরকে গমন তো নিশ্চিত। তাই আমাদের উচিত এখনই যাতে আমাদের কাউকে ভক্ষণ করে স্বামী মদোত্কট কিছু পথ্য গ্রহণ করতে পারেন তার ব্যবস্থা করা আর সেই কারণেই এই পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বামীর কাছে সমর্পণ করা ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই।

এটা যে নিছক একটা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয় সেটা নিশ্চয় পাঠকদের ব্যাখ্যা করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সকলে তখন অশ্রুপূর্ণ নয়নে মদোত্কটকে প্রমাণ করে তাঁর নিকটে আসন গ্রহণ করল। মদোৎকট তাঁদের দেখে বললেন, “ভোঃ প্রাপ্তং দৃষ্টং বা কিঞ্চিত্সত্ত্বম্” —কোনও জন্তু পাওয়া গেল কি?
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩০: গিরীশচন্দ্রের মা সারদা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬০: নতুন পথে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত

কাকটি প্রথমে মুখ খুলল। অত্যন্ত বিনম্রভাবে সে বলল, হে রাজন্! সকাল থেকে সর্বত্র আমরা ঘুড়ে বেরিয়েছি, জানোয়ার পাওয়া তো দূরের কথা চোখেও দেখতে পাইনি। তাই আমার অনুরোধ আজকে আমাকেই আপনি খেয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করুন। আমার প্রাণের বিনিময়ে আপনি যদি বেঁচে যান তাহলে আমার স্বর্গবাস নিশ্চিত। তাই দয়া করে আমার অনুরোধটি ফেলে দেবেন না, আপনার এই অবস্থায় ভোজন করাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পণ্ডিতেরা বলেন—
স্বাম্যর্থে যস্ত্যজেত্প্রাণান্ ভৃত্যো ভক্তিসমন্বিতঃ।
পরং স পদমাপ্নোতি জরামরণবর্জিতম্॥ (ঐ, ৩১৬)


অর্থাৎ যে সেবক স্বামীর প্রতি অত্যন্ত অনুরক্তি ও ভক্তিবশতঃ নিজের প্রাণ পর্যন্ত পরিত্যাগ করে সে জরামরণহীন পরম স্থান লাভ করে, তাতেই তার মুক্তি।

খেলাটা ছকে রাখাই ছিল। কাকের কথা শেষ হওয়ার আগেই শেয়াল এগিয়ে এলো। সে বলল— “ভোঃ স্বল্পকাযো ভবান্। তব ভক্ষণাৎ স্বামিনস্তাবৎ প্রাণযাত্রা ন ভবতি”, ওহে বন্ধু! আপনার শরীর অত্যন্ত ছোট; ওইটুকুতে স্বামী মদোৎকটের জীবনধারণে কোন সুবিধাই হবে না। এছাড়া কাকের মাংস খাওয়ার দোষও অনেক। এইটুকু মাংস খেয়ে শরীরের রস-ধাতুরও কিছু মাত্র পুষ্টি সাধন হয় না; তাই ওইটুকু মাংস খেয়ে লাভের লাভ কিছুই নেই, ক্ষুধাটুকুও মিটবে না। তাই শুধু স্বামীভক্তিতে তাঁর জন্য আপনার প্রাণ উৎসর্গ করাটা অকারণ হয়ে যাবে।

কিছু সময় থেকে সেই শেয়াল কাককে বলল, বন্ধু! আপনি আপনার স্বামীভক্তি দেখিয়েছেন আমাদের স্বামীর প্রতি আপনার জীবিকা জন্য যে ঋণ তার থেকে মুক্ত হয়েছেন আপনি। ইহলোকে আর পরলোকে সর্বত্রই আপনি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এবার আপনি একটু সরে দাঁড়ান; আমি স্বামীকে কিছু নিবেদন করতে চাই।

কাক সরে দাঁড়ালে শেয়াল সাদরে মদোৎকটকে প্রণাম করে বললে, হে রাজন্! আজ আমাকে ভক্ষণ করে আপনি প্রাণযাত্রা নির্বাহ করুন। আমার পরম পদপাপ্তি আপনি নিশ্চিত করুন যাতে নিশ্চিত স্বর্গফল লাভ করতে পারি।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content