শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

এই সংসার ভারী আশ্চর্য এক জায়গা। ভালোবেসে কাউকে কোনও উপকার করতে গেলে সেটাই কখনও কখনও হয়তো তার সঙ্গে শত্রুতার কারণ হয়। আবার জেনে শুনে অপকার করবার চেষ্টা করলেও বাস্তবে হয়তো উল্টে সেটা অন্যের প্রসন্নতারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তেমনই রাজা-মহারাজাদের মনমেজাজটাও বোঝাও দায়। তাই কোন কথাটা বা কোন কাজটা তাদের পছন্দ হবে আর কোনটা পছন্দ হবে না সেটা বোঝা খুবই মুশকিল। তাদের মন বড় বড় যোগীরাও বুঝে উঠতে পারেন না।

সঞ্জীবক মনের দুঃখে দমনককে বলল, একটা বিষয় আমার কাছে একেবারে জলের মতো পরিষ্কার। আমার উপর স্বামী পিঙ্গলকের কৃপাদৃষ্টিটা যে আশেপাশে থাকা অনেকেই সহ্য করতে পারছেন না। এটা আমি নিশ্চিত আর ঠিক সেই কারণেই স্বামী পিঙ্গলকে আমার বিরুদ্ধে কেউ কেউ প্ররোচিত করেছেন। না হলে আমার মতো নির্দোষের প্রতি এভাবে উনি কেন বলবেন। পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেন, একজন পতির যদি অনেক পত্নী থাকে, আর তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট একজনের প্রতি যদি পতির বিশেষ অনুরাগ বা প্রেম থাকে তবে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য সতীনরা ক্রুদ্ধ হন।

একইভাবে রাজাও যদি তার অনেক কর্মচারীদের মধ্যে নির্দিষ্টও কারও প্রতি অধিক পরিমাণে কৃপাদৃষ্টি প্রদান করেন, তবে অন্যান্য রাজকর্মচারীরাও সেই নির্দিষ্ট কর্মীর উপর ক্রুদ্ধ হন। সেই নির্দিষ্ট কর্মীর উপর থেকে যাতে স্বামীর কৃপাদৃষ্টি সরে যায় তার জন্য অন্যান্য কর্মচারীরা বিশেষভাবে যত্নবান হন। আসল ব্যাপারটা হল, যখন রাজার সামনে গুণী মানুষজন থাকেন তখন স্বাভাবিকভাবেই গুণহীনদের প্রতির তাঁর আর কৃপাদৃষ্টি বজায় থাকে না। শাস্ত্রে বলে—

গুণবত্তরপাত্রেণ ছাদ্যন্তে গুণিনাং গুণাঃ।
রাত্রৌ দীপশিখাকান্তির্ন ভানাবুদিতে সতি॥ (মিত্রভেদ ৩১০)

বিশিষ্ট গুণযুক্ত মানুষ সামনে থাকলে, যাঁরা স্বল্প গুণবান ব্যক্তি, তাঁরা আড়াল হয়ে যান। ঠিক যেমন প্রদীপের স্বল্প আলোর সৌন্দর্য রাত্রিতেই শোভা পায়। কিন্তু প্রভাতে সূর্য উদিত হলেই সে দীপের আলো ম্লান হয়ে যায়।
চতুর দমনক সঞ্জীবকের সব কথা শুনে কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ভো মিত্র! যদ্যেব তন্নাস্তি তে ভয়ম্।”—ওহে মিত্র! তুমি যদি সত্যিই নির্দোষ হয়ে থাকো তাহলে আমার মতে তোমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। তোমার প্রতি সেই দুষ্ট পিঙ্গলক এখন কিছুটা রেগে থাকলেও তোমার এই সুন্দর কথাগুলি তার রাগকে প্রশমিত করবে—এটা আমি নিশ্চিত।

দুঃখিত সঞ্জীবক তখন বললে, “ভো! ন যুক্তমুক্তং ভবতা”—ওহে! এই কথাটি কিন্তু আপনি সঠিক বললেন না। দুষ্টস্বভাবের ব্যক্তিরা ক্ষমতায় কিংবা চেহারা দেখতে সামান্য লাগলেও তাদের মাঝে থাকাটা উচিত নয়। কারণ ভালো-লোকজনকে তারা তাদের মাঝে টিকটে দেয় না; কোনও না কোনও উপায় বের করে তারা সেই নির্দোষ এবং নিষ্কলঙ্ক ব্যক্তিটিকে ধনে প্রাণে মারবেই। সেই ঘটনাটা জানেন তো?
বহবঃ পণ্ডিতাঃ ক্ষুদ্রাঃ সর্বে মাযোপজীবিনঃ।
কুর্যুঃ কৃত্যমকৃত্যং বা উষ্ট্রে কাকাদযো যথা।। (ঐ, ৩১১)

অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ, সে লেখাপড়া জানা পণ্ডিত হোক কিংবা ক্ষুদ্রবুদ্ধি, প্রায় সকলেই নিজ জীবন নির্বাহ করবার জন্য কপটের আশ্রয় নেন। এমনকি সময়ে অসময়ে কর্তব্যাকর্তব্যও বিচার করেন না তারা। ঠিক যেমন কাক-শেয়ালেরা সকলে মিলে উটের সঙ্গে করেছিল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৩: রাজসেবায় পুরস্কার মিলতেও পারে, নাও মিলতে পারে! কিন্তু সামান্য বিচ্যুতি ঘটলে রাজরোষে মৃত্যু নিশ্চিত

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার জীবন তৃষ্ণা

 

১১: উট, কাক, সিংহ, চিতা আর শেয়ালদের গল্প

কোনও এক জঙ্গলের গভীরে মদোত্কট নামে এক সিংহ বাস করতো। সে ছিল একেবারে স্বনামধন্য, উত্কট ছিল তার মদোন্মত্ততা —সবটাই চলতো তার খেয়ালের বশে। তার ছিল আবার তিনটি অনুচর —চিতা, কাক আর একটি শেয়াল। সিংহ মদোত্কট যেখানে যেখানে যেতো তারাও তিনজন তার সঙ্গে সঙ্গে চলতো। একবার বনের মধ্যে যখন তারা এদিক-সেদিক ঘোরা-ফেরা করছিল, সে সময়ে বণিকদলের মধ্যে থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি উটকে দেখতে পেলো। জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে সেই উটটি তখন ইতস্তত ঘুরতে ফিরে বেরাচ্ছে।

সিংহ হল— বনের প্রাণী, গ্রাম্য গৃহপালিত জন্তুদের সম্বন্ধে তার জ্ঞান কিছুটা হলেও কম আর উট যেহেতু গৃহপালিত, তাই সিংহের কাছে উট হলো একেবারে অভিনব একটি প্রাণী। এর আগে সে এমন প্রাণী দেখেনি। উটকে দেখে আশ্চর্য হয়ে সে তার অনুচরদের জিজ্ঞাসা করলো, “অহো! অপূর্বমিদং সত্ত্বম্। তজ্জ্ঞাযতাং কিমেতদারণ্যকং গ্রাম্যং বা।”—ওহে! এ-তো ভারী আশ্চর্য এক প্রাণী। তোমরা গিয়ে খবর নাও যে এ আরণ্যক হিংস্র প্রাণী? নাকি গ্রাম্য গৃহপালিত অহিংস প্রাণী?
সিংহের প্রশ্নের উত্তরে তার অনুচর কাকটি বলল, হে স্বামী! এই প্রাণীটি একটি গ্রাম্যপ্রাণী। একে উট বলে। এটি আপনার ভোজ্য। আপনি চাইলেই এটিকে হত্যা করে খেতে পারেন।

কাক এমন একটি প্রাণী যাকে বলা হয় বলিভূক্। গৃহস্থের বাড়ির এঁটো-কাঁটা খেয়েই সে থাকে। গ্রামেই তার বাস। দূরের নির্জন পথ দিয়ে পথিক যখন দূর দেশে যান তখন যদি সামনে কাক দেখেন তাহলে বুঝতে পারেন যে সামনে কোনও গৃহস্থ বাড়ি আছে। কাক বলতে পারেন গৃহস্থ বাড়িকে চিনিয়ে দেয়। সংস্কৃতের ছাত্ররা যখন কারক পড়েন তখন তাদের “উপলক্ষণে তৃতীয়া” বলে একটি সূত্র পড়তে হতো। সেখানে তাদের উদাহরণ হিসেবে পড়তে হতো “কাকৈঃ গৃহমদ্রাক্ষীৎ”, অর্থাৎ কাকের দ্বারা গৃহকে দেখলাম। কাক হল গৃহের চিহ্ন, কাক আছে মানেই সামনে গৃহ আছে। তাই কাকের কাছে গ্রাম্যপশুর খবর ঠিকঠাক থাকে। উটকে দেখেই সে তাই সিংহকে বলল যে এই পশু আপনার ভোজ্য।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৮: শুরু হল কঠিন জীবনচর্যা

বিচিত্রের বৈচিত্র, বরসে গা সাওন: স্মরণে উস্তাদ রাশিদ খান

সিংহ কাকের কথা শুনে কাককে ধিক্কার দিয়ে বলল, আমার বাড়িতে যাঁরা এসে উপস্থিত হন তাঁদের আমি হত্যা করি না। শাস্ত্রে বলে—
গৃহে শত্রুমপি প্রাপ্তং বিশ্বস্তমকুতোভযম্।
যো হন্যাত্তস্য পাপং স্যাচ্ছতব্রাহ্মণঘাতকম্॥ (ঐ, ৩১২)

গৃহস্বামীর উপর বিশ্বাস করে কোন শত্রুও যদি নির্ভয়ে গৃহে আসেন তবে তাকেও হত্যা করা অনুচিত। তাকে হত্যা করলে শতব্রাহ্মণ হত্যার পাপ লাগে। সিংহ আদেশ দিলেন, তাকে অভয় প্রদান করে আমার কাছে নিয়ে এসো, যাতে আমি তাকে তার এখানে আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারি।

তখন সিংহের অনুচরেরা সকলে মিলে সেই উটকে অভয় প্রদান করে নিয়ে এলো সিংহ মদোত্কটের কাছে। সেই উট তখন সিংহকে প্রণাম করে সেখানে বসলো, জানালো তার নাম ক্রথনক। কীভাবে সে বণিকদলের মধ্যে থেকে পথ হারিয়ে এই বনের মধ্যে প্রবেশ করলো সে সব বৃত্তান্তই সে সিংহের কাছে নিবেদন করলো।

সেই বিচিত্র প্রাণীটাকে দেখে সিংহের ভারী মায়া হল। সে তখন সেই উটকে বলল, ওহে ক্রথনক! তোমাকে গ্রামে ফিরে গিয়ে আবার বোঝা টানবার কষ্ট করতে হবে না—এখানে এই জঙ্গলেই নির্ভয়ে ঘুরে ফিরে মরকত মণির মতো সবুজ ঘাসপাতা খেয়ে আমার সঙ্গেই থাকো। তোমাকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩১: সুন্দরবনের ঐতিহ্য গঙ্গাসাগরমেলা ও কপিল মুনির আশ্রম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৫: প্রতিযোগিতা সর্বদা স্বাস্থ্যকর নয়, কদ্রুবিনতার শত্রুতায় কি তারই ইঙ্গিত?

ক্রথনক-উট দেখলো ব্যাপারটা মন্দ নয়। গ্রামে ফিরে গিয়ে বণিকের ভার বহন করবার মতন কষ্ট আর দুনিয়ায় নেই। তার চেয়ে বেশ এখানেই যদি অনায়াসে এতো খাবার-দাবার আর সম্মান জোটে তো ক্ষতি কি? তার উপরে বনের রাজা যেখানে স্বয়ং তাকে অভয়প্রদান করেছেন তাহলে তো চিন্তার দ্বিতীয় কোনও কারণই থাকতে পারেনা।

ক্রথনক প্রস্তাবটিকে সাগ্রহে স্বীকার করে সেই বনের মধ্যে নির্ভয়ে বিচরণ করতে লাগলেন। মজাটা হল, বিনা পরিশ্রমে শুধু রাজার সহায়ে যে সব ব্যক্তিরা অনেক কিছু সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন, রাজার কোনও প্রয়োজনে বা তাঁর নিজের ভাবমূর্তি বা স্বার্থসিদ্ধির জন্য সেই সমস্ত লোকেদেরকেই রাজা আগে বিপদের মুখে ঠেলে দেন। এমনকি কখনও কখনও সেইসমস্ত ব্যক্তিদেরকে মৃত্যু মুখেও ঠেলে দিতে দ্বিধা করেন না তিনি। এই ক্রথনক উটের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেই রকমই হয়েছিল। বিনা আয়াসে যখন সে রাজকীয় সুযোগ সুবিধা নিয়ে দিব্যি সুখে শান্তিতে ছিল তখন তার একবারও মনেও হয়নি যে জগতে সবকিছুরই দাম চুকাতে হয়।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content