ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
১০: চণ্ডরব-শেয়ালের গল্প
কোনও এক গভীর বনে চণ্ডরব নামে এক শেয়াল বাস করতো। সে একবার প্রচণ্ড খিদের চোটে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে কোনও এক নগরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলো আর তখনই সেই নগরে বসবাসকারী একদল কুকুর কোথা থেকে ছুটে এসে চিত্কার করতে করতে এসে তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরলো। মুহূর্তের একটু সুযোগ পেয়েই সেই কুকুরের দল তাদের তীক্ষ্ণ দাঁতে চণ্ডরবের পা-দুটো চিবোতে শুরু করল আর চণ্ডরবও তখন প্রাণভয়ে গিয়ে উপস্থিত হল এক রজকের বাড়িতে।
রজক হল যিনি বস্ত্র রঞ্জিত করেন। ধোপাকে সংস্কৃত-ভাষায় রজক বলা হয়। জামাকাপড় ধুয়ে যিনি তাকে রং করেন তিনিই রজক। তার বাড়িতে সাদা কাপড় ধোয়ার জন্য বড় বড় নীলের ভাণ্ড ছিল। কুকুরের তাড়া খেয়ে সেই চণ্ডরব গিয়ে পড়ল সেই নীলের ভাণ্ডের মধ্যে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ লুকিয়ে রইল সে সেই নীলভাণ্ডের মধ্যেই। তারপর সেই কুকুরের দল যখন অধৈর্য হয়ে সেখান থেকে চলে গেল তখন সে বেরিয়ে এল সেই নীলের জালার ম্ধ্যে থেকে। তার পুরো শরীর তখন নীল বর্ণের হয়ে গিয়েছে। কুকুরের ভয়ে সে দূরে অজানা এক গভীর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও শরীর থেকে নীল রঙটাকে তুলতে পারলো না সে।
ভগবান শঙ্করের নীলকণ্ঠের মতো নীল রঙের এই অদ্ভুত প্রাণীটি দেখে বনের যত বাঘ-সিংহ বা অন্যান্য যতো নেকড়ে বা চিতা বাঘেরা ছিল, সকলেই তাঁকে বিচিত্র কোনও এক প্রাণী মনে করে চারিদিকে পালাতে শুরু করল। কারণ এমন প্রাণী তারা আগে কখনও দেখেনি, তাই তারা জানেও না যে তার শক্তি বা ক্ষমতা কতখানি। পণ্ডিতেরা বলেন, যার আচার-আচরণ, বংশপরম্পরা কিংবা শারীরিক ক্ষমতা খবর কেউ জানে না, সেইরকম ব্যক্তিকে বেশী বিশ্বাস না করাই ভালো।
নীলবর্ণের চণ্ডরব তখন এদের সেই ভয়ের সুযোগটা নিয়ে সকলে ডেকে বলল, “ভো ভোঃ শ্বাপদাঃ। কিং যূযং মাং দৃষ্ট্বৈব সন্ত্রস্তা ব্রজথ? তন্ন ভেতব্যম্।” —ওহে শ্বাপদগণ। আমাকে দেখে এমন সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলে কেন? আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভগবান প্রজাপতি ব্রহ্মা আমাকে স্বয়ং হাতে করে নির্মাণ করে বললেন, হে বত্স্য! পশুরাজ্যে কোনও রাজা নেই। তাই আজ তোমায় আমি নির্মাণ করেছি। আজকে আমি তোমাকে পশুরাজ্যের রাজা হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। তোমার নাম হোক ককুদ্দ্রুম। “ততো গত্বা ক্ষিতিতলে তান্ সর্বান্ পরিপালয”— যাও সেখানে গিয়ে তাদের পরিপালন করো।
চণ্ডরব কিছুক্ষণ থেমে বললেন, হে পশুগণ! প্রজাপতি ব্রহ্মার আদেশ মেনেই তোমাদের পালন করতে আজ আমি এখানে এসেছি— “ততোঽহমত্রাগতঃ”। আমার ছত্রছায়ায় থেকে তোমরা সকলে জীবন অতিবাহিত করো, আমি রাজা ককুদ্দ্রুম আজ থেকে তিন লোকের রাজা।
স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা একে রাজা করে পাঠিয়েছেন শোনবার পর কেউ আর তার বিরোধিতা করল না। বাঘ বললে, হে প্রভু! আপনি আজ্ঞা করুন।
অন্যান্য সকল জন্তুরাও ককুদ্দ্রুমরূপী সেই চণ্ডরবের কাছে এসে তাঁর আজ্ঞা পালনের জন্য তাঁকে ঘিরে বসল। সে ককুদ্দ্রুম তখন সিংহকে দিলেন অমাত্যপদ, বাঘকে দিলেন শয্যা পালকের দ্বায়িত্ব। চিতাবাঘের উপর দ্বায়িত্ব পড়ল তাম্বুলবাহকের আর নেকড়েদেরকে তিনি দ্বারপাল হিসেবে পাহারায় নিযুক্ত করলেন। কিন্তু নিজের আত্মীয়-পরিজন অন্যান্য শেয়ালদের সঙ্গে কোনও কথাবার্তা বলতো না সে। বরং উল্টে সব শেয়ালদেরকে গলাধাক্কা দিয়ে সে বাইরে বের করে দিলো, পাছে তার আসল সত্যটা বনের অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে প্রকাশ হয়ে যায় সেই ভয়ে। সব বাঘ-সিংহরা তাদের শিকার এনে ককুদ্দ্রুমের সামনে রাখতো এবং সেই ককুদ্দ্রুম যথার্থ রাজধর্মানুসারে সেটা ভাগ করে দিতেন বাকি পশুদের মধ্যে।
দিন চলছিল এইভাবেই। কিন্তু মিথ্যা বেশিদিন চাপা থাকে না। একদিন সভামধ্যে সেই ককুদ্দ্রুম বসে আছে সকল পার্শ্বদ পরিবৃত হয়ে আর ঠিক সেই সময়েই দূরে থেকে সে শুনতে পেল শেয়ালের ডাক—আর যায় কোথায়? অভ্যাস বসে সেও পুলকিত শরীরে আনন্দের বশে হুক্কা-হুয়া বলে ডেকে উঠল। বাঘ-সিংহ বা নেকড়েদের বুঝতে এতোটুকু অসুবিধা হল না যে সে একটি নিতান্ত শেয়াল ছাড়া আর কিছুই নয়। নিমেষের মধ্যে তারা ছিঁড়ে খেলো তাকে।
১০ম কাহিনি সমাপ্ত
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩১: উপদেশ দিয়েও কোনও ব্যক্তির স্বভাবকে কখনও পরিবর্তন করা যায় না
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’
পিঙ্গলক গোটাটা কাহিনিটা শুনে বলল, “ভো দমনক! কঃ প্রত্যযোঽত্র বিষযে, যৎ স মমোপরি দুষ্টবুদ্ধিঃ”, কি প্রমাণ আছে যে সেই সঞ্জীবক আমাকে শত্রুতার নজরে দেখে? আমার প্রতি সে যে দুষ্টবুদ্ধি পোষণ করে -এর প্রমাণ কি?
দমনক বললে, আজকেই সে আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করে বলেছে যে সকালেই আজ পিঙ্গলককে সে হত্যা করবে। তাই প্রমাণ আপনি আজকেই পাবেন। আজ সকালবেলায় যখন সেই সঞ্জীবক আপনার কাছে লাল আরক্ত নেত্রে এদিক-ওদিন দেখতে দেখতে কোনও এক অনুচিত স্থানে আপনাকে ডেকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকাবে, তখন আপনার যেটা মনে হয় সেটাই করবেন। পিঙ্গলক সব শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেল।
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে
আগচ্ছন্তি গৃহে যেষাং কার্যার্থং সুহৃদো জনাঃ।। (মিত্রভেদ ২৮৫)
অর্থাৎ এই ভূতলে সেই ব্যক্তিই ধন্য, সেই হলো বিবেকশীল ব্যক্তি এবং সভ্য যার ঘরে বন্ধুরা কোনও কাজের জন্য প্রার্থী হয়ে আসতে পারেন।
দমনক তখন বলল, ওহে বন্ধু! সেবক যারা তাদের ভালোমন্দের কথা আর কিই বা বলবো? যে লোক রাজার চাকুরি করেন, তার সুখ-সম্পত্তি সবটাই বলতে পারেন পরাধীন হয়ে যায়। তাদের চিত্তেও শান্তি থাকে কখনও, সবসময় তা অশান্ত আর চঞ্চল হয়ে থাকে। এমনকি নিজের জীবনের প্রতিও তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। রাজার চাকরি করার কি কম ঝক্কি? পণ্ডিতেরা বলেন, পণ্ডিতেরা তো সেই সমস্ত লোকেদের সোজাসুজি একরকম মূর্খই বলেছেন যারা রাজার চাকরি করেন, রাজকর্মচারী। কারণ তাদের নিজের শরীরের প্রতিও তাদের স্বাধীনতা থাকে না, রাজার প্রয়োজনে জীবন বিসর্জন দিতেও তাদের এগিয়ে যেতে হয়, এদেরকে মূর্খ ছাড়া আর কিই বা বলা যায়? সত্যি কথা বলতে, এ জগতে জন্ম নেওয়াটাই হলো একটা দুঃখ, পূর্বজন্মের কর্মফলের জন্যই তো এই ধরণীতলে প্রাণী বারে বারে জন্ম নেয়। ভারতীয় দর্শন তো সেই কথাই বলে। জীবন-যাপনই তো হলো দুঃখময়, তার উপর তাকে যদি জীবন যাপনের জন্য সেবাবৃত্তি বা চাকরী করতে হয় তাহলে তো এ দুঃখ পরম্পরা ছাড়া আর কিছু নয়। পণ্ডিতরা বলেন—
দরিদ্রো ব্যাধিতো মূর্খঃ প্রবাসী নিত্যসেবকঃ।। (ঐ, ২৮৯)
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন
এমনকি নিজের ঘুম পুরণ হওয়ার আগেই অন্যের জন্য কাজ করবার জন্য তাদের উঠে পড়তে হয়, বিশ্রামটুকুও নিজের হাতে থাকে না। সত্যি বলতে আমার মতে চাকরি যারা করেন তাদের অবস্থা কুকুরের থেকেও কঠিন; কুকুর তাও স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছে মতো এদিক-সেদিন চলাফেরা বা খাওয়া-দাওয়া করতে পারে, কিন্তু সেবকের ক্ষেত্রে সে সব কিছুই নির্ভর করে তার স্বামীর অনুমতির উপর।—চলবে।