ছবি: সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
রাজপুত্রদের রাজনীতিতে পারদর্শী করতেই বিষ্ণুশর্মা যে ‘পঞ্চতন্ত্র’ গ্রন্থটি লিখলেন, তার ‘প্রথম তন্ত্র’ বা ‘প্রথম অধ্যায়’টির নাম হল “মিত্রভেদ”। এ-প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা ভালো। আসলে ‘তন্ত্র’ শব্দটাকে সাধারণ অর্থে এখানে আপনাদের কাছে ‘অধ্যায়’ বলে উল্লেখ করলেও, বিংশ শতাব্দীর জার্মান পণ্ডিত জোহানস হের্টেল (Johannes Hertel) কিন্তু শব্দটাকে এতটা সরলীকরণ করতে নারাজ। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী ‘তন্ত্র’-শব্দটির অর্থ হল ‘Causes of Trickery’; যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘কৌশল বা প্রতারণার পন্থা’।
আসলে সংস্কৃত সাহিত্যে ‘তন্ত্র’ শব্দটা একটি পারিভাষিক শব্দ। শব্দটার মূলে আছে ‘তন্’-ধাতু, যার অর্থ হল ‘বিস্তার’। তাহলে এবার নিশ্চয়ই আপনাকে আলদা করে বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার নেই যে, এই “পঞ্চতন্ত্র” বইটাতে মূলত নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা ক্ষমতা অর্জন করবার জন্য বা তাকে রক্ষা করবার জন্য, পাঁচটা আলাদা-আলাদা কৌশল বা প্রতারণার পন্থাই ব্যাখ্যা করা রয়েছে, সবিস্তারে। তবে সেগুলো আলোচনা করা হয়েছে মূলত পশু-পাখির গল্পের মাধ্যমেই, অত্যন্ত সরল ও হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে। কারণ শিশুদের শেখানোই ছিল এই গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য। বড়দের জন্য তো কৌটিল্যের লেখা “অর্থশাস্ত্র”-এর মতো ভূবন বিখ্যাত বই আছেই। পরিণত বুদ্ধিতে সে গ্রন্থ পড়লেই তাঁদের সে উদ্দেশ্য সম্পন্ন হবে। কিন্তু এইটাও ঠিক যে শিশুকাল থেকেই ছল-চাতুরিতে ভরা এই সংসারে বাঁচতে গেলে তাদেরও এই সমস্ত বিষয়ে বাস্তব-জ্ঞান থাকাটা প্রয়োজন। সোজা কথায় চাতুরিপূর্ণ এই পৃথিবীতে আপনি নিজে ভালোভাবে থাকতে গেলে, খারাপ লোকগুলোকেও আপনার চিনতে শেখাটা দরকার, না হলে তাদের ছল-চাতুরির জালে জড়িয়ে পড়লে, আপনি ভালো থাকবেন না মোটেই।
বর্ধমানো মহান্ স্নেহঃ সিংহবৃষয়োর্বনে।
পিশুনেনাতিলুব্ধেন জম্বুকেন বিনাশিতঃ।।
এই শ্লোকটিকে “মিত্রভেদ” তন্ত্রের মূল কাহিনির সূত্রটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বিষ্ণুশর্মা বললেন, জঙ্গলে একবার এক সিংহ এবং ষাঁড়ের মধ্যে অত্যন্ত গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠছিল; কিন্তু অতিলোভী, দুষ্ট-স্বভাবের এক শেয়াল সেসব কিছু নষ্ট করে দেয়।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২: এখানে দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, বাণিজ্যনীতি এবং বৈদেশিক নীতির চর্চা করা হয়েছে
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮: রামচন্দ্রের কৈশোর, ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র: এক অনন্য উত্তরণ
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৪: ইল্বল-বাতাপির বিনাশ কাহিনি
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১২: সকালবেলার আগন্তুক
যেমন ধরুন এই শ্লোকটি। এটা শুনে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, সিংহ আর ষাঁড়, যাদের মধ্যে খাদ্যখাদকের সম্পর্ক, যাদের মধ্যে একজন গৃহপালিত আর একজন পশুরাজ, যিনি বলতে পারেন জঙ্গল দাপিয়ে বেড়ান, তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় কী করে? এতো অসম্ভব ব্যাপার। আগ্রহটা আপনার জন্মাবে এখান থেকেই। আর বন্ধুত্ব হলেও সেই বন্ধুত্ব একটা লোভী শেয়াল কী করে নষ্ট করে দিল, সেইটাও জানতে ইচ্ছে করবে আপনার। পঞ্চতন্ত্রকার সেই সুযোগটারই অপেক্ষা করেন এবং গল্প বলতে শুরু করেন।
আরেকটা কথাও এখানে জেনে রাখা দরকার যে, এই পশুচরিত্রগুলিকে নেহাত তুচ্ছ পশু বলে ভুল করে বসবেন না যেন। এগুলোর মাধ্যমে আসলে মানুষেরই বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে ইঙ্গিত করা হয়েছে; যা পশুচরিত্রের আড়ালে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সিংহ হল রাজার প্রতীক, বিক্রমী পুরুষের প্রতীক, উদ্যোগী শিল্পপতি থেকে শুরু করে উদ্যোমী রাজনীতিবিদ সকলেই সিংহের সমান বন্য, দুর্দমনীয় এক প্রতিভাসম্পন্ন হয়ে থাকেন, যে প্রতিভা তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু সেই বিক্রম বা দুর্দমনীয় উদ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলেও শেয়ালের মতো ধূর্ত মানুষের সংস্পর্শে এলে তাঁর সব কিছুই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বাস্তব জগতেও আমারা দেখি এই শেয়াল খুবই ধূর্ত এবং চালাক প্রকৃতির প্রাণী। পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলোতেও অনেক ক্ষেত্রেই আপনি দেখবেন সিংহরাজার মন্ত্রী হচ্ছে এই শেয়াল। রাজপুত্রদের এইটাই হয়তো অন্তরালে বিষ্ণুশর্মা নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন যে, লক্ষ্যসিদ্ধির জন্য শুধু পুরুষসিংহের মতো উদ্যমটাই সব নয়, শেয়ালের মতো ধূর্তদেরও চিনে নিতে হবে তাদেরকেই। এমনকি যে মন্ত্রীর উপর নির্ভর করে রাজ্যশাসন চলে, সেই মন্ত্রীটিও শেয়ালের মতো ধূর্ত কিনা সেইটাও বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। এসব বিষয় তাই বুঝতে গেলে একজন রাজাকে নিজেকে তৈরি করতে হয় শিশুকাল থেকেই আর পঞ্চতন্ত্রের উদ্দেশ্য এবং সার্থকতা সেখানেই। এ-সব কথা এখন না হয় থাক। এসব নিয়ে আলোচনার করবার অবসর পরেও আমরা পাবো অনেক। এখন বরং গল্পে ঢোকা যাক।
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৭: অর্থনীতির প্রান্তিকতায় নারী এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৭: গরমে পান্তা ভাত কি সত্যিই শরীর ঠান্ডা করে?
জগতে এমন কিছু জিনিষ নেই যা কিনা অর্থের দ্বারা লাভ করা যায় না। তাই যে কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তিরই ধনার্জনের বিষয়েই সর্বাগ্রে চিন্তা করা উচিত। বাস্তবেও দেখবেন যাঁর কাছে অর্থ বা ধন থাকে তাঁর ভ্রাতৃকুল কিংবা বন্ধু-বান্ধবের অভাব থাকে না। সকলেই সেই বিত্তবান পুরুষের সঙ্গে মিত্রতা করে থাকতে চায়, তাকে ভাই-ব্রাদার করতে চায়। এইটাই টাকা-পয়সার শক্তি। যাঁর কাছে ধন থাকে তিনিই পৌরুষগুণসম্পন্ন হয়ে থাকেন, সোজা কথায় তাঁর কথারই দাম থাকে। এক হাঁক ছাড়লে পাঁচ-ছ’টা লোক তখনই এসে তাঁর পাশে দাঁড়ায়। কারণ লোকেও চায় বিত্তবানের সঙ্গেই থাকতে, তাঁর সঙ্গে বিরোধিতায় না যেতে; আর সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হল “যস্যার্থাঃ স চ পণ্ডিতঃ”—যার কাছে টাকা-পয়সা থাকে জগতে সেই হল পণ্ডিত। কারণ জগতে এমন কোনও বিদ্যা বাকি থাকে না বা এমন কোনও দানবস্তু বা শিল্পকলার বিষয় বাকি থাকে না যেগুলি অর্থ যাচক লোকেরা ধনী ব্যক্তিদের স্তুতি করবার সময় ধনীদের সম্পর্কে বলেন না। বিষয়টা অনেকটা এইরকম যে অর্থ যাচক লোকেরা ধনীদের কাছে গিয়ে নিজের ইষ্ট সিদ্ধি করবার জন্য মূর্খ থেকে মূর্খতর ধনীদেরকেও সর্বগুণসম্পন্ন পণ্ডিত ব্যক্তি বলে স্তুতি করে থাকেন। এইটাই জগতের নিয়ম। তাই আপনার যে গুণ নেই, সহসা কেউ যদি আপনার সেই গুণ নিয়ে স্তুতি করে তাহলেই আপনাকে বুঝতে হবে যে নিশ্চয় সেই ব্যক্তির আপনার কাছে কিছু চাইবার জন্য এসেছে। যাচক ব্যক্তিদের চরিত্রই এমন। আর সবচেয়ে বাস্তব কথাটা হল, ধনসম্পদ থাকলে দেখবেন এই সংসারে যাঁরা আপনার আত্মীয় নন, তাঁরা পর্যন্ত আপনার আত্মীয় হয়ে যায়; আর অপরদিকে দরিদ্রব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনও দেখবেন তাঁর থেকে দূরে চলে যায়; তাঁর দুর্জনে পরিণত হয়। অর্থাৎ ধন থাকলেই সঙ্গে লোকবল থাকে, না থাকলেই আপনি একা। টাকাপয়সার এমনই মহিমা যে—
পূজ্যতে যদপূজ্যোঽপি যদগম্যোঽপি গম্যতে।
বন্দ্যতে যদবন্দ্যোঽপি স প্রভাবো ধনস্য চ।।
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৯: ‘মেরা কুছ সামান…’ গানে সুর দেওয়ার প্রস্তাবে গুলজারকে পত্রপাঠ বিদায় জানান পঞ্চম
স্বাদে-আহ্লাদে: খুদের টিফিনে কী দেবেন ভেবেই মাথায় হাত? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন মুগ ডালের চিল্লা!
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৭: কোরবা হয়ে সাতরেঙ্গা
গতবযসামপি পুংসাং যেষামর্থা ভবন্তি তরুণাঃ।
অর্থে তু যে হীনা বৃদ্ধাস্তে যৌবনেঽপি স্যুঃ।।
মানে বয়স হয়ে গেলেও যে ব্যক্তির কাছে ধনসম্পদ থাকে সে সর্বদা তরুণ অবস্থাতেই এ-জগতে স্বচ্ছন্দে ঘুড়ে বেড়ায়। অতিপরিশ্রমে শরীর ভাঙে না তাঁর, আর সেই সঙ্গে আধুনিক চিকিত্সা, মানসিক প্রশান্তি আর পুষ্টিকর খাদ্য—এসব কিছুই তাঁর তারুণ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করে; ইন্দ্রিয়ের ভোগক্ষমতাও থাকে তাঁর দীর্ঘকাল। কিন্তু যে ব্যক্তি যুবক অথচ ধনহীন—সাংসারিক অবসাদ, অপুষ্টি এবং জীবনধারণের জন্য অতিপরিশ্রমে সহজেই শরীর ভেঙে যায় তাঁর; অল্পবয়সেই বুড়িয়ে যায় সে। তাই ধনসম্পদ যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও, সে সম্পদ কী করে আরও বাড়ানো যেতে পারে বণিকপুত্র বর্ধমান সেসব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করতে শুরু করলো সে। আর তখনই বণিক পরিবারে বেড়ে ওঠায় শিশুকাল থেকে শোনা ধনসম্পদ সংগ্রহ করবার নানান উপায় নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করে সে।—চলবে