শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

ভারতভূমিতে অতি প্রাচীনকাল থেকেই রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা প্রজাকে গাভীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। গাভীকে যেমন দীর্ঘকাল ধরে পালনপোষণ করবার পর, সঠিক সময় হলে তবেই তাকে দোহন করতে হয়। বৃক্ষকে যত্ন করবার পর সময়ে তা ফুলে-ফলে ভরে উঠলে তবেই যেমন সেখান থেকে তা সংগ্রহ করতে হয়; ঠিক তেমনই ভাবে রাজারও উচিত প্রজাবর্গকে যথাযথ ভাবে পালন-পোষণ করে তবেই সময়ে তার কাছ থেকে কর সংগ্রহ করা। সঠিকভাবে পালনপোষণ করলে তবেই প্রজাবর্গের সমৃদ্ধি হয়। প্রজার সমৃদ্ধি মানেই রাজার সমৃদ্ধি।

তাই প্রজার মূলচ্ছেদ করে কর গ্রহণ করা মানে রাজা নিজেরও আগামীদিনে রোজগারের পথ বন্ধ করে দেওয়া। বীজকে সঠিকভাবে পালন পোষণ করলে বীজ যেমন একদিন সুবৃহৎ মহীরুহে পরিণত হয়ে সেটি ফল দান করে, তেমন প্রজাকেও রাজা সঠিকভাবে পালন পোষণ করলে সেও কর দানের উপযোগী হয়ে ওঠে—এইটা সত্য। ধান্য হোক বা হিরণ্য, সুখ-সমৃদ্ধি যা কিছু সবই রাজা প্রজার মাধ্যমেই লাভ করেন, তাই প্রজাকে সমূলে বিনষ্ট করা রাজার মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সকল পশুরা মিলিত হয়ে সিংহ ভাসুরককে শেষে বললেন—

লোকানুগ্রহকর্তারঃ প্রবর্ধন্তে নরেশ্বরা।
লোকানাং সক্ষযাচ্চৈব ক্ষযং যান্তি ন সংশয।। (মিত্রভেদ, ১৪৮)
অর্থাৎ যে রাজা সদা-সর্বদা প্রজাবর্গের হিত সাধনে নিমগ্ন তিনিই সমৃদ্ধিশালী হন; আর প্রজাবর্গের বিনাশ হলে রাজারও বিনাশ নিশ্চিত তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

সকল পশুদের কথা শুনে সিংহ ভাসুরক বললেন, “অহো সত্যমভিহিতং ভবদ্ভিঃ”—আপনারা সত্যই বলেছেন। কিন্তু এখানে আমি চুপ-চাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকলেও রোজ যদি একটা করে জন্তু আমার কাছে না আসে তাবে এটা নিশ্চিত যে আমি সকলে খেয়ে নেবো।

সকল পশুরা প্রতিজ্ঞা করলো। প্রতিদিন একটি করে জন্তু নির্দিষ্ট ক্রমে তারা ভাসুরক সিংহের কাছে পাঠাতো—হতে পারে সে হয়তো বৃদ্ধ, বা বৈরাগী কিংবা দুঃখী বা তার পুত্র ও পত্নী নাশের কারণে ভয়াকুল-বিমর্শ; এদের মধ্যে থেকে প্রতিদিন একজন করে অন্তত ঠিক মধ্যাহ্নে সিংহের ভোজনের আগে গিয়ে উপস্থিত হতো। অন্যান্য পশুরা নির্ভয়ে বনের মধ্যে ঘুরে বেরাতো। এমনিভাবেই সবকিছু চলছিল ঠিক-ঠাক।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২৭: যিনি বুদ্ধিমান তিনিই বলবান, বুদ্ধিহীনের বল বলে কিছু নেই

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৩: টাকির ভাসানের ব্যথা

একবার জাতিক্রমে এক ছোট্ট খরগোশের পালা পড়ল সেই সিংহের কাছে যাওয়ার। সকল জন্তুরা সেই খরগোশটিকে সিংহের কাছে পাঠালেও তার যাওয়ার যে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না সেটা নিশ্চয় আর ব্যাখ্যা করবার দরকার নেই। কিন্তু উপায়ন্তর না থাকায় খুব ধীরে ধীরে সেই সিংহের কাছে সে যেতে শুরু করলো। সারাটা সময় মাথার মধ্যে তার শুধু ঘুরছে কি করে ভাসুরক সিংহকে হত্যা করা যায়, কারণ এইভাবে মস্তান সেলামি দিয়ে দিয়ে আর কতোদিনই বা চলতে পারে? এর একটা স্থায়ী সমাধান হওয়াটা তো অন্তত দরকার। পথে যেতে যেতে সে একটা গভীর কুঁয়ো দেখতে পেলো। উঁকিঝুঁকি দিতেই অনেক গভীরে জলের মধ্যে তার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো। দেখেই মাথায় তার বুদ্ধি খুলে গেলো। মনে মনে চিন্তা করলো, “ভব্য উপাযোঽস্তি”—বাঃ এতো বেশ ভালো একটা উপায় পাওয়া গিয়েছে। “অহং ভাসুরকং ক্রুদ্ধং প্রকোপ্য স্ববুদ্ধ্যাস্মিন্ কুপে পাতযিষ্যামি”— আমি এই ভাসুরককে রাগিয়ে দিয়ে বুদ্ধি করে এই কুপের মধ্যে ফেলে দেবো। মাথার মধ্যে মুহূর্তে পরিকল্পনাগুলো সব ছকে ফেললো সে।
ইচ্ছে করে বেলাশেষে সে খরগোশ এসে উপস্থিত হলো ভাসুরক সিংহের কাছে। খাওয়ার বেলা পেরিয়ে যাওয়ায়, খিদেয় চোটে গলা শুকিয়ে তখন কণ্ঠস্বর তার দুর্বল হয়ে গিয়েছে। মাথা তখন তার গরম হয়ে গিয়েছে আগুনের মতো। জিভের জল টানতে টানতে সে তখন ভাবছিল, “অহো! প্রাতরাহারায নিঃসত্ত্বং বনং মযা কর্তব্যম্” —কাল সকালে উঠেই বনের সবকটা পশুকে মেরে আমি খাবো।

ঠিক সেই সময়েই খরগোশটা ধীরে ধীরে সিংহের কাছে গিয়ে প্রণাম করলে। তাকে দেখেই ভাসুরকের ক্রোধে যেন ঘৃতাহুতি পড়লো। ভয়ঙ্কর গর্জন করে বললো, “রে শশকাধম! একস্তাবৎ ত্বং লঘুঃ প্রাপ্তোঽপরতো বেলাতিক্রমেণ” —একে তো আকারে তুই এইটুকু তার উপর আবার দেরি করে এসেছিস। এই অপরাধের কারণে তোকে আজ মেরে কাল গোটা জঙ্গলকে আমি পশুহীন করবো। “মৃগকুলান্যুচ্ছেদযিষ্যামি”—সমস্ত মৃগকুলের মূলচ্ছেদ করবো আমি।

খরগোশটি ঠিক এইটাই চেয়েছিল। সিংহ যাতে ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়—এটাই সে চেয়েছিল।

খরগোশটি সবিনয়ে হাত জোড় করে বলল, হে স্বামী! এই দেরি হওয়ার জন্য আমার বা অন্যান্য জন্তুদের কোনও অপরাধ নেই। আপনি বললে আপনার কাছে আমি সবকুটু ব্যাখ্যা করতে পারি।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৪: পানমশলা খেলে ক্যানসার হয়?

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১২: ওই স্মৃতি ভুলতে কি আর পারি…

সিংহ বলল, আমার দাঁতের মধ্যে ঢোকবার আগে যা বলার আছে বলে ফেল।
খরগোশটি বললে, হে স্বামী! জাতিক্রমে আমার পালা আসায় আপনার মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য আমি যে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এটা বুঝতে পেরেই সকল জন্তুরা মিলে আমার মতন আরও চারটে খরগোশকে আমার সঙ্গে আপনার জন্য পাঠিয়েছিল। আমরা আপনার কাছে আসছিলাম কিন্তু পথে আরেকটি সিংহ গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে হুঙ্কার দিয়ে বললো, “রে ক্ব প্রস্থিতা যূযম্? অভীষ্টদেবতাং স্মরতঃ” — কোথায় চলেছিস তোরা? এবার অভীষ্ট দেবতাকে স্মরণ কর।

আমরা তখন ভয়ে ভয়ে বলেছিলাম যে আমরা স্বামী ভাসুরকের কাছে তার আহারের জন্য চলেছি। তার সঙ্গে আমাদের সকল পশুদের একটা “সময়ধর্ম” মানে চুক্তি আছে—প্রতিদিন আমাদের মধ্যে থেকে কেউ না কেউ তাঁর ভোজনের জন্য তাঁর কাছে ঠিক মধ্যাহ্ন সময়ে গিয়ে উপস্থিত হবো।

সেই সিংহটি তখন বলল, “যদ্যেবং তর্হি মদীযমেতদ্বনম্। মযা সহ সমযধর্মেণ সমস্তৈরপি শ্বাপদৈর্বর্ত্তিতব্যম্।” তাই যদি হয় তাহলে বলবো, এই বন আমার। আমার সঙ্গেই সমস্ত জন্তুদের চুক্তি করতে হবে। সে ভাসুরক তো একটা চোর – “চৌররূপী স ভাসুরকঃ” —সত্যিই সেই ভাসুরক যদি এই বনের রাজা হয় তাহলে চারটি খরগোশকে এখানে আমার কাছে জামানত হিসেবে রেখে ওর কাছে যা আর শীঘ্র আমার কাছে নিয়ে আয়। “যেন যঃ কশ্চিদাবযোর্মধ্যাৎ পরাক্রমেণ রাজা ভবিষ্যতি, স সর্বানেতান্ ভক্ষযিষ্যতি।” অর্থাৎ, আমাদের দুজনের মধ্যে পরাক্রমে যে নিজেকে রাজা বলে প্রতিপন্ন করতে পারবে সেই এই চারটিকে খাবে।
খরগোশটি বলল তাই আমি সেই সিংহের আদেশেই আপনার কাছে এসেছি। এই হলো আমার দেরী হওয়ার কারণ – এতে আমার কিংবা অন্য পশুদের কোনও দোষ নেই মহারাজ। এবার আপনি যা স্থির করবেন তাই হবে— “তদত্র স্বামী প্রমাণম্।”এক ভাসুরক এই সব শুনে বলল, ভদ্র! ঘটনা যদি এমনই হয় তাহলে সেই বাটপার সিংহটাকে একবার আমাকে দেখিয়ে দাও, যাতে জন্তুদের উপর তৈরি হওয়া এই ক্রোধটাকে আমি সেই সিংহটার উপরে প্রয়োগ করে নিজেকে একটু মানসিকভাবে শান্তি দিতে পারি। পণ্ডিতেরা বলেন—
ভূমিমিত্রং হিরণ্যং চ বিগ্রহস্য ফলত্রযম্।
নাস্ত্যেকমপি যদ্যেষাং ন তং কুর্যাৎ কথঞ্চন।। (ঐ, ২৪৯)


অর্থাৎ ভূমি, মিত্র এবং স্বর্ণ—এই তিনটের মধ্যে একটিরও যদি পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তবে নিষ্ফল বিবাদ বা যুদ্ধে কখনও লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। যে যুদ্ধে অত্যধিক ফল প্রাপ্তির সম্ভবনা থাকে না কিংবা যে বিবাদে পরাজয়ের আশঙ্কাই বেশি থাকে, বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত সেইরকম বিবাদের বীজ রোপন না করা।

খরগোশটি তখন বলল, হে স্বামী! আপনি সঠিক কথাই বলেছেন। “স্বভূমিহেতোঃ পরিভবাচ্চ যুধ্যন্তে ক্ষত্রিযাঃ” —ক্ষত্রিয়াগণ ভূমি অধিকারের জন্য এবং নিজের পরাজয়ের গ্লানিকে মেটাবার জন্যেই যুদ্ধে রত হন। কিন্তু সে দুর্মতি সিংহটি নিজের কেল্লার ভিতরেই থাকে। সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেই সে আমাদের পথ আটকেছিল। কিন্তু মুশকিলটা হল রাজনীতিজ্ঞরা বলেন যে, দুর্গের মধ্যে অবস্থিত শত্রুকে হারানো দুঃসাধ্য। বলা হয়—
ন গজানাং সহস্রেণ ন চ লক্ষেণ বাজিনাম্।
যৎ কৃত্যং সাধ্যতে রাজ্ঞাং দুর্গেণৈকেন সিদ্ধতি।। (ঐ, ২৫১)


অর্থাৎ হাজারখানা হাতি বা লক্ষাধিক ঘোড়া মিলে রাজা-মহারাজদের যে কাজ সিদ্ধ করতে পারে না একটা কেল্লা একাই রাজার সে কাজ সিদ্ধ করতে সমর্থ। দুর্গ প্রাকারে স্থিত একজন মাত্র ধনুর্ধর শত্রু সেনার একশো জন যোদ্ধাকে সামলে নিতে পারে। দুর্গ প্রাকার থেকে বাণ বর্ষণ করে একশো জন সৈন্যের সঙ্গে লড়াই করাটা তাদের পক্ষে কোনও ব্যাপারই না। এই কারণেই রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা সবাই সমস্বরে দুর্গের প্রশংসা করে থাকেন। প্রাচীনকালে হিরণ্যকশিপুরের ভয়ে ভীত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র নাকি দেবগুরু বৃহস্পতির নির্দেশের এবং বিশ্বকর্মার সহায়তায় দুর্গের নির্মাণ করেছিলেন। সেই ইন্দ্র নাকি এমন এক বরও প্রদান করেছিলেন, যে রাজা দুর্গে অবস্থান করবেন তিনি নিঃসন্দেহে বিজয়ী হবেন। তারপর থেকেই এই ধরণীতলে হাজার হাজার দুর্গ বানানো হয়েছে। খরগোশটি বলল—
দংষ্ট্রাবিরোহিতো নাগো মদহীনো যথা গজঃ।
সর্বেষাং জাযতে বশ্যো দুর্গহীনস্তথা নৃপঃ।। (ঐ, ২৫৫)
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২১: সুন্দরবনের সর্পদেবী মনসা

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২২: এদিক ওদিক বেড়ায় তবু ভুলের পাড়া বেড়ায় না

যেমন করে বিষদাঁত ভাঙা সাপ এবং মদহীন হাতী সকলের অধীন হয়ে যায় তেমনই ভাবে দুর্গ রহিত রাজাও সহজেই শত্রুদের অধীন হয়ে যান।
খরগোশের মুখে এমন কথা শুনে ভাসুরক সিংহ আরও রেগে গেলো। বলল, ভদ্র! দুর্গের মধ্যে থাকলেও সেই চোর সিংহটাকে আমায় দেখাও যাতে নিমেষে আমি তাকে মেরে ফেলতে পারি। কারণ শাস্ত্রে বলে—
জাতমাত্রং ন যঃ শত্রুং রোগং চ প্রশমং নযেৎ।
মহাবলোঽপি তেনৈব বৃদ্ধিং প্রাপ্য য হন্যতে।। (ঐ, ২৫৬)


জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই যে ব্যক্তি নিজের শত্রু বা শরীরের রোগকে প্রশমিত না করে থাকেন তিনি সমৃদ্ধিশালী ও মহাবলশালী হলেও সে রোগ বা শত্রুই তার মৃত্যুর কারণ হয়। নিজের ক্ষমতার দর্পে যে পুরুষ নির্বল এবং প্রভাবহীন শত্রুকে, যাকে প্রথম আমলেই বশে করে ফেলা সহজ ছিল, তাকে নিয়ন্ত্রিত বা নিঃশেষিত করে না, পরে সে শত্রুই একটি কঠিন রোগের মতন বৃদ্ধি হয়ে নিয়ন্ত্রণের অসাধ্য হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে পাঠকদের গরুড়পুরাণের একটি শ্লোকের দিকে দৃষ্টি দিতে বলবো যেখানে সেই বিখ্যাত উক্তিটি আছে—ঋণ, অগ্নি ও ব্যাধির শেষ রাখতে নেই, কারণ তারা আবার বেড়ে যেতে পারে।
ঋণশেষঞ্চাগ্বিশেষং শত্রুশেষং তথৈব চ।
পুনঃ পুনঃ প্রবর্দ্ধন্তে তস্মাচ্ছেষং ন কারযেৎ॥(গরুড়পুরাণ: পূর্বখণ্ড, ১১৫.৪৬)

—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content