ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
একদিন সেই কাঁকড়াটি বকবাবাজিকে বললে, মামা গো! আমার সঙ্গেই তো প্রথম আপনার স্নেহসম্ভাষণ হয়েছিল। অথচ সেই আমাকেই বাদ দিয়ে আপনি প্রতিদিন অন্যদেরই শুধু নিয়ে যাচ্ছেন। “তস্মাদদ্য মে প্রাণত্রাণং কুরু”—আজ আমাকে প্রাণে বাঁচতে সাহায্য করুন, আমাকেই নিয়ে চলুন আজ।
কাঁকড়াটির এমন আকুল অনুনয় শুনে সে দুষ্ট বকটি ভাবলো ভালোই হবে, রোজ রোজ এই মাছ খেতে খেতে অরুচি হয়ে গেল, “তদদ্যৈনং কুলীরকং ব্যঞ্জনস্থানে করোমি”, এটাকে আজ একটু শাক-সব্জি ভেবেই না হয় খাওয়া যাবে।
এইসব চিন্তা করে কাঁকড়াটিকে পিঠে নিয়ে বধ্যশিলার দিকে উড়ে চলল সেই বকটি। কাঁকড়াটি বকের পিঠে বসে দূর থেকে মাছের কাঁটার পাহাড়টি দেখতে পেল; আর সেগুলো যে মাছেরই কাঁটা সেটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না তাঁর। ভয়ে ভয়ে বককে সে জিজ্ঞাসা করল, মামা গো! সে জলাশয় আর কতোদূর? আমার ভার বহন করতে আপনার যে কষ্ট হচ্ছে খুবই, তাই জিজ্ঞাসা করছি।
সেই দুষ্ট বকটি তখন সেই কাঁকড়াটিকে সামান্য একটা জলচর মনে করে জলের বাইরে তার যে কিছুই করার ক্ষমতা নেই এইসব ভেবে মুচকি হেসে বললে, ওরে কুলিরক (কাঁকড়া)! কোথায় জলাশয়? এ তো আমার প্রাণযাত্রা বলতে পারো, জীবিকা; এগুলোকে খেয়েই তো বেঁচেবর্ত্তে রয়েছি। “তস্মাৎ স্মর্যতামাত্মনোঽভীষ্টদেবতা”, এবার নিজের অভীষ্ট দেবতাকে স্মরণ করো। “ত্বামপ্যস্যাং শিলাযাং নিক্ষিপ্য ভক্ষযিষ্যামি”, তোমাকেও এই বধ্যশিলায় আছড়ে মেরে আজ খাবো।
কাঁকড়াটির কাছে এসে সকলে এ ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে সে একটা বীরত্বের হাসি এসে বলল, “মূর্খাঃ সর্বে জলচরাস্তেন মিথ্যাবাদিনা বঞ্চযিত্বা নাতিদূরে শিলাতলে প্রক্ষিপ্য ভক্ষিতাঃ”। সে একটা ঠক আর জোচ্চোর! তোমাদের সকল জলচরকে মূর্খ পেয়ে সে ঠকিয়েছে। এই জলাশয়ের কাছেই এক পাথরে সকলকে নিয়ে গিয়ে আছড়ে মেরে সে খেতো। আমার ভাগ্য যে আমার আয়ু এখনও কিছুটা অবশিষ্ট আছে। ধাপ্পাবাজিটা ধরে ফেলায় আমি বেঁচে গিয়েছি। “তদলং সম্ভ্রমেণ। অধুনা সর্বজলচরাণাং ক্ষেমং ভবিষ্যতি।” এখন আর উদ্বিগ্ন হওয়ার আবশ্যকতা নেই। সমস্ত জলচরেরা এখন থেকে আমরা সুখেই থাকবো।
৭ম কাহিনি সমাপ্ত
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২৬: কৌশলে যে কাজ সিদ্ধি করা যায়, সে কাজ শুধু বলপ্রয়োগে সম্ভব নয়
গল্পের ঝুলি: শারদীয়ার গল্প-৪: সীমানা ছাড়ায়ে…
কাকটি তখন তার বন্ধু শেয়ালটিকে জিজ্ঞাসা করলে, “ভদ্র! তৎ কথয, কথং স দুষ্টসর্পো বধমুপৈষ্যতি?” উপায় বলো বন্ধু কী করে সেই দুষ্ট কেউটে সাপটাকে মারতে পারি?
শেয়ালটি বলল, বন্ধু! তোমাকে কোনও এক রাজার রাজধানীতে যেতে হবে। সেখানে কোনও এক অসাবধানী ধনী-ব্যক্তি, রাজা বা অমাত্যের সোনার হার বা গহনা চুরি করে এনে সেই সাপের কোটরে ফেলে দাও, যাতে সেই গয়নাটি তার বাসায় রাখবার কারণে সে মারা পড়ে।
সেই কথা শুনে তত্ক্ষণাৎ সেই কাকদম্পতি উড়লো রাজধানীর সন্ধানে। সেখানে একটি জলাশয়ের কাছে পৌঁছে তারা দেখলো যে রাজন্তঃপুরের স্ত্রীরা সেখানে জলক্রীড়ায় মগ্ন। জলাশয়ের পাশে সোনার হার, মুক্তার মালা আর যাবতীয় বস্ত্রাভরণ সব খুলে রেখে মনের সুখে তারা ক্রীড়ায় মত্ত। কাকপত্নীটি এতোটুকুও সময় নষ্ট না করে তাদের বস্ত্রাভরণের মাঝের থেকে একটা সোনার হার তুলে নিয়ে উড়লো তার বাসার দিকে। অন্তঃপুরের কঞ্চুকী আর নপুংসকেরা যাঁরা তাঁদের পাহারায় ছিলেন তাঁরাও সব পিছন পিছন ছুটলেন হাতে লাঠি-সোটা নিয়ে। কাকপত্নীটি সেই কেউটে সাপের কোটরে সোনার হারটা ফেলে দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। সেই রাজপুরুষেরা গাছে উঠে সোনার হার উদ্ধারে যখন সেই কোটরে উঁকি মারলো তখন কেউটা সাপটা ফনা তুলে বেরিয়ে এলো। তাকে তখন দেখা মাত্র সকলে লাঠি দিয়ে মেরে সোনার হারটিকে কোটর থেকে উদ্ধার করে রাজধানী ফিরে গেল। বায়স দম্পতিও নিশ্চিন্তে সেখানে বাস করতে লাগল।
দমনক বললেন, এই জন্যই আমি বলেছিলাম যে শত বলপ্রয়োগেও যে কাজ সিদ্ধ করা সম্ভব নয়, সেটা একমাত্র বুদ্ধি প্রয়োগ করেই করা সম্ভব। বুদ্ধিমানদের অসাধ্য বলে কিছু নেই। কারণ—
বনে সিংহো মদোন্মত্তঃ শশকেন নিপাতিতঃ।। (মিত্রভেদ, ২৩৭)
অর্থাৎ যিনি বুদ্ধিমান তিনিই বলবান, বুদ্ধিহীনের বল বলে কিছু নেই। যেমন বনের মদোন্মত্ত সিংহকেও বুদ্ধির বলে একটা সামান্য খরগোশ হত্যা করে সমর্থ হয়েছিল।
করটক বললে, “কথমেতৎ”। এ ঘটনাটি আবার কি রকম?
দমনক তখন আবার পরের গল্পটি ফেঁদে বসলো।
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
পরিযায়ী মন, পর্ব-১২: নেতারহাটের নাশপাতি বাগান
০৮. সিংহ আর খরগোশের গল্প
কোনও এক জঙ্গলে ভাসুরক নামে এক সিংহ ছিল। ভাসুরক শব্দটি এসেছে ভা-ধাতু থেকে যার অর্থ হল আভা, যেমন আলোর আভা। সোজা কথায় যার প্রভাব সর্বত্র বিদ্যমান। ভাসুর শব্দটিও এখান থেকেই এসেছে। অর্থাৎ সংসারে যার প্রভাব আছে অনেক। এই সিংহ ভাসুরকও তেমনই, সমগ্র জঙ্গলময় তার প্রভাব প্রতিপত্তি। সে অতি ভয়ঙ্কর। প্রতিদিন সে অসংখ্য পরিমানে হরিণ, খরগোশ মেরেও তৃপ্ত হতো না। একবার সেই বনের হরিণ, বরাহ, মহিষ, খরগোশ— এই সব পশুরা সকলে মিলিত হয়ে সেই সিংহ ভাসুরকের কাছে এসে বললেন, “স্বামিন্! কিমনেন সকলমৃগবধেন নিত্যমেব? যতস্তবৈকেনাপি মৃগেণ তৃপ্তির্ভবতি তৎ ক্রিযতামস্মাভিঃ সহ সমযধর্মঃ।” হে প্রভু! প্রতিদিন এতো পরিমাণে পশুবধ করে লাভ কী? যেখানে একটি পশুতেই আপনার ক্ষুধা নিবৃত্তি হয়ে যায়। তাই আমাদের সকলের প্রস্তাব আপনি আমাদের সঙ্গে একটি চুক্তি করুন “সময়নিবন্ধ”। আজ থেকে প্রতিদিন এখানে আসা সকল প্রাণীদের থেকে জাতিক্রমে একটি করে পশু আপনার ভোজনের জন্য আপনার কাছে এসে উপস্থিত হবে। এইভাবে আপনার জীবনযাপনের ক্লান্তিও থাকবে না আর আমাদের সমাজও সর্বনাশ হওয়ার থেকে রক্ষা পাবে। তাই রাজার যেটি প্রকৃত ধর্ম আপনি সেইটাই পালন করুন। এরপর পশুদের মুখপাত্ররা ভাসুরক সিংহকে বেশ কয়েকটি শোলোক শুনিয়ে রাজধর্মের বিষয়ে লম্বা চওড়া একটি উপদেশ দেয়। বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে কর গ্রহণ সংক্রান্ত যে নিয়ন্ত্রণের কথা শাস্ত্রকাররা বলেছেন এই উপদেশগুলো অনেকটা তারই সারাংশ।
রসাযনমিব প্রাজ্ঞঃ স পুষ্টিং পরমাং ব্রজেৎ।। (ঐ, ১৩৮)
যে বুদ্ধিমান রাজা নিজ সামর্থ্য অনুসারে ঔষধরস খাওয়ার মতো একটু একটু করে ধীরে রাজ্যকে উপভোগ করে সেই রাজা আর রাজ্যই সুপুষ্ট হয়, সমৃদ্ধ হয়। যেমন বৈদিক মন্ত্রপাঠ করে দুটো শুকনো কাঠ নিয়ম-মাফিক ঘর্ষণ করলে আগুন তৈরি হয়, তেমনই নিয়ম করে উর্বরভূমিতে বীজ বপন করলে সময়ে ধান্যাদি ফলও পাওয়া যায়। তাছাড়া পণ্ডিতেরা বলেন, রাজন্যবর্গ এই পৃথিবীতে প্রশংসনীয় হন একমাত্র নিয়মপূর্বক প্রজা পালনের মাধ্যমেই। পরলোকে স্বর্গফলেরও সঞ্চয় হয় তাঁদের। তাই প্রজাপীড়ন করলে রাজার ধর্মনাশও হয়ই, সেইসঙ্গে পাপ এবং বদনাম দুটিই হয়।
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৭: মা সারদার ভগবতী সাধনা
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১১: আমার নাম, তোমার নাম— তুং নাম, তুং নাম!
তস্যৈকা জাযতে তৃপ্তির্ন দ্বিতীযা কথঞ্চন।। (ঐ, ১৪২)
যে রাজা নিজের অবিচক্ষণতার কারণে নিরপরাধ প্রজাদের ছাগলের মতো কেটে হত্যা করে তার মাংস ভক্ষণ করেন তাতে সে রাজার একবারই মাত্র তৃপ্তি মেলে কিন্তু দ্বিতীয়বার তার থেকে কোনও কিছু আর পাওয়া যায় না। কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখলে দিনের পর দিন দুগ্ধরূপ অমৃতফল লাভ করা যায়। তাই প্রজাকে একেবারে সর্বশান্ত করে নিঃশেষ না করে তাকে একটু একটু করে ভোগ করলে প্রজাবৃদ্ধিও যেমন হবে তেমন রাজ্যই পুষ্ট ও সমৃদ্ধ হবে। কারণ প্রজাই হল রাজার সম্পদ। যেমন ফল লাভের আশায় মালি জল দিয়ে পরিচর্যা করে বীজ থেকে অঙ্কুর উদ্গমনের পর তাকে আরও বড়ো করে বৃক্ষে পরিণত করে, তেমনই ভাবে একজন রাজাও যদি যথাযথাভাবে রাজ্যফল ভোগ করতে চান তবে তাকে দান-মান সত্কার করে প্রজাবর্গকে সমৃদ্ধশালী করতে হয় — তাহলেই রাজার সমৃদ্ধি।—চলবে।