ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
বিষ্ণুবাহন গরুড় নারায়ণের কথায় কাঠের তৈরি গরুড় যানে প্রবেশ করলে নারায়ণও তখন সেই বিষ্ণুরূপী তাঁতিটির শরীরের প্রবেশ করলেন। ফলে নর আর নারায়ণের মধ্যে যুদ্ধের পরিণাম যে কী হতে পারে সে আর নতুন করে বলবার আর কিছুই নেই। শঙ্খচক্রগদাপদ্ম হাতে নিয়ে বিষ্ণুরূপী সেই তাঁতিটি গরুড় যানে চেপে খেলার ছলে কিছু সময়ের মধ্যেই সমস্ত প্রধান ক্ষত্রিয়দের নিস্তেজ করে দিলেন এবং সেই বিজিগীষু রাজাটিও সমস্ত সৈন্যবল পরিবৃত করে তাঁদেরকে হত্যা করে নিজেকে শত্রুহীন করে তুললেন।
লোকজন সব বলাবলি করতে লাগলেন, “অনেন বিষ্ণুজামাতৃপ্রভাবেণ সর্বে শক্রবো নিহতা”—জামাতা বিষ্ণুর প্রভাবেই এই রাজা তাঁর সকল শত্রুদের হত্যা করেছেন। তাঁতিটিও সমস্ত শত্রুদের নিহত দেখে আকাশ পথ থেকে যখন ভূমিতে অবতীর্ণ হলেন তখন রাজা, মন্ত্রী এবং সকল নগরবাসী সেই তাঁকে সামনে থেকে দেখে বিস্মৃত হলেন। এ যে প্রকৃত বিষ্ণু নয় সেটা বুঝতে বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না তাঁদের। কাঠের তৈরি সেই গরুড় যান দেখেও তারা খুব আশ্চর্য হলেন। তাঁতিটিও দেখলেন এইটাই সুসময়; সে সমস্ত বৃত্তান্ত শুরু থেকে রাজাকে খুলে বললেন। রাজা তখন সমস্ত শত্রু বধ করে আনন্দে ফুটছেন—সকল রাজ্যবাসী এবং মন্ত্রীপরিষদের সম্মুখে তিনি রাজকন্যাকে তাঁতিটির হাতে সমর্পণ করলেন এবং সেই তাঁতিটি চোখ-কান-নাক-জিহ্বা-ত্বক দিয়ে যা যা সুখ ভোগ করা যায় সে সবই ভোগ করতে লাগলেন।
৫ম কাহিনি সমাপ্ত
সাবধানী করটক বলল, “ভদ্র! অস্ত্যেবম্”—সব যেন তেমনই হয়। কিন্তু তাও আমার মনের থেকে ভয় কিছুতেই যাচ্ছে না, “যতো বুদ্ধিমান সঞ্জীবকো রৌদ্রশ্চ সিংহ”—সঞ্জীবক বোকা নয়, সে যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে আর ওদিকে সিংহও কিন্তু বলশালী আর সেইসঙ্গে ভয়ঙ্কর।বুদ্ধি আর বল যেখানে একত্রে অবস্থান করছে সেখানে শুধু বুদ্ধি প্রভাবেসিংহ-পিঙ্গলকেরথেকে বৃষ-সঞ্জীবককে আলাদা করাটা কিন্তু খুব সোজা কাজ নয়, শুধু বুদ্ধি থাকলেই সব হয় না।
করটককে আশ্বস্ত করে দমনক বলল, ভাইরে! কাজটা সোজা না হলেও আমি যে এই ষড়যন্ত্রে কৃতকার্য হবো এ নিয়ে আমার মনে কোনও সংশয়ই নেই। নীতিজ্ঞরা সেই কারণেই বলেছেন—
কাক্যা কনকসূত্রেণ কৃষ্ণসর্পো নিপাতিতঃ।।
অর্থাৎ, উপায় বা কৌশল অবলম্বন করে যে কাজ করা যায় সে কাজ কখনও শুধু বলপ্রয়োগ করে করা সম্ভব নয়, যেমন সেই কাকের পত্নীটি সোনার হার রেখে শুধু উপায় প্রয়োগ করেই সেই কেউটে সাপটাকে মেরে ফেলেছিল।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২৫: পরিবারের নেতা-মন্ত্রীদের সুবিধাবাদী আত্মীয়-বন্ধুরা তাঁর নাম ভাঙিয়ে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৯: সুন্দরবনের জঙ্গল-জননী বিশালাক্ষী
দমনক অপর আরেক কাহিনীর অবতারণা করলেন—
০৬: কাক-পত্নী ও কেউটে সাপের কাহিনি
কোনও এক নাম না জানা দেশে এক বিশাল বটগাছ ছিল। সেখানে এক কাক-দম্পতি বসবাস করতো। সেখানে একসময় সেই কাক-পত্নী বেশ কিছু ডিম প্রসব করেছিল আর ঠিক সে সময়েই সেই বিশাল বটগাছের কোটরের মধ্যে থেকে একটি কেউটে সাপ বেরিয়ে এসে সেই কাক-দম্পতীর অপত্যগুলিকে খেয়ে যেতে থাকে। তারা দু’জনে অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে তখন অন্য আরেক বৃক্ষের নিচের গর্ত-নিবাসী প্রতিবেশী শেয়াল-পণ্ডিতকে গিয়ে বলল, “ভদ্র! কিমেবংবিধে সঞ্জাত আবযোঃ কর্তব্যং ভবতি?” বন্ধু! আমাদের এখন ঠিক কি করা উচিত? রোজই সেই কৃষ্ণসর্পটি এসে আমাদের অপত্যদের খেয়ে যাচ্ছে। আপনি পণ্ডিত মানুষ, আপনাকেই কিছু একটা উপায় বাতলে দিতে হবে। শাস্ত্রে বলে—
সসর্পে চ গৃহে বাসঃ কথং স্যাত্তস্য নির্বৃতিঃ।।
অর্থাৎ নদীতীরে যার বাস বা যার পত্নী পরপুরুষে অনুরক্ত কিংবা যে ঘরে সাপ নিয়ে বসবাস করে, তার সুখ কোথায়? তাছাড়া নীতিজ্ঞরা তো স্পষ্টই বলেছেন—
যদ্গ্রামান্তে বসেৎ সর্পস্তস্য স্যাৎ প্রাণসংশয়ঃ।।
সসর্প গৃহে যদি বাস করতে হয় তবে সেখানে যে মৃত্যু নিশ্চিত এতে কোনও সন্দেহ নেই। এমনকি যে ব্যক্তির গ্রামের সীমান্তেও সাপ থাকে তারও প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা থাকে। তাই এই বৃক্ষে যারা আমরা একসঙ্গে বাসকরি আমাদের সকলেরই প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা নিরন্তর।
উপাযজ্ঞোঽল্পকাযোঽপি ন শূরৈঃ পরিভূযতে।।
শত্রুদের উপর “উপায়” প্রয়োগ করে যেভাবে বিজয় লাভ করা সম্ভব তেমনটা কিন্তু অস্ত্র প্রয়োগ করে সম্ভব হয় না মোটেই। উপায়জ্ঞ ক্ষ্ণীণ বল বা স্বল্প-কায় বিশিষ্টও হলেও শূরবীরেরাও তাঁকে পরাজিত করতে পারেন না। যেমন—
অতিলৌল্যাদ্ বকঃ কশ্চিন্ মৃতঃ কর্কটকগ্রহাৎ।।
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…
পরিযায়ী মন, পর্ব-১১: ঘরের কাছে জলমহল—চাঁদনি জলটুঙ্গি
বায়স-দম্পতি বললেন, এ ঘটনাটা আবার কি রকম —“কথমেতৎ”।
শেয়াল-পণ্ডিত তখন বলতে শুরু করলো—
০৬.০১. বক ও কাঁকড়ার কাহিনি
কোনও এক বনপ্রদেশে নানা জলচরে পরিপূর্ণ বিশাল একটি সরোবর ছিল। সেখানে দীর্ঘদীন ধরে এক বক বাস করতো, সে তখন বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আর মাছ শিকার করতে পারতো না। খিদের জ্বালায় একদিন সে সেই বৃহৎ সরোবরের তীরে বসে তার মুক্ত সদৃশ অশ্রুবিন্দুর ধারায় পৃথিবীকে সিঞ্চিত করছিল। তাকে এইভাবে কাঁদতে দেখে এক কাঁকড়া তার দুঃখে সমব্যথী হয়ে অনেক জলজীবদের সঙ্গে নিয়ে সাদরে তার কাছে এসে বলল, মামা! আপনি আজ কোনও রকম খাওয়া-দাওয়া করেননি কেন? কেবল সাশ্রু নয়নে আপনি ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন, ব্যাপার কী?
সেই বৃদ্ধবকটি তখন সেই সমব্যথী কাঁকড়াটিকে বললেন, বত্স তুমি ঠিকই খেয়াল করেছো।মাছ খাওয়ার প্রতি আমার একটি বৈরাগ্য আসার কারণে আমি এখন প্রায়োপবেশনে আছি। এই কারণে আমার কাছে চলে আসা মাছেদেরও আমি এখন খাই না।
সেই কাঁকড়াটি তখন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, আপনার এই বৈরাগ্যের কারণটা কী মামা? সেই বকটি তখন বললে, পুত্র! এই সরোবরে আমি জন্মেছি আবার বেড়েও উঠেছি। আমি শুনলাম যে এখন থেকে বারো বছর ধরে অনাবৃষ্টি চলবে।
বক বলল, দৈবজ্ঞের মুখে। শনৈশ্চর নাকি রোহিণীশকট ভেদ করে মঙ্গল আর শুক্রের সংযোগ করাবে। বরাহমিহিরের জ্যোতিষশাস্ত্রেও বলেছে—
দ্বাদশবর্ষাণি তথা ন হি বর্ষতি বাসবো ভূমৌ।।
অর্থাৎ সূর্যপুত্র শনিশ্চর যদি রোহিণীশকট ভেদ করে তবে এ সংসারে বারো বছর যাবৎ ইন্দ্র পৃথিবীতে বর্ষণ করেন না। এছাড়াও জ্যোতিষশাস্ত্রে আরও অনেক রকম দুর্বিপাকের কথা বলা হয়েছে, ধরে নিতে পারো যে সমস্ত সৃষ্টিই ধ্বংস হতে চলেছে। ক্রমশ এই সরোবরের জল কমতে থাকবে এবং কিছুদিনের মধ্যেই এই সরোবর সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে যাবে। ফলে এই জলাশয়ের জল শুকিয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই যাদের সঙ্গে আমি বড়ো হয়ে উঠেছি, তারা সকলেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। তাদের এই পরিণতি আমি চোখে দেখতে পারবো না, তাই আমি আমৃত্যু অনশন ব্রত নিয়েছি। এই সময় সকল জলচর প্রাণীরা যারা স্বল্প জলে বাস করে তারা তাদের সম্বন্ধীদের ধরে করে বড়ো জলাশয়ে চলে যাচ্ছে। কুমীর, জলহস্তি বা গোসাপেরা তো নিজেরাই চলে যাচ্ছে কিন্তু আমার আশ্চর্য লাগছে এই সরোবরের অবশিষ্ট জলজন্তুদের এ নিয়ে কোন চিন্তাই নেই দেখে।
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৬: শ্রীমায়ের সাধনা
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১২: স্ট্যানলি ম্যাথুজ— একজন কিংবদন্তি, লড়াই আবেগ আর মেহনতী জনতার বন্ধু
বক বললে, এই জলাশয়ের অদূরেই একটি অতিবৃহৎ জলাশয় আছে যার জল চব্বিশ বছরের অনাবৃষ্টিতেও শুকাবে না। তাই যদি তোমরা এক-একজন করে আমার পিঠে চাপতে পারো তাহলে আমি তোমাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারি।
বৃদ্ধবকের মুখে এইসব কথা শুনে জলচরেরা একসঙ্গে তাকে কখনও মামা, কখনও ভাই, কখন জ্যাঠা এই সব বলে ডাকাডাকি করতে শুরু করল এবং অনুরোধ করতে লাগলো “অহং পূর্বমহং পূর্বম্”—আমি আগে, আমি আগে, এই সব বলে।
সেই বক-বাবাজিও দুষ্ট অভিসন্ধি নিয়ে তাদেরকে এক এক করে পিঠে নিয়ে সেই সরোবরের কাছেই একটি শিলাখণ্ডের উপর তাদের পটকে ফেলে হত্যা করতে লাগলো আর তারপর মনের সুখে তাদের খেয়ে আবার সময় সুযোগ মতন সেই জলাশয়ে ফিরে এসে তাদের সম্পর্কে মিথ্যা সংবাদ দিয়ে অন্যান্য জলজন্তুদের প্রসন্ন করতে লাগলো। আবার সময় মতো দ্বিতীয়জনকে পিঠে চাপিয়ে নিয়ে তাকে আবার হত্যা করে দিব্যি জীবন নির্বাহ করতে শুরু করলো সে। এইভাবেই চলছিল বেশ ভালো। কিন্তু সুখের দিন সবসময় এক রকম থাকে না।—চলবে।