ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
রথাকার সেই ছুঁতোর বন্ধুটি তখন বলল, ওহে মিত্র! তোমার মনের ইচ্ছা সিদ্ধ করা না গেলেও, আমাকে সবটা বলো; আমি যাতে সেটা অসাধ্য মনে করে তোমার সঙ্গেই অগ্নিতে প্রবেশ করতে পারি। কারণ তোমার এ জগতে না থাকা যে আমি এক মুহূর্তের জন্যেও সহ্য করতে পারবো না— এটা নিশ্চিত।
সে তাঁতি তখন সলজ্জ মুখে বলল, ওহে বয়স্য! মন্দির প্রাঙ্গণে যাত্রা উত্সবে হাতির পিঠে দেবদর্শন করতে আসা সেই রাজকন্যাকে মনে আছে? তাকে দেখবার পর থেকেই মকরধ্বজ মদনদেব স্বয়ং আমার এই হাল করেছেন। তাই এ-বেদনা আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমার অবস্থা এখন কামহত পুরুষের মতোই। সেই রাজকন্যার সঙ্গে সমাগত হয়ে তাকে আলিঙ্গন করে রতিশ্রমে তার সুডোল স্তনযুগল আমার বুকের মধ্যে রেখে কখন কিছু সময়ের জন্য শুয়ে থাকবো—সে চিন্তাতেই আমি অস্থির। তেলাকচুর পাকা ফলের মতো তাঁর লাল দুটো ঠোঁট, কলসির মতো সুডোল স্তন, গভীর নাভি, পাতলা কোমর, মসৃণ গাল—এ সবের কথা যতো মনে পড়ছে ততোই মন বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে। না পারছি তাঁকে ভুলতে, আর না পারছি তাকে স্মরণকরে মনের কষ্ট সহ্য করতে।
সেই রথকার তাঁতি বন্ধুর মুখে এই রকম কামবাসনাপূর্ণ কথা শুনে হেসে বলল, ওহে বয়স্য! এইটাই যদি তোমার মনোবৃত্তি হয় তাহলে সৌভাগ্যবশতঃ আমাদের মনোবাসনা পূর্ণ হতে চলেছে।
তাঁতিটি বলল, ওহে বন্ধু! রক্ষাপুরুষদের সুরক্ষা-বলয়ের ফাঁক গলে যে কন্যান্তঃপুরে বায়ু ছাড়া আর কেউ প্রবেশই করতে পারে না, সেখানে আমার সঙ্গে সে রাজকন্যার সমাগম কেমন করে হতে পারে? কেন ভাই এইসব অসত্য আশার কথা শুনিয়ে আমাকে আরও বিডম্বিত করে তুলছো?
রথকার তখন বন্ধুকে আশ্বস্ত করে বললে, “মিত্র! পশ্য মে বুদ্ধিবলম্”—ওহে বন্ধু! আমার বুদ্ধির জোড়টা একবার দেখই না?
সে তাঁতিকে সেইরথকার নিজের তৈরি বৈনতেয় যান চালনের জন্য “কীলসঞ্চরণবিজ্ঞানম্”-টিকেও শিখিয়ে দিলো—কীভাবে সেই যন্ত্রযানকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে সবই আছে “কীলসঞ্চরণবিজ্ঞানম্” -এর ভিতরেই।
পাঠক-পাঠিকাদেরকে বলবো, দয়া করে এই যানটিকে এরোপ্লেন ভেবে বসবেন না যেন। আগেই বলেছি যে জিনিসটা অনেকটা প্যারাগ্লাইডিং-এর মতো আর তার সঙ্গে আছে কবির কল্পনা। এইরকম আকাশে উড়ে বেড়াবার যন্ত্র প্রাচীনকালে ছিল কি ছিল না সে তর্কে আমি যেতে রাজি নই —এর জন্য প্রাচীন বিজ্ঞান নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন সেই রকম বিজ্ঞানীরা আছেন। তবে আমি শুধু এইটুকুই বলবো যন্ত্রশক্তিকে অবলম্বন করে যে আকাশে ওড়া যেতে পারে এই চিন্তাটি কিন্তু অন্তত সে যুগে মানুষ করেছিলেন—যেমন, জ্যুলে ভার্ণ সাবমেরিন আবিষ্কারের আগেই ক্যাপ্টেন নিমোর নটিলাস ডুবোজাহারে গল্প বলেছিলেন। আজকের দিনেও মানুষ আগে কল্পনা করে এবং পরে তাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রচেষ্টা করে। আর সব শেষে যেটা বলবো—আপনি গল্প শুনতে বসেছেন, যে গল্প প্রায় দেড়-দু’হাজার বছর আগের শিশুদের রাজনীতি শেখাবার জন্য রচনা করা হয়েছিল, যেখানে পশুপক্ষীরা কথা বলে, তারাও রাজনীতি-কূটনীতি বোঝে, সেখানে কিন্তু কাহিনিটা মুখ্য নয়—কাহিনির শিক্ষাটা মুখ্য। কাহিনিটা সেক্ষেত্রে রূপক—নীতিশিক্ষা প্রদানের অবলম্বন মাত্র। তাই গল্পকে গল্পের মতো নিতেই অনুরোধ করবো।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২৩: কাপুরুষ যাঁরা, তাঁরাই শুধু ঘরের মধ্যে বসে দৈব-ভাগ্য বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা
সেই রাজকন্যাও গরুড়ে আরূঢ় চতুর্ভূজে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী কৌস্তুভমবক্ষে ধারণকারী ভগবান বিষ্ণুকে সবিস্ময়ে দেখে শয্যা ছেড়ে উঠে বলল, হে ভগবন! আমি এক মানুষী মাত্র কীটতূল্য অশুচি —অপবিত্র আর আপনি ত্রিলোকের পাবক স্বয়ং ভগবান! জগত্সংসারের বন্দনীয় আপনি—“তৎ কথমেতদ্ যুজ্যতে”। আপনার সঙ্গে আমার সমাগম কি হতে পারে?
বিষ্ণুরূপী সেই তাঁতিটি বললে, ওহে সুন্দরী! তুমি সঠিক কথাই বলেছো। কিন্তু ভুলে যেও না রাধা নাম্নী গোপকুলে উত্পন্না আমার প্রথম স্ত্রীটি কিন্তু মানুষীই ছিলেন, তুই সেই রাধা—এই জন্মে রাজকন্যা। তাই তোমার আকর্ষণে আজ আমি এখানে।
এই কথা শুনে রাজকন্যা বললেন, “ভগবন! যদ্যেব তন্মে তাতং প্রার্থয। সোঽপ্যবিকল্পং মাং তুভ্যং প্রযচ্ছতি”। তাই যদি হয়, হে ভগবন! আপনি আমাকে আমার পিতার কাছে প্রার্থনা করুন, আমি তাঁরই অধীন। তিনিও নিঃসন্দেহে আমাকে আপনার হাতে সমর্পণ করে ধন্য হবেন।
চটুল তাঁতি বললে, “সুভগে! নাহং দর্শনপথং মানুষাণাং গচ্ছামি? কিং পুনরালাপকরণম্?” হে সুন্দরী! মানুষের দৃষ্টিপথের ঊর্ধ্বে আমি বিচরণ করি—সাধারণ মনুষ্য আমাকে চর্মচক্ষুতে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে তার সঙ্গে কথোপকথন তো দূরের কথা। তুমি গান্ধর্ব বিবাহের মাধ্যমে নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ করো—নো চেচ্ছাপং দত্ত্বা সান্বযং তে পিতরং ভস্মসাৎ করিষ্যামি, না হলে অভিশাপ দিয়ে কুলসহিত তোমার পিতাকে আমি ভস্ম করে দেবো।
স্বয়ং দেবতার মুখ থেকে এই সব অভিশাপ-টভিশাপের কথা শুনলে আর কেই বা নিজেকে তাঁর কাছে সমর্পণ না করে পারে।
এ ভাবে সেই তাঁতি রাজকন্যাকে শাসিয়ে গরুড় যান থেকে নেমে ডান হাতে তাকে গ্রহণ করলো এবং সেই রাজকন্যাও সভয়ে কাঁপতে কাঁপতে লজ্জাবনতঃ মুখে নিজেকে তাঁর কাছে সমর্পণ করলো। বিষ্ণুরূপী সে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সে রাজকন্যাকে শয্যায় এনে বাত্স্যায়নের কামশাস্ত্রের বিধি অনুযায়ী সেবা করে প্রত্যূষে সূর্যোদয়ের পূর্বেই সকলের অলক্ষিতে বাড়ি ফিরে গেলো। এ ভাবে প্রতিদিনই বাত্স্যায়নের বিধি মেনে সেবাধর্ম চলছিল ভালোই।
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১২: স্বপ্নাদেশের দেবী ভবানী
দেশের প্রথম আধুনিক চিত্রকর নিরীহের হত্যা মানতে না পেরে গৃহত্যাগী হন
অন্তঃপুরচারীরা সকলে মিলে রাজার কাছে গিয়ে বললেন, হে রাজন! আমরা জানি না কিন্তু এ বিষয়ে নিশ্চিত যে কন্যান্তঃপুর চারিদিক থেকে সুরক্ষিত থাকলেও সেখানে পুরুষ প্রবেশ করছে। এবার আপনি যেটা ঠিক বুঝবেন সেইটাই করুন। রাজা এসব শুনে অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে ভাবতে লাগলেন—
কস্মৈ প্রদেযেতি মহান্বিতর্কঃ।
দত্ত্বা সুখং প্রাপ্স্যতি বা ন বেতি
কন্যাপিতৃত্বং খলু নাম কষ্টম্।।
অর্থাৎ কন্যার পিতা হওয়ার মতো কষ্টকর আর কিছুই নেই। জন্মাবধি কন্যার পিতার চিন্তা যে তাঁকে কার কাছে প্রদান করা হবে উপযুক্ত পাত্র খুঁজে তাকে সম্প্রদান না করা পর্যন্ত স্বস্তি নেই। আবার বিবাহ হয়ে গেলেই যে নিশ্চিন্তি তাও নয়; বিবাহের পরেও সে সুখী হবে কি হবে না সেই নিয়েও চিন্তা। তাই “কন্যাপিতৃত্বং খলু নাম কষ্টম্”—এই ছিল প্রাচীন ভারতের চিন্তা। আজকের দিনেও যে সে চিন্তাই পুরুষশাসিত সমাজে প্রতিধ্বনি তুলে আসছে এ নিয়ে কোনও দ্বিধা নেই। প্রাচীন শাস্ত্রকাররা বলেন, নদী এবং নারী স্বভাব একই রকমের। নদীর যেমন দু’ পাশে দু’ কূল থাকে, তেমনই বিবাহিতা নারীরও থাকে দু’ কুল—পিতৃ ও মাতৃকুল। নদী যেমন তার স্বচ্ছ জলধারায় উভয় কূলকে পবিত্র করে আবার অপরিষ্কার জলের স্রোতে নদীকূল অপবিত্র হয়। নারীর ক্ষেত্রেও তেমনই। সু-আচরণে তার পিতৃ-মাতৃকুল যেমন পবিত্র হয় তেমনই দুরাচারে উভয়কূলেরই বদনাম করে সে, অপবিত্র হয় তার উভয়কুলই। তাই “দুরিতক্রমা দুহিতরো বিপদঃ”—কন্যা জন্মানোর কারণে এই যে বিপত্তি তাকে অতিক্রম করা সত্যিই দুরূহ।
এ ভাবে নানা রকম চিন্তা করতে করতে একদিন গোপনে রাজা মহারানিকে বললেন, হে দেবী! এই কঞ্চুকী যে সব বলছে সেবিষয়ে একটু খোঁজ-খবর নাও। কোন ব্যক্তির এমন দুঃসাহস যার প্রতি যমরাজ পর্যন্ত কুপিত হচ্ছেন?
পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর
মায়ের মুখে এইরকম কঠোর কথাবার্তা শুনে রাজকুমারী ভয়ে আর লজ্জায় একেবারে জড়সড় হয়ে গেল। নতনয়নে মাটির দিতে তাকিয়ে বললে, “অম্ব সাক্ষান্নারায়ণঃ প্রত্যক্ষং গরুডারূঢ়ো নিশি সমাযাতি”—মাগো! সাক্ষাৎ ভগবান নারায়ণ গড়ুরপক্ষীতে আরোহণ করে স্বয়ং রাত্রিতে আমার সঙ্গে সমাগতো হতে আসেন—“চেদসত্যং মম বাক্যম্, তত্স্বচক্ষুষা বিলোকযতু নিগূঢ়তরা নিশীথে ভগবন্তং রমাকান্তম্”। আমার কথা যদি আপনার অসত্য বলে মনে হয় তাহলে গভীর রাত্রে রমাকান্ত ভগবান বিষ্ণুকে নিজের চোখেই আপনারা দেখুন।
মেয়ের মুখে এই কথা শুনে মহারাণী অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন এবং চোখে মুখে তাঁর হাসির রেখা ফুটে উঠলো। অত্যন্ত পুলোকিত হয়ে তিনি দ্রুত মহারাজের কাছে গিয়ে বললেন, হে দেব! ভাগ্যের খেলাটা দেখুন। নিত্য নিশিথরাতে ভগবান নারায়ণ স্বয়ং আমাদের কন্যারত্নটির কাছে আসেন। গান্ধর্বমতে তাঁরা পরস্পর পরস্পরকে গ্রহণও করেছেন। আজ রাত্রে প্রাসাদের বাতায়ন থেকে আমরা দেখবো যে সে সত্যিই মানুষের সঙ্গে সঙ্গত হয়নি।—চলবে।