শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

দেবশর্মা লক্ষ্য করছিল এ সব কিছুই। রাজপুরুষেরা যখন সেই নাপিতকে বেঁধে বধ্যস্থানে শূলে চড়াতে নিয়ে গেল। তখন সে দেবশর্মা ধর্মাধিকরণে গিয়ে বললে, এই বেচারা নাপিত কোনও অন্যায় করেনি। শুধু শুধু একে মরতে হচ্ছে—এ অত্যন্ত সদাচারী এক ব্যক্তি।

জম্বুকো হুদুযুদ্ধেন বযং চাষাঢ়ভূতিনা।
দূতিকা পরকার্যেণ ত্রযো দোষাঃ স্বয়ং কৃতা।।


ভেড়ার লড়াইয়ের মাঝে থাকা সেই শেয়ালটি, আষাঢ়ভূতির কারণে আমি এবং অন্যের ভালো করতে গিয়ে সেই দূতি নাপিতনী প্রত্যেকেই নিজের দোষেরই ফল পেলো।
ধর্মাধিকরণের সভ্যরা বললেন, “ভো ভগবন্ কথমেতৎ?”—হে ভগবন্‌! এই ব্যাপারটা কেমন?
দেবশর্মা তখন তিনটি বৃত্তান্তই বিস্তারে জানালেন। সে সব কথা শুনে ধর্মাধিকরণের সভ্যরা নাপিতকে ছেড়ে দিলেন কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলেন—

অবধ্যো ব্রাহ্মণো বালঃ স্ত্রী তপস্বী চ রোগভাক্‌।
বিহিতা ব্যঙ্গিতা তেষামপরাধে মহত্যপি।। (মিত্রভেদ, ২১৪)


শাস্ত্রে বলে, ব্রাহ্মণ, বালক, স্ত্রী, তপস্বী এবং রোগী অবধ্য, অর্থাৎ এই পাঁচ রকম মানুষের জন্য মৃত্যুদণ্ড বিহীত নয়। বড় বড় অপরাধে লিপ্ত হলেও অঙ্গচ্ছেদই এদের সর্বাপেক্ষা গুরুদণ্ড বলেই বিহীত হয়েছে। সেই দূতি নাপিতনীর নাক তো নিজের অপরাধেই কাটা গিয়েছে এখন স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করবার অপরাধে রাজদণ্ডরূপে এর একটা কানও কেটে দেওয়া উচিত।

পাঠকদের এ প্রসঙ্গে কয়েটা কথা শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। প্রাচীনভারতে জঘন্য কিংবা লজ্জাজনক কোনও অপরাধে লিপ্ত হলে এই রকম অঙ্গচ্ছেদের শাস্তি হতো। আজকের দিনে এই “নাক-কান-কাটা” শব্দটা আমরা কোনও নির্লজ্জ লোকের সম্পর্কে ব্যবহার করি তার পরম্পরাটা এবার ধরতে পারছেন কি?
যাইহোক এসব কিছু দেখে শুনে দেবশর্মাও নিজের ধননাশের শোক ভুলে আবার নিজের মঠে ফিরে চলে এলো।
 

৪র্থ কাহিনি সমাপ্ত

দমনক বললেন, আমারও অবস্থাও সেই মেষের যুদ্ধের মাঝে থাকা শেয়ালের মতো বা ব্রাহ্মণ দেবশর্মার মতো কিংবা সেই অন্যের উপকার করতে গিয়ে নিজের দোষে নাককাটা সেই দূতি নাপিতনীর মতোই নিজে ব্যবস্থা করে সেই সঞ্জীবককে সিংহ-পিঙ্গলকের কাছে নিয়ে এসে নিজেরাই এখন অপ্রধান হয়ে গিয়েছি। আসলে রাজনীতিতে রাজার প্রধান অনুচর হয়ে থাকতে গেলে নিজের থেকে পারদর্শী লোককে কখনও রাজার কাছে পৌঁছবার সুযোগ দিতে নেই। একবার সেই সুযোগ্য লোকটির পরিচয় যদি রাজা পেয়ে যান তবে, আগের জন্যকে অপ্রধান করে সুযোগ্যকে প্রধান করে দিতে রাজার বেশি সময় লাগে না। নিজের দোষেই আমরা আজ প্রধান। আমিই রাজার কাছে সঞ্জীবকের হয়ে ওকালতি করেছি এবং তার হয়ে সিংহ-পিঙ্গলকের থেকে অভয়দানের শপথ করিয়েছি—এখন আমাদেরই নিজকর্মের সেই ফল ভোগ করতে হচ্ছে।
করটকট সাবধানী। হঠকারীর মতো কাজ সে করে না। সে বলল, এই রকম বিচিত্র পরিস্থিতিতে এখন আমাদের দু’জনের কি করা উচিত বলে তোমার মনে হয়।

দমনক একটু ভাবনা চিন্তা করে বলল, আমার বুদ্ধি বলছে এই পিঙ্গলক আর সঞ্জীবকের মধ্যে ভেদ তৈরি করে দিতে হবে। দুজনের মধ্যে এই যে বন্ধুত্বটা দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে —এটাকে নষ্ট করে দিতে হবে এবং তার জন্য কূট বুদ্ধির প্রয়োগ করতে হবে। রাজনীতিশাস্ত্রেও বলে—

একং হন্যান্ন বা হন্যাদিষুর্মুক্তো ধনুষ্মতা।
বুদ্ধির্বুদ্ধিমতা সৃষ্টা হন্তি রাষ্ট্রং সনাযকম্‌।। (ঐ, ২১৫)


ধনুর্ধারী ব্যক্তি কোনও বাণ নিক্ষেপ করলে সেটা কাউকে মারতেও পারে, আবার নাও মারতে পারে। কিন্তু ভেবে চিন্তে নীতিজ্ঞ ব্যক্তিরা যদি কোনও নীতির প্রয়োগ করেন তবে বুদ্ধি বাণের সমান সেই নীতি রাজার সঙ্গে সঙ্গে গোটা রাষ্ট্রকেই বিনাশ করে দিতে পারে।
দমনক বলল, “তদহং মাযাপ্রপঞ্চেন গুপ্তমাশ্রিত্য তং স্ফোটযিষ্যামি”—তাই আমি ছল-কপটের সাহায্যে গোপনে একটা ষড়যন্ত্র করে এদের দু’জনকে দু’জনের থেকে আলাদা করে দেব।
সাবধানী করটক তখন বলল, ওহে ভদ্র! তোমার এই গোপন ষড়যন্ত্রের কথা ঐ সিংহ-পিঙ্গলক বা সঞ্জীবকের মধ্যে কেউ একজন যদি জানতে পেরে যায় তবে আমাদের প্রাণহানী কিন্তু নিশ্চিত। রাজদ্রোহ বা রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবার শাস্তিই হল প্রাণদণ্ড।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২২: কামুক পুরুষের সঙ্গ ছাড়া একজন নারীও একা কোনও দুষ্কর্মে লিপ্ত হতে পারে না

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি

দমনক বলল, “তাত মৈবং বদ”—ওহে ভাই! এমন কথা বলো না। বিপদের সময়ে দৈব বা ভাগ্য প্রতিকূল হলেও নীতিজ্ঞ ব্যক্তির কিন্তু নিজের বুদ্ধি উচিত। “নোদ্যমস্ত্যাজ্য”—বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার প্রচেষ্টা বা উদ্যোম কিন্তু ছেড়ে দেওয়াটা উচিত নয়। কারণ, ঘুণপোকা কাঠ খেতে শুরু করলে তার অজান্তেই যেমন কাঠে অক্ষরের চেহারা নেয়, চলতি ভাষায় যাকে আমরা ঘুণাক্ষর বলি, তেমনই দেবতা সহায় থাকলে আর সেইসঙ্গে সঠিকভাবে বুদ্ধি প্রয়োগ করতে সাম্রাজ্যলাভ করে ফেলাটাও কিন্তু অসম্ভব নয়। নীতিশাস্ত্রজ্ঞরা তাই বলেন—

ত্যাজ্য ন ধৈর্যং বিধূরেঽপি দৈবে ধৈর্যাৎ কদাচিৎ স্থিতিমাপ্নুযাৎ সঃ।
জাতে সমুদ্রেঽপি হি পোতভঙ্গে সাংযাত্রিকো বাঞ্ছতি কর্ম এব।। (ঐ, ২১৬)

ভাগ্য বিধাতা প্রতিকূল হলেও পুরুষের অন্ততঃ ধৈর্য অবলম্বন করা উচিত। কারণ ধৈর্য ধরলে কখনও কখনও ইষ্টসিদ্ধিও হয়ে যেতে পারে। সমুদ্রে জাহাজ ডুবে গেলেও, জাহাজে করে যে সমস্ত বণিকেরা সমুদ্রপারে ভিনদেশে বাণিজ্যে যায় তারাও ধৈর্য ধরে, সাময়িক ক্ষতি কাটিয়ে পুনরায় ব্যবসা করবার অন্ততঃ প্রচেষ্টা করে। তাই শাস্ত্রের উপর বিশ্বাস রাখাটা উচিত। নীতিশাস্ত্র বলে—

উদ্যোগিনং সততমত্র সমেতি লক্ষ্মীর্দৈবংহি দৈবমিতি কাপুরুষা বদন্তি।
দৈবং নিহত্য কুরু পৌরষমাত্মশক্ত্যা যত্নে কৃতে যদি ন সিদ্ধ্যতি কোঽত্র দোষঃ।। (ঐ, ২১৭)


উদ্যোগী পুরুষ, যাঁর মধ্যে প্রচেষ্টা আছে, তিনি এই সংসারে সব সময় ধন-লক্ষ্মী লাভ করতে সমর্থ হন, কিন্তু কাপুরুষ যারা, তারাই শুধু ঘরের মধ্যে বসে বসে শুধু দৈব-ভাগ্য এই সব বলে চিত্কার-চেঁচামেচি করে, কোনও কিছু করবার উদ্যোগ নেয় না। কাপুরুষদের ভাগ্যে তাই কিছুই জোটে না। তাই নীতিজ্ঞরা বলছেন, ভাগ্যকে লাথি মেরে পাশে সরিয়ে রেখে মানুষ উচিত নিজের পুরুষকারের উপর ভরসা রেখে সর্বশক্তি দিয়ে প্রচেষ্টা করার, উদ্যোগী হওয়ার। আর চেষ্টা করলেও যদি ইষ্টসিদ্ধি না হয় তাতে তো দোষের কিছু নেই?

পাঠকদের খেয়াল করতে বলবো যে ভারতবর্ষের সংস্কৃতি সম্পর্কে বিদেশীরা দৈবনির্ভর অপবাদ দিয়েছেন, সেই ভারতেই কিন্তু নীতিশাস্ত্রের পরম্পরা সেই দৈবকে “লাথি মেরে পাশে সরিয়ে রেখে” উদ্যোগী হওয়ার কথা বলছে।
তাই দমনকের বক্তব্য হল, এইভাবে সবদিক বুঝে শুনে নিজের কূটবুদ্ধি প্রভাবে এমনভাবে দু’জনকে দু’জনের থেকে আলাদা করে দিয়ে হবে যাতে ওদের দু’জনের মধ্যে কেউ ভাবতেই না পারে যে তৃতীয় কেউ ষড়যন্ত্র করে এটা করছে, তাহলেই আমাদের বিজয়। কথায় বলে—
সুপ্রযুক্তস্য দম্ভস্য ব্রহ্মাপ্যন্তং ন গচ্ছতি।
কৌলিকো বিষ্ণুরূপেণ রাজকন্যাং নিবেষবতে।। (ঐ, ২১৮)


কপটাচরণ বা ছলচাতুরী যদি জেনে বুঝেও কেউ করে তবে স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মারও ক্ষমতা নেই তার তল খুঁজে পাবে; এক তাঁতি যেমন ভগবান্‌ বিষ্ণু রূপধারণ ছল করে রাজকন্যার সঙ্গে সঙ্গম করেছিল তেমন।
করটক বললে, এই ব্যাপারটা কেমন?
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে

 

০৫: বিষ্ণুরূপী তাঁতির কাহিনি

কোনও এক জায়গায় এক তাঁতি আর এক ছুঁতোর বাস করতো। সে ছুঁতোর ছিল মূলত রথকার। রথ তৈরির কাজ করতো সে। তারা দু’জনে শিশুকাল থেকেই একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে বলে তাদের পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্বও ছিল গাঢ়। সব সময়েই তারা একসঙ্গেই চলাফেরা করতো, এমনই অবসরও কাটাতো তারা একসঙ্গেই। সেখানে একবার কোনও এক মন্দির প্রাঙ্গণে একটা বিরাট যাত্রা উত্সব শুরু হয়। সেখানে তারা দুজনে নট-নর্তক আর গায়ক-বাদকের ভিড়ের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে পরমা সুন্দরী এক রাজকন্যাকে দেখতে পায়। সে রাজকন্যা ছিলেন সর্বাঙ্গ সুন্দরী এবং সেই সঙ্গে সুলক্ষণা। কঞ্চুকী এবং একাধিক নপুংসক রাজসেবকপরিবৃত হয়ে হস্তিপৃষ্ঠে সে এসেছিল দেবদর্শন করতে। সুন্দরী সেই রাজকন্যাকে দেখে মদনবাণের আঘাতে সে তাঁতি এমনভাবে মাটিতে পড়ে গেলো যেন কেউ তাকে বিষ-মাখানো তীর ছুড়েছে। তাঁতি-বন্ধুটির এ-অবস্থা দেখে তার ছুঁতোর-বন্ধুটি তার দুঃখে সহমর্মী হয়ে কোনওক্রমে চেনা-পরিচিত লোকজনদের সাহায্যে তাকে ধরা-ধরি তাকে বাড়ি নিয়ে এলো। কামজ্বর খুবই মারাত্মক—চন্দন প্রভৃতি নানা রকম শীতল উপাচার দিয়ে সে আমলে বৈদ্যরা তার চিকিত্সা করতেন। ওঝা-পুরুত ডেকে অনেকরকম ঝাড়ফুঁকে করে অনেক রকম শীতল উপাচার করে শেষ পর্যন্ত সে তাঁতির জ্ঞান ফিরলো।

রথকার ছুঁতোর-বন্ধুটি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল—ওহে মিত্র! কথা নেই বার্তা নেই তুমি এইভাবে জ্ঞান হারালে কী করে? গোড়া আমাকে সবটা বলো তুমি।
সে বললে, ওহে বয়স্য! যদি সত্যিই তুমি জানতে চাও তাহলে আমার সব বেদনার কথা তোমাকে বলছি। যদি সত্যিই তুমি আমাকে তোমার সুহৃদ বলে মনে করো তাহলে আমার কাঠের চিতা বানিয়ে আমাকে উদ্ধার করো আর বন্ধু ভেবে যদি কখনও কোনও দুর্ব্যবহার করে থাকি তোমার সঙ্গে আমাকে ক্ষমা করো।

আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৭: আমি শুধুই উদাস, জলজ্যান্ত লাশ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১২: জয়রামবাটিতে প্রত্যাবর্তন

তাঁতির মুখে এই সব কথা শুনে রথকার ছুঁতোর-বন্ধুটি বন্ধুটির তো চোখে জল এসে গেলো। সজল নয়নে সে বন্ধুকে বলল, ওহে মিত্র! তোমার দুঃখের যাই কারণ হোক, আমাকে সবটা বলো। তোমার এই কষ্টের প্রতিকার করতে আমি সাধ্য মতো চেষ্টা করবো। লোকে বলে—

ঔষধার্থসুমন্ত্রাণাং বুদ্ধেশ্চৈব মহাত্মনাম্‌।
অসাধ্যং নাস্তি লোকেঽত্র যদ্ব্রহ্মাণ্ডস্য মধ্যগম্‌।। (ঐ, ১১৯)


অর্থাৎ এই ব্রহ্মাণ্ডে এমন কোনও বস্তু নেই যা ঔষধিদ্রব্য বা মন্ত্রপ্রয়োগ করে কিংবা ধনসম্পদ ব্যয় করে বা বুদ্ধিপ্রয়োগ করে পাওয়া যায় না। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি বন্ধু! যদি এই চারটি উপায়ে তোমার দুঃখ প্রতিকার সম্ভব হয় তবে আমার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে না।
তাঁতিটি বললে, ওহে মিত্র! মাত্র এই চারটি উপায় কেন? হাজার উপায় প্রয়োগ করলেও আমার দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব নয়, তাই সময় ব্যর্থ অতিবাহিত না করে আমার মরণই শ্রেয়।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content