রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

রাজনীতিবিদদের মতে, রাজা খুশি হয়ে কোনও ভৃত্যকে সম্মান প্রদর্শন করলেও গর্বে যার পা ভারী হয়ে যায় না, বা কোনও কারণে রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে অপমান করলেও যে ভৃত্য রাজার প্রতি ক্ষুব্ধ হয় না, সেই রকম ভৃত্যই রাজভৃত্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। মানেটা হল, যে সেবক প্রভুর ভালোমন্দ আচরণের জন্য তার উপর প্রসন্ন বা ক্ষুব্ধ হলেও, তার মনের ভাব—মানে নিজের শোক-দুঃখকে লুকিয়ে রাখতে পারে, সেইরকম রাজসেবককেই রাজার মাথায় করে রাখা উচিত। রাজকার্যে নিযুক্ত হয়ে যারা নিজেদের আহার-নিদ্রা সবকিছু ভুলে শীত-বর্ষা উপেক্ষা করে সবসময়ে রাজার আদেশ পালনের জন্য উদ্যোত হয়ে থাকে, রাজা সেইরকম সেবককেই পছন্দ করেন। সেইরকম সেবকই হলেন, সেবকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পঞ্চতন্ত্রকার বলছেন, রাজার উচিত সেই রকম সেবকদেরকে মাথায় করে রাখা। কিন্তু এইটাও ঠিক যে শুধু মাথায় করে রাখাটাই পন্থা নয়। কারণ ঢেউ খেলানো চুল মাথায় থাকলেও, তেল বা স্নেহদ্রব্য দিয়ে তাকে প্রতিদিন পরিচর্যা না করলে সে চুলও কিন্তু একদিন রুক্ষ হয়ে যায়। তাই যথার্থ সেবকদের শুধু মাথায় করে রাখলেই হয় না, স্নেহ করাটাও প্রয়োজন।

শিরসা বিধৃতা নিত্যং স্নেহেন পরিপালিতাঃ।
কেশা অপি বিরজ্যন্তে নিঃস্নেহাঃ কিং ন সেবকাঃ।। (মিত্রভেদ-৯০)


দমনক বলে, যে রকম ভৃত্যকে দ্বায়িত্ব দিলে শুক্লপক্ষের চন্দ্রের মতো রাজ্যের সীমাবৃদ্ধি হয় সেই ভৃত্যই শ্রেষ্ঠ। রাজ্যসীমা বৃদ্ধি মানেই কর বৃদ্ধি হওয়া, আর কর বৃদ্ধিমানেই রাজকোষের বৃদ্ধি, যা রাজার যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজের মূল আশ্রয়। চামড়ায় আগুন লাগলে চামড়া যেমন সঙ্কুচিত হতে থাকে, ঠিক তেমনই ভাবে যে ভৃত্যের কারণে রাজ্যের সীমা এইভাবে সঙ্কুচিত হতে থাকে, সেই ভৃত্যকে তৎক্ষণাৎ পরিত্যাগ করা উচিত।

দমনক সিংহ পিঙ্গলককে বুঝিয়ে বলে, হে রাজন! আমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে রাজসেবার উপযুক্ত সমস্তগুণই আছে। কিন্তু আমরা দু’জন শুধু শৃগাল বলে, কেবল জাতিগত কারণে আমাদেরকে বরখাস্ত করা আপনার বোধহয় উচিত হয়নি। রাজনীতিবিদরা বলেন, রেশমের সুতো যেমন নিকৃষ্ট কীট থেকে উৎপন্ন হয়, সোনা যেমন খনিতে থাকা পাথরের মধ্যে থেকে উৎপন্ন হয়; তেমনই গুণী ব্যক্তিও নিজ গুণের দ্বারাই জগতে খ্যাত হন, তিনি কোন বংশে জন্মেছেন সে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না (প্রাকাশ্যং স্বগুণোদযেন গুণিনো গচ্ছন্তি কিং জন্মনঃ)। মানুষ শুধু গুণটাকেই দেখে।

তাই কোনও রাজা যদি ভাবেন শুধু নিজের লোকজনকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করবেন অন্য কাউকে কাজ করার সুযোগ দেবেন না—তাহলে বলতে হয় ঘরের কোণে জন্মানো ইঁদুর অনেক শস্যের নষ্ট করলেও তাকে হত্যা করা উচিত নয়। কারণ, সে আপনার নিজের ঘরে জন্মেছে, আপনার নিজের লোক। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে সেই ইঁদুরকে মারবার জন্য বাইরে থেকে হিতকারী বেড়ালকে লোকে খাইয়ে-পরিয়ে বাড়িতে এনে পোষে। তাই নিজের লোক অনিষ্টকারী হলে তাদের দিয়ে কোনও কাজই হয় না। ব্যাপারটাকে যদি আরও পরিষ্কার করে বোঝাতে হয় তাহলে বলবো—

এরণ্ডভিণ্ডার্কনলৈঃ প্রভূতৈরপি সঞ্চিতৈঃ।
দারুকৃত্যং যথা নাস্তি তথৈবাজ্ঞৈঃ প্রযোজনম্‌।। (ঐ, ১০৫)


অর্থাৎ ভেরাণ্ডা গাছ কিংবা উলুখাগড়া জাতীয় বৃক্ষ অনেক অনেক সংগ্রহ করলেও যেমন সেগুলো দিয়ে কাঠের প্রয়োজন মেটে না—তাই দিয়ে কোনও আসবাব তৈরি করা যায় না, সেইরকম অনেকজন অজ্ঞলোককে রাজসেবার কাজে নিযুক্ত করলেও তাদের দিয়ে রাজকার্যের প্রয়োজন সিদ্ধ হয় না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১২: প্রজাদের কাছে রাজার নিজের ভাবমূর্তি সঠিক রাখতে গেলেও সুযোগ্য রাজকর্মচারীর প্রয়োজন

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪: আমারে তুমি অশেষ করেছ

সিংহ পিঙ্গলককে এতো কথা বলে অবশেষে উপসংহারে সমস্ত বক্তব্যের সারটুকু বলল দমনক—

কিং ভক্তেনাসমর্থেন কিং শক্তেনাপকারিণা।
ভক্তং শক্তং চ মাং রাজন্‌ নাবজ্ঞাতুং ত্বমর্হসি।। (ঐ, ১০৬)


দমনক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল— হে রাজন! এতো ভক্ত দিয়ে হবেটা কী যদি সে রাজকার্য করবার যোগ্য না হয়? আবার কেউ যদি যোগ্যও হয় কিন্তু রাজার উপকারে না লাগে বরং রাজার অপকার কি করে করা যায় সেই চিন্তাতেই তারা মগ্ন থাকেন—সেইরকম লোকদের দিয়েই বা কী হবে? কিন্তু আমার মতো একজন রাজভক্ত এবং রাজকার্য যথাযথভাবে করতে সমর্থ সেবককে অবজ্ঞা করাটা আপনার ঠিক হয়নি।

পিঙ্গলক তখন বললেন, “ভবত্যেবং তাবৎ”—এই আলোচনা আজ এখানেই থামুক। তোমার বক্তব্য সবটাই আমি বুঝতে পেরেছি। তবে তুমি রাজকার্যের সমর্থ হও বা না হও তাতে কিছুই যায় আসে না—তুমি আমার ভূতপূর্ব বিশ্বস্ত মন্ত্রির পুত্র। তাই তুমি আমার ভালোর জন্য যা যা বলতে চাও নিঃশঙ্কোচে বলতে পারো।

দমনক বললেন, “দেব! বিজ্ঞাপ্যং কিঞ্চিদস্তি”—মহারাজ! বলবার মতো কথা তো অনেক কিছুই আছে।

সিংহ বললেন, নির্ভয়ে নিবেদন কর। দমনক বলে, আচার্য বৃহস্পতি ছিলেন প্রাচীন একজন রাজনীতিবিদ। তিনি বলেন, রাজার নিজের যদি সামান্যতম কিছু ব্যক্তিগত কাজও থাকে, যার সঙ্গে রাজ্যশাসনের কোনও সম্পর্ক নেই, সে কাজ সিদ্ধির জন্য সভার মধ্যে আলোচনা করাটা উচিত নয়। তাই আমার অভিপ্রায় হল মহারাজ যদি কৃপা করে একান্তে আমার কথাগুলি শোনেন। কারণ রাজনীতিশাস্ত্র বলে—

ষট্‌কর্ণো ভিদ্যতে মন্ত্রশ্চতুর্কর্ণঃ স্থিরো ভবেৎ।
তস্মাৎ সর্বপ্রযত্নেন ষট্‌কর্ণং বর্জযেৎ সুধীঃ।। (ঐ, ১০৮)


কারণ গুপ্ত মন্ত্রণা বা আলোচনা ছ’কান হলে আর গোপন থাকে না, অর্থাৎ তিনজনের মধ্যে কোনও কিছু আলোচনা হলে সে আলোচনা আর কারও জানতে আর বাকি থাকে না। কিন্তু সে আলোচনাই যদি চার কানের মধ্যে থাকে, মানে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যেই শুধু সীমাবন্ধ থাকে, তাহলে সেটা আর পাঁচ কান হয় না—সেই মন্ত্রণা আর কেউ জানতে পারে না। তাই নীতিজ্ঞ ব্যক্তির উচিত কোনও আলোচনা যাতে চার কান থেকে ছ’কানে না পৌঁছয় সেদিকেও খেয়াল রাখা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪২: আশা-ভরসার ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৯: পঞ্চমের সুরে লতার গাওয়া ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’ গান শুনে শুনেই প্রস্তুতি শুরু করেন কিশোর

পাঠককে বলব, দমনকের বলার কায়দা খেয়াল করুন। রাজার মতো উচ্চশ্রেণির লোকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় এইটাও কিন্তু শেখবার ব্যাপার। ভাবুন তো কতটা পরিশীলিতভাবে সে জানালো যে রাজার সঙ্গে সে একা কথা বলতে চায়। যাইহোক আমরা ঘটনায় আসি। পিঙ্গলক সিংহের চোখের ইশারায় তখন বাঘ, চিতা, নেকড়ে প্রভৃতি আর যারা যারা সভায় ছিলেন সকলে তত্ক্ষণাৎ বাইরে বেরিয়ে গিয়ে সভাকক্ষ ফাঁকা করে দিলেন।

তখন দমনক বলল, আপনি জলপান করবার জন্য যমুনা-কচ্ছে নেমেছিলেন, কিন্তু জলপান না করেই ফিরে এসে এখানে চুপচাপ বসে আছেন। এর পিছনে কি নির্দিষ্ট কিছু কারণ আছে?

সিংহ পিঙ্গলক তখন সলজ্জ মুখে বললেন, না ব্যাপারটা এমন কিছু নয়। এমনই। দমনক তখন বলে, মহারাজ! যদি সেই কারণটা কহতব্য না হয় তবে বাদ দিন। আমি শুনতেও চাই না। কারণ নীতিজ্ঞরা বলেন, সবকথা সকলকে বলতে নেই, তাতে শান্তি বজায় থাকে। যেমন কিছু কথা স্ত্রীর কাছে লুকোতে হয়, কিছু কথা আবার আত্মীয়-বন্ধুদের কাছেও; আবার সমবয়স্ক মিত্রদের কাছেও সব কথা প্রাণখুলে বলতে নেই—তাহলেই সবকিছু যথাযথ থাকে। সংসারে শান্তি বজায় থাকে, আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল থাকে, এমনকি মিত্ররাও ঈর্ষান্বিত হতে পারেন না যদি না আপনি আপনার বৈভবের কথা তাদেরকে খুলে না বলেন। সবকিছু ঠিক যেমনটি আছে সেইভাবে বজায় রাখবার একমাত্র উপায়টি হল সকলকে সকল কথা না বলা। তাই বিবেকবান মানুষ যাঁরা, অর্থাৎ বিচারবিশ্লেষণের ক্ষমতা যাঁদের আছে, তাঁদের উচিত সবদিক বিচারবিবেচনা করে কাউকে কোন কথা বলা বা না বলা।

দমনকের মুখে এইসব বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে পিঙ্গলক চিন্তা করলেন, “যোগ্যোঽযং দৃশ্যতে”— কথায়-বার্তা শুনে একে তো বেশ যোগ্য ব্যক্তিই মনে হচ্ছে। একে নিজ অভিপ্রায় বা আশঙ্কার কথা বলা যেতেই পারে। কারণ শাস্ত্র বলে—

সুহৃদি নিরন্তরচিত্তে গুণবতি ভৃত্যেঽনুবর্তিনি কলত্রে।
স্বামিনি সৌহৃদযুক্তে নিবেদ্য দুঃখং সুখী ভবতি।। (ঐ, ১১০)


অর্থাৎ অভিন্নহৃদয় মিত্র, গুণী সেবক এবং স্বামীর প্রতি যথার্থ কর্তব্যকর্মে নিরত স্ত্রীর কাছে মনোগত দুঃখের কথা বলে মানুষ সুখ লাভ করে। এই দমনকের কথায়-বার্তায় মনে হচ্ছে এ একজন গুণী রাজভৃত্য। তাই এর কাছে গোপন কারণটি বলা যেতেই পারে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪: সুন্দরবনের লবণ-বৃত্তান্ত

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১: জয়রামবাটির আদরের ছোট্ট সারু

রাজা পিঙ্গলক তখন বললেন, “ভো দমনক! শৃণোষি শব্দং দূরান্মহান্তম্‌”—ওহে দমনক! দূর থেকে ভেসে আসা ভয়ানক শব্দটি শুনতে পাচ্ছো কি?

দমনক তখন কিছুই যেন বুঝতে পারছে না এরকম মুখ করে বলল, হ্যাঁ মহারাজ! শুনতে তো পাচ্ছি। কিন্তু তাতে কী হল?

পিঙ্গলক বললেন, আমি এই জঙ্গল ছেড়ে চলে যেতে চাই।

— কী জন্য মহারাজ?”

— এই বনের মধ্যে সম্ভবত শক্তিশালী বিচিত্র কোন নতুন প্রাণী প্রবেশ করেছে। ওর কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্য শুনে বেশ বুঝতে পারছি যে সে নিঃসন্দেহে পরাক্রমী কোনও প্রাণী হবে। তাই নিজের সুরক্ষার অভাব বোধ করছি আমি এই বনে।

দমনক তখন বললেন, যদি সামান্য ধ্বনিটুকু শুনেই আপনি এতটা ভীত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে বলবো এটা আপনি ঠিক করছেন না। শুধু একটা শব্দমাত্র শুনে আপনার মতো মৃগেন্দ্রের ভয়ভীত হয়ে পূর্বপুরুষের কালে উপার্জিত এই বনরাজ্য ছেড়ে যাওয়াটা আপনার উচিত নয়। কারণ ভেরি বা নাগাড়া, বেণু, মৃদঙ্গ, তাল, পটহ বা ডাক, শঙ্খ, কাহল বা শানাই প্রভৃতি নানারকম জিনিসের নানারকমের শব্দ আছে। তাই শুধু শব্দ শুনে আপনার ভয় পাওয়াটাকে আমি একেবারেই সমর্থন করতে রাজি নই। রাজনীতি শাস্ত্র বলে—ভয়ঙ্কর শত্রুর আক্রমণেও যে রাজা অধৈর্য হন না, সে রাজা কখনও পরাজিত হন না। সত্যি কথা বলতে যে মানুষ বিপদে বিষণ্ণ হয় না, সম্পদেও দাম্ভিক হয় না, এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও কখনও ভয়ভীত হয় না—এই তিনজনই হলেন মাতা পৃথিবীর রত্নস্বরূপ। আর শক্তিহীন হওয়ায় জন্য অন্যের দোর্দণ্ড প্রতাপে যে ব্যক্তি বিনম্র ও নিস্তেজ হয়ে যায়, সেই ক্ষুদ্র মানহীন ব্যক্তির জীবন একটা সামান্য তৃণের সমান—এর বেশি কিছু নয়।

দমনক বলে, তাই এইসব শুনে আমার অভিমত, হে রাজন! আপনি ধৈর্যচ্যূত হবেন না। শুধু শব্দশুনেই ভয় পাবেন না। আমিও একবার আপনার মতো ভুল করছিলাম। চামড়ায় ঢাকা একটা জিনিসের পেটের মধ্যে ঢুকে ভেবেছিলাম যে তার ভিতরটা চর্বিতে ভরা থাকবে; দিব্যি আরাম করে কয়েকদিন খেতে পারবো। কিন্তু তারপর দেখি সেটা একটা চামড়া ঢাকা শুকনো কাঠ মাত্র।

পিঙ্গলক বলল, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না, কিন্তু বিস্তৃতভাবে শুনতে চাই। দমনক তখন বিস্তারে সে গল্প বলতে শুরু করে।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content