শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

সিংহ পিঙ্গলককে এই জন্যেও সাধুবাদ জানানো উচিত যে, সে এতটা সময় ধরে মনোযোগ দিয়ে মন্ত্রীপুত্র দমনকের তিরষ্কার শুনে চলেছে। দমনকের মতে, সূর্য যেমন সারা আকাশে তাঁর কিরণদ্যুতি বিস্তার করে শোভা পায়, লোকের অনুগ্রহকারী রাজাও তেমনই। অধীনস্থ সুযোগ্য কর্মচারী বা ভৃত্যরাই হন রাজার সেই তেজদ্যুতি। রাজা শোভা পায় একমাত্র সেই অধীনস্থ সুযোগ্য কর্মচারীরা রাজার সঙ্গে থাকলে। রাজার তেজ, বিচক্ষণতা কিংবা তাঁর কর্মক্ষমতা সব কিছুই নির্ভর করে তাঁর অধীনের সুযোগ্য কর্মচারীদের উপরেই। সেই কর্মচারীরাই হলেন জনগণের কাছে রাজার প্রতিনিধি। প্রজাদের নিত্যদিনের প্রশাসনিক কাজেকর্মে সেই কর্মচারীদেরকেই তাঁরা সামনে দেখতে পান, রাজাকে নন। তাই রাজা স্বয়ং বিচক্ষণ হলেও তাঁর কর্মচারীরা যদি যথাযথ না হন, তাহলে জনগণের কাছে রাজার মহিমা বা কর্মদক্ষতা কখনই সঠিকভাবে প্রকাশিত হয় না।

তাই প্রজাদের কাছে রাজার নিজের ভাবমূর্তিকে সঠিকভাবে ধরে রাখতে গেলেও সুযোগ্য রাজকর্মচারীর প্রয়োজন। যিনি না ডাকতেই সবসময়ে রাজার আশেপাশেই থাকেন এবং সর্বদা রাজাকি আদেশ করবেন সেটা যথাযথভাবে পালন করবার জন্য সতর্ক হয়ে অপেক্ষা করেন কিংবা রাজা কোনও বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলে যাঁরা সত্য কথাটা অত্যন্ত সংক্ষেপে এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে বলতে পারেন সেই রকম কর্মচারীকেই রাজার মাথায় করে রাখা উচিত, তিনিই ‘ভৃত্যার্হ’। রাজার বিপদের কোনও সম্ভাবনা দেখলে রাজার অনুমতি অপেক্ষা না করেই যাঁরা তার প্রতিকারের প্রচেষ্টায় কাজে নেমে পড়েন তাঁরাই একমাত্র যোগ্য রাজসেবক।

এমনকি কোনও সেবককে রাজা যদি কোনও কারণে বকা-ঝকাও করেন বা অপমানিত করে দণ্ডও দেন, তাহলেও রাজার অনিষ্ট চিন্তা করেন না তাঁরাই একমাত্র রাজার সেবা করার যোগ্য বলে নীতিশাস্ত্রজ্ঞরা মনে করেন—তাডিতোঽপি দুরুক্তোঽপি দণ্ডিতোঽপি মহীভূজাম্‌। যো ন চিন্তযতে পাপং স ভৃত্যোঽর্হো মহীভূজাম্‌।। (মিত্রভেদ ৯৭)

বিষয়টা হল, রাজা লাথি-ঝাঁটা মারলেও যাঁরা রাজার বিরুদ্ধে টু-শব্দটিও করেন না, এমনকি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবার কথাটাও চিন্তা করেন না, তাঁরাই একমাত্র রাজকর্মচারী হওয়ার যোগ্য।আজকের গণতন্ত্রের যুগে উপরের কথাগুলো শুনতে আশ্চর্য লাগলেও ভুলে যাবেন না আমরা যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়টা ছিল রাজতন্ত্রের যুগ। আর এই গ্রন্থটি যখন লেখা হয়েছে তখনও যিশুখ্রিস্টের জন্মাতে প্রায় ৫০ -১০০ বছর দেরি আছে। ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখলেও বুঝতে অসুবিধা হবে না যে আজকের দিনের ক্ষমতালোভী ও সাম্রাজ্যবাদী একনায়করাও প্রাচীনকালের সেই বিজিগীষু রাজাদের মতনই তাঁর অধীনের কর্মচারীদের নিঃশর্ত আত্মনিবেদনই দাবী করে থাকেন। তফাৎ শুধু একটাই, প্রাচীনকালে রাজারা কেবল তাঁর অধীনের কর্মচারীদেরই নিঃশর্ত বশ্যতা চাইতেন, কিন্তু ক্ষমতালোভী একনায়কেরা চিরকাল শুধু তাঁর অধীনের কর্মচারীদেরই নন, প্রজাদেরও নিঃশর্ত বশ্যতা কামনা করে।

তবে আজকের দিনেও সরকারী কর্মচারীদের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামবার বিধিনিষেধ অবশ্যই আছে। তবে নাগরিক হিসেবে হলেও গণতান্ত্রিক সরকারের সমালোচনা করা বা তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলাটা আজকের দিনেও সরকার যে খুব ভালোভাবে নেয় তা কিন্তু নয়। আশেপাশে তাকালেই তার হাজার হাজার নজির আপনি নিজেই খুঁজে পাবেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১১: অধীনস্থ কর্মীদের উৎসাহ দিয়ে মানবসম্পদকে কী করে ব্যবহার করতে হয় সে বিদ্যা সুদক্ষ শাসকের থাকা উচিত

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৫: আমার পায়ে ঝিঁ ঝিঁ, আমি জ্ঞান হারিয়েছি

যাইহোক, এই প্রসঙ্গে অর্থশাস্ত্রের কয়েকটা কথা জেনে নেওয়া যাক। আসলে রাজা যে সমস্ত কর্মচারীদের নিয়োগ করবেন, তাঁরা যে ঠিক কতটা রাজার প্রতি নিবেদিত প্রাণ সেটা জানবার উপায়টা কী? মানে আজকের দিনে তো সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা আছে, সিভিল সার্ভেন্টদের মানসিকতা বোঝবার অনেক রকম পার্সোনালিটি টেষ্ট আছে; কিন্তু সেকালে ব্যাপারটা ঠিক কেমন ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই আমাদের দেখতে হবে অর্থশাস্ত্রের পাতায়। প্রাচীন ভারতের রাজনীতি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে গেলে অর্থশাস্ত্রই একমাত্র আপনাকে পথ দেখাতে পারে। আগেই বলেছি যে কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধিকরণটির নাম হল বিনয়াধিকরণ।

দশম অধ্যায়ের বিষয় হল “উপধাভি শৌচাশৌচজ্ঞানমাত্যানাম্‌”, অর্থাৎ উপধা বা ছল প্রয়োগ করে রাজকর্মচারীদের মধ্যে যে শুদ্ধ আর কে অশুদ্ধ সেই পরীক্ষা কী করে করতে হবে এখানে সেই নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। এর আগের অধ্যায়ে (মন্ত্রিপুরোহিতোত্পত্তিঃ) অমাত্য বা রাজকর্মচারী হতে গেলে কী কী যোগ্যতা থাকাটা প্রয়োজন কৌটিল্য তার একটা লম্বা তালিকা ধরিয়ে দিয়েছেন। যেমন সেই লোককে অবশ্যই সেই জনপদের অধিবাসী হতে হবে। তাঁকে হতে হবে দক্ষ, প্রজ্ঞাবান, সৌম্যদর্শন, দম্ভহীন সেইসঙ্গে কথাবার্তায় চৌখস। মানে যাকে বলে, ‘প্রগল্ভ’ —কাজেকর্মে বা কথাবার্তায় যিনি স্পষ্টভাষী এবং সাহসী। তাঁকে হতে হবে ‘চক্ষুষ্মান’ মানে রাজনীতিতে দূরদর্শী এবং সেইসঙ্গে অর্থশাস্ত্রে অভিজ্ঞ। যাঁদের মধ্যে উত্সাহগুণ আছে। মানে যাঁদের কোনও কাজ করতে দিলে সেই কাজে কী কী সমস্যা হতে পারে সেই ভয়ে কাজ করা থেকে বিরত না থেকে বরং সেই কাজটি করতে গিয়ে সমস্যা হলে কীভাবে তার সমাধান করতে হবে সেইসব দিকে নজর দেন তাঁরাই হলেন উত্সাহগুণ সম্পন্ন—এই রকম প্রায় পঁচিশটা গুণের লম্বা তালিকা বলেছেন এই সমস্ত গুণের এক-চতুর্থাংশ যাঁর মধ্যে কম থাকে, তিনি মধ্যমশ্রেণির অমাত্য; আর এই গুণগুলির অর্ধেক অংশ যাঁর মধ্যে কম থাকে, তিনি অবর বা অধম শ্রেণির অমাত্য বলে পরিগণিত হন।

সুতরাং এবার বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধা নেই যে যাঁর মধ্যে সমস্ত অমাত্য গুণ থাকে তিনিই মন্ত্রী পদের দাবীদার হন। কিন্তু সেই মন্ত্রী পদের জন্য কোন অমাত্য যোগ্য সেটা জানতেই ‘উপধা’ বা ছলনার মাধ্যমে অমাত্যদের শুদ্ধি বা অশুদ্ধি বিচার করা হত সে যুগে। ব্যাপারটা অনেকটা আমাদের আজকের দিনের পার্সোনালিটি টেস্টের মতো, কিন্তু সেটা ছিল বেশ কঠিন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৮: মনে পড়ে পঞ্চমের কণ্ঠে শোলে ছবির সেই বিখ্যাত ‘মেহবুবা মেহবুবা…’ গানটি?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩: সুন্দরবনে মানুষের আদি বসতি

অমাত্যদের মোট চার রকমের উপধা পরীক্ষায় পাশ করতে হতো সে যুগে, তবে গিয়ে তিনি মন্ত্রীপদ লাভ করতেন সে যুগে। প্রথমটি ছিল ‘ধর্মোপধা’ —এর দ্বারা কোনও এক অমাত্য, যাঁকে রাজা নিযুক্ত করতে চান, তিনি রাজার প্রতি ঠিক কতটা কর্তব্যশীল সেইটা বোঝবার চেষ্টা করা হতো। কৌটিল্য বলেন, এই কাজে রাজাকে সাহায্য করবেন রাজার বিশ্বস্ত পুরোহিত। তিনি প্রথমে ছল করে রাজার পরামর্শ মতো কোনও একটি অধর্ম কাজ করবেন। সে আমলে যজ্ঞ করবার অধিকার ছিল তিন বর্ণের—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের। মনে রাখতে হবে যে সমাজটা ছিল সে আমলে বর্ণধর্ম ভিত্তিক সমাজ।

কিন্তু বর্তমান সংবিধানের ১৫ নম্বর ধারায় (Article 15) বর্ণ-ধর্মভিত্তিক সেই প্রাচীন ব্যবস্থাকে ভারতবর্ষের মানুষ আজ অবলুপ্তি ঘটিয়েছে। সে আমলটা তেমন ছিল না। সে আমলে শূদ্রব্যক্তি, যাঁর বেদ পাঠে অধিকার ছিল না, ছলনা করে রাজা সেইরকম কোনও ব্যক্তিকে বেদ পাঠ করাতে কিংবা যাঁর যাগ কর্মে অধিকার নেই সেইরকম শূদ্রজাতীয় ব্যক্তির বাড়িতে যজ্ঞ করাতে পুরোহিতকে নিযুক্ত করবেন। সেই পুরোহিত এইরকম কোনও এক অধর্মাচরণ করলে রাজা তাঁর উপর রেগে যাবেন এবং তাঁকে অনেক অপমান করে তাঁর পদ থেকে তাঁকে অপসারিত করবেন। মনে রাখবেন পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু সাজানো।

খেলাটা শুরু হবে এর পরে। সেই পুরোহিত, যিনি ছল করে অপমানিত হওয়ার অভিনয় করছেন, তিনি রাজার সত্রি নামক গুপ্তচরদের সঙ্গে নিয়ে সেই অমাত্যদের যাঁদের গুণ বিবেচনা করে রাজা প্রভিশানাল পদে নিযুক্ত করেছেন, তাঁদের মধ্যে রাজার বিরুদ্ধে উপজাপিত করবেন। বলবেন—“অধার্মিকোঽযং রাজা, সাধু ধার্মিকমন্যমস্য তত্কুলীনমবরুদ্ধং কুল্যমেকপ্রগ্রহং সামন্তমাটবিকমৌপপাদিকং বা প্রতিপাদযামঃ। সর্বেষামেতদ্রোচতে, কথং বা তব?”

অর্থাৎ সেই পুরোহিত যে কথাগুলো বলবেন সেগুলো অনেকটা এইরকম—আমাদের এই রাজা অধার্মিক; কথায় আর কাজে মিল নেই। আমরা তাঁর বদলে ধার্মিক অন্য কাউকে রাজপদে বসাবো। সে ব্যক্তি রাজপরিবারের কেউ হতে পারেন বা তাঁর রাজ্যে বন্দি তাঁর পুত্রপরিজনের মধ্যেও কেউ হতে পারেন; অথবা উচ্চবংশের কোনও মানুষ যাঁকে সবাই মান্যি-গণ্যি করেন কিংবা কোনও সামন্তরাজা বা অটবীপতিকে রাজপদে বসাবো আমরা, কিন্তু এই রাজা আর নয়। এটাই সকল অমাত্যদের মত, আপনার এ বিষয়ে অভিমতটা জানতেই আমার এখানে আসা।

রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে দফা বৃদ্ধি করা জরুরি?
ভাবুন তো এই ভাবে যদি কোনও উচ্চপদের রাজকর্মচারী আপনার কাছে এসে বলে তাহলে আপনার পরিস্থিতিটা কেমন হতে পারে? ভাবতে পারছেন? যদি সেই অমাত্য এই ফাঁদে পা না দেন তাহলেই তিনি ‘ধর্মোপধা’ শুদ্ধ, মানে চারিত্রিক সততাযুক্ত বা রাজভক্ত বলে বুঝতে হবে। ঠিক একই রকমভাবে সেনাপতিও রাজার পরামর্শেই কিছু অনৈতিক কাজ করবেন এবং রাজা তাঁকে ছল করে দণ্ড দেবেন ও তাঁকে তাঁর পদ থেকে বহিষ্কৃত করবেন।

সেই সেনাপতি তখন একই রকমভাবে সত্রি-নামক গুপ্তচরদের সাহায্য নিয়ে প্রত্যেক অমাত্যকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে আগে যেভাবে পুরোহিত ধর্মোপধা পরীক্ষার সময়ে রাজার বিনাশের জন্য উপজাপিত করেছিলেন ঠিক সেইভবে উপজাপিত করবেন এবং জিজ্ঞাসা করবেন, “সর্বেষামেতদ্রোচতে, কথং বা তব”—আমাদের সকলেই এইটাই মত। এই অধার্মিক রাজাকে সড়িয়ে দিয়ে তাঁর জায়গায় অন্য রাজাকে আমরা বসাবো, যিনি আমাদের কথা মতন চলবেন—এখন আপনার কি মত? ফাঁদে পা না দেওয়া মানেই সেই অমাত্য ‘অর্থোপধা’ পরীক্ষায় পাশ করে গেলেন। বুঝতে হবে টাকা-পয়সার জন্য রাজার বিরোধিতা সে করবে না।

এইভাবে পরিব্রাজিকা মানে ভিক্ষুকীর বেষধারী কোনও এক গুপ্তচর, যিনি অন্তঃপুরের রাজমহিষীদের ভরসার মানুষ বলে সকলে জানেন, তিনি রাজার নির্দেশে ছল করে এক একজন অমাত্যকে, যাঁরা এখনও প্রোভিশানাল প্রিরিওডে আছেন তাঁদেরকে উপজাপিত মানে রাজার কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন করবার জন্য বলবেন, “রাজমহিষী ত্বাং কামযতে কৃতসমাগমোপাযা। মহানর্থশ তে ভবিষ্যতি।” অর্থাৎ রাজমহিষী আপনাকে কামনা করেন এবং তিনি আপনার সঙ্গে গোপনে সমাগমের উপায়ও স্থির করেছেন। এ জন্য আপনার অর্থসমাগমের সম্ভাবনাও হবে প্রচুর। মহামাত্যরা যদি একথা প্রত্যাক্ষান করেন তবে তিনি ‘কামোপধা’ শুদ্ধ। বুঝতে হবে যে নারী ঘটিত কারণের জন্য সে অন্ততঃ রাজার বিরুদ্ধাচরণ করবে না।

‘ভয়োপধা’ পরীক্ষাটি হল সবচেয়ে কঠিন। কোনও এক প্রবহণে তিনি সব নতুন অমাত্যদের নিমন্ত্রণ করবেন। আজকাল যেমন বড় নৌকায় চেপে “ওন্‌ বোর্ড বার্জ পার্টি” হয় ব্যাপারটা সেইরকম। সেখানে পূর্বতন বিশ্বাসভাজন অমাত্যদের সাহায্যে রাজা ছল করে নতুন অমাত্যদের কোনও একটা অনৈতিক কাজে ফাঁসিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করবেন। আপনিনিজেকে সেই জায়গায় বসিয়ে ভাবলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে। ব্যাপারটা অনেকটা পার্টিতে চুপিসারে কেউ একজন আপনার পকেটে গাঁজা বা হেরোইনের প্যাকেট ঢুকিয়ে আপনাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে ভরে দেওয়ার মতো।

আপনি নিজে জানেন যে আপনি এই কাজ করেননি কিন্তু ইচ্ছে করে আপনাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই অপরাধের দণ্ড কতটাকি হতে পারে সেই ভেবে আপনি যখন বেশ ভয়েও আছেন, ঠিক এই সময়ে জেলের মধ্যে আগে থেকেই বন্দি থাকা একজন কাপটিক ছাত্র, যিনি আসলে রাজারই একজন গুপ্তচর তিনি এসে আপনাকে বলবেন, “অসৎপ্রবৃত্তোঽযং রাজা সাধ্বেনং হত্বা অন্যং প্রতিপাদযিষ্যামঃ। সর্বেষামেতদ্রোচতে কথং বা তব?”
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫০: আমার সোনার হরিণ চাই—সীতার চাওয়া কি সত্যি হবে?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২১: আবার কালাদেও?

ব্যাপার অনেকটা এইরকম যে, এই রাজা শুধু অসৎ লোকেদের কথাই শোনে এবং তাঁদেরই পরামর্শ মতনই ভালো যোগ্যতা সম্পন্ন লোকেদের ফাঁসিয়ে জেলে ভরে রাখে; যাতে তাঁর কারসাজি কেউ বুঝতে না পারে। এই অধার্মিক রাজাকে হত্বা করে অন্যকে রাজপদে আমরা রাজসিংহাসনে বসাবো। সকলের এইটাই অভিমত এবার আপনি কি ভাবছেন বলুন? এইসব কথা শুনে আপনি যদি প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে আপনি লয়াল্টি টেস্ট-এ পাশ করে গেলেন—আপনি ‘ভয়োপধা’ শুদ্ধ। না হলে ফেল।

কৌটিল্য বলেন, যে সমস্ত অমাত্যরা ‘ধর্মোপধা’ পরীক্ষায় পাশ করলেন তাঁরা ন্যায়নিষ্ঠ। তাঁদেরকে ধর্মস্থীয় মানে কোর্ট বা জ্যুডিশিয়ারিতে নিযুক্ত করবেন। যাঁরা ‘অর্থোপধা’ শুদ্ধ তাঁদের সমাহর্তা বা সন্নিধাতার কার্যবিভাগে নিযুক্ত করবেন। মানে যেসমস্ত বিভাগে প্রচুর টাকাপয়সা নাড়াচাড়া করতে হয় সেইসব বিভাগের কাজে তাঁদেরকে যুক্ত করবেন।

‘কামোপধা’ পরীক্ষায় যাঁরা শুদ্ধ বলে বিবেচিত হয়েছেন তাঁদের রাজা অন্তঃপুরের কাজে নিযুক্ত করবেন আর ‘ভয়োপধা’ শুদ্ধ যাঁরা তাঁদেরকে রাজা নিজের সমীপবর্তী কাজে সঙ্গে সঙ্গে রাখবেন আর যাঁরা সর্বোপধা শুদ্ধ—সবগুলি উপধা পরীক্ষায় পাশ করেছেন যাঁরা তাঁদের সত্যনিষ্ঠতা নিয়ে কোনও রকম প্রশ্ন জাগতে পারে না, তাই তাঁদেরকেই রাজা মন্ত্রী পদে নিযুক্ত করবেন আর যাঁরা কোনও উপধাতেই পাশ করতে পারেননি রাজা তাঁদের খনিদ্রব্য, হস্তিবন ও বিভিন্ন কর্মান্ত মানে কারখানা প্রভৃতি পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত পরিশ্রম সাধ্য কাজে নিযুক্ত করবেন।

দমনকের মতে, রাজাকে এতোসব বিবেচনা করেই কিন্তু কর্মচারী নিয়োগ করা উচিত। না হলে রাজা প্রজাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন না।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content