ছবি: সংগৃহীত।
প্রাককথন
আজকের থেকে প্রতি পর্বে একটু একটু করে আমরা আলোচনা করবো প্রাচীন ভারতবর্ষের সংস্কৃত ভাষায় লেখা অন্যতম একটি জনপ্রিয় বই নিয়ে। তবে তার আগে, মানে এইসব “রাজনীতি-কূটনীতি”—নতুন এই ধারাবাহিকে প্রবেশ করার আগেই, আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আচ্ছা প্রাচীন ভারতের এমন একটা বইয়ের নাম কি আপনি বলতে পারবেন যা জরাথ্রুস্টের ধর্মের অনুসরণকারী ৫ম বা ৬ষ্ঠ শতাব্দীর ইরানি চিকিৎসক বুর্জুয়েঁ, কিংবা অষ্টম শতাব্দীর ইসলাম ধর্মাবলম্বী ইরাণের অধিবাসী আবদুল্লা-ইবন-আল-মুকাফ্ফা (Ibn al-Muqaffa) কিংবা আলি-আল-ওয়াইজ কাশেফি (Ali al Waiz Kashefi) অথবা খ্রিস্টাধর্মাবলম্বী বিংশ শতাব্দীর জার্মান পণ্ডিত জোহানস হের্টেল (Johannes Hertel) বা আমেরিকান ভাষাতাত্ত্বিক ফ্রাঙ্কলিন এডগার্টন (Franklin Edgerton) সকলেই পঞ্চমুখে প্রশংসা করেছেন? উত্তর জানা না থাকলে বা এই বিষয় নিয়ে মনে আগ্রহ জন্মালে ‘সময় আপডেটস’-এর এই বিশেষ ধারাবাহিকটি আপনার জন্য। সেই বইটির নাম “পঞ্চতন্ত্র”। আমাদের অতি পরিচিত একটা ছোটবেলার সেই বইটি, শিশুকাল থেকেই যার সঙ্গে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। আজকে থেকে প্রতি সোমবার ‘সময় আপডেটস’-এর এই পাতায় আমরা কথা বলবো পঞ্চতন্ত্রের রাজনীতি-কূটনীতি নিয়েই।
তবে মূল প্রবন্ধে ঢোকবার আগে আপনাদের একটা মজার তথ্য দিই। পঞ্চতন্ত্রের উপর পাওয়া পুরোনো পুঁথিগুলো খুঁজলে দেখবেন এই “পঞ্চতন্ত্র” বিভিন্ন নামে আমাদের এই ভারতভূমিতে পরিচিত ছিল। খুঁজলে কখনও হয়তো সেই পুঁথিগুলোতে “তন্ত্রাখ্যায়িকা”, বা “পঞ্চাখ্যানকা”, কিংবা “তন্ত্রোপখ্যান” এইরকম বিভিন্ন নাম পাবেন। এমনকি কিছুদিন আগে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত আমেরিকান অধ্যাপক প্যাট্রিক অলিভেল-এর নবতম পঞ্চতন্ত্রের সংস্করণের দীর্ঘ গবেষণা করে তিনি দেখিয়েছেন যে, এই গ্রন্থটির আসল নাম হল ‘নীতিপঞ্চতন্ত্রাখ্যায়িকা’। “আখ্যায়িকা” শব্দটি সংস্কৃত, আমরা বাংলাতেও ব্যবহার করি শব্দটি। মানে হল “কাহিনির সঙ্কলন”। তাহলে দেখুন এই “নীতিপঞ্চতন্ত্রাখ্যায়িকা” থেকে “নীতি” এবং “আখ্যায়িকা” শব্দ দুটি হারিয়ে গেল কালের নিয়মে। পড়ে রইল মাঝের মূল নামের ছোট্ট অংশটুকু “পঞ্চতন্ত্র”। আর এই “পঞ্চতন্ত্র” গ্রন্থটি লেখবার আবার একটা কাহিনিও আছে। সেই গল্প আমরা ‘পঞ্চতন্ত্র’ গ্রন্থের “কথামুখ” বা আজকের চলতি ভাষায় যাকে “মুখবন্ধ” বলি সেখানেই পাই। সেই কাহিনিটি শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন এই পঞ্চতন্ত্রের নামের আগে “নীতি” কথাটি কেন যুক্ত করা হয়েছিল। যদিও কালের নিয়মে আজকে সেইটি হারিয়ে গিয়েছে। আজকের পর্বে সেই গল্পটাই আগে শুনে নেওয়া যাক।
যাইহোক এই তিন রাজপুত্রকে শাস্ত্রচর্চায় বিষয়ে অনুৎসাহী দেখে রাজা অমরশক্তি তাঁর সকল সচিবদের থেকে পরামর্শে চাওয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ ডাকলেন এবং বললেন, “আপনারা জানেন যে আমার পুত্রেরা শাস্ত্রবিমুখ এবং বিবেকজ্ঞানহীন। ভালোকে মন্দ থেকে আলাদা করবার বুদ্ধি তাদের এখনও হয়নি আর তাদের এই দশা দেখে বিশাল এই রাজ্যও আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। কারণ সেই কথায় বলে না—
দম্পতি যদি নিঃসন্তান হন, কিংবা জন্মাবার পরেই যদি সন্তানের মৃত্যু হয় বা তাদের যদি শাস্ত্রবিমুখ বা বিবেকজ্ঞানহীন মূর্খ পুত্র হয়—এই তিনটি বিকল্পের মধ্যে বরং নিঃসন্তান হওয়া বা জন্মের পরেই সন্তানের মৃত্যু হয়ে যাওয়া ঢের বেশি ভালো। কারণ, সেই দুই ক্ষেত্রেই পিতামাতার কিছুকাল দুঃখ করেন বটে কিন্তু তারপর কালের নিয়মেই সেসব তারা আবার ভুলেও যান। কিন্তু কোনও দম্পতির যদি বিবেকজ্ঞানহীন মূর্খ পুত্র থাকে সেই পুত্র সারাজীবন তাঁদের দুঃখের কারণ হয়। কারণ সেই মূর্খ-অকর্মণ্য বিবেকজ্ঞানহীন পুত্র পিতা-মাতাকে দিন-রাত শুধু দুঃখই দেয়।
অজাতমৃতমুর্খেভ্যঃ মৃতজাতৌ সূতৌ বরম্।
যতস্তৌ স্বল্পদুঃখায যাবজ্জীবং জডো দহেৎ।।
শাকুন্তলম্: প্রেমের পরবশ থেকে মাতৃত্বের উত্তরণ
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৩: সীতার মনে কি আশঙ্কার অশনি সংকেত?
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৬০: দুই ভাইয়ের সাক্ষাৎ হল, হনুমানের রূপে মুগ্ধ হলেন ভীমসেন
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩২: কি ‘উপহার’ সাজিয়ে দেব
সেই পণ্ডিতবর্গের মধ্যে একজন বললেন, “হে রাজন! শুনেছি যে শুধু ব্যাকরণ ভালোভাবেই পড়তেই তো বারো বছর লেগে যায়। তারপর তো মনু, যাজ্ঞবল্ক্য এঁদের সঙ্কলিত “ধর্মশাস্ত্র”; বা চাণক্যেদের লেখা “অর্থশাস্ত্র”; আর তারপর বাত্স্যায়ন ও অন্যান্য ঋষিদের লেখা রচিত “কামশাস্ত্র”—তবে গিয়ে “ধর্ম”, “অর্থ” ও “কাম”—এই ত্রিবর্গ বিষয়ে একটা ধারণা জন্মায়।” সেই আমলের সিলেবাসটা খেয়াল করুন। পণ্ডিত হতে গেলে কতো কিছু পড়তে হতো। এইসব শুনে রাজা রীতিমতো চিন্তিত হলেন।
তখন সেই সভায় সুমতি বলে এক রাজসচিব ছিলেন। তিনি ব্যাপারটা বুঝে বললেন, “অশাশ্বতোঽয়ং জীবিতব্যবিষয়ঃ। প্রভূতকালজ্ঞেয়ানি শব্দশাস্ত্রাণি” মানুষের জীবন তো ক্ষণভঙ্গুর, কিন্তু শব্দশাস্ত্রের সমগ্র জ্ঞান লাভ করতে গেলে তো জীবন অতিবাহিত হয়ে যাবে। তাই এই রাজকুমারদের নীতিশাস্ত্রে ব্যুৎপন্ন করতে গেলে সংক্ষিপ্তভাবে শাস্ত্রপাঠ ও বিচারের প্রয়োজন। কারণ, এইরকম বলা হয়ে থাকে যে—
অনন্তপারং কিল শব্দশাস্ত্রং স্বল্পং তথাঽঽয়ুর্বহবশ্চ বিঘ্নাঃ।
সারং ততো গ্রাহমপাস্য ফল্গু হংসৈর্যথা ক্ষীরমিবাম্বুমধ্যাৎ।।
সমুদ্র সমান বিশাল এই শব্দশাস্ত্র, কিন্তু তা আহরণের জন্য মানুষের আয়ু অত্যন্ত স্বল্প এবং তারমধ্যেও আছে বহু বিঘ্ন। তাই হংস যেমনভাবে দুগ্ধের মধ্যে থেকে অপ্রয়োজনীয় জলটিকে আলাদা রেখে সার অংশটিকে গ্রহণ করে নেয়, সেইরকম ভাবেউ সমস্তশাস্ত্রের সারমাত্রই গ্রহণ করতে হবে।
তাই রাজসচিব সুমতির অভিমত হল, বিষ্ণুশর্মা নামক এক ব্রাহ্মণ আছেন, “ছাত্রসংসদি লব্ধকীর্তিঃ” —ছাত্রসমাজে যিনি তাঁর কীর্তির জন্য খ্যাত। তাঁর কাছেই রাজপুত্রদের সমর্পণ করা হোক। তিনিই একমাত্র নিশ্চিতরূপে দুর্মেধা এই তিন রাজপুত্রকে দ্রুত বিদ্বান করে তুলতে সক্ষম হবেন।”
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬: রামচন্দ্রের আবির্ভাব ও বসুন্ধরাকন্যা সীতার অনুষঙ্গ
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫১: সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার প্রয়োজন, তবেই বাড়বে মাছ নিয়ে সচেতনতা, উপকৃত হবে আমজনতা
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০: তত্ত্বতালাশ
বিষ্ণুশর্মা জানালেন, “হে রাজন! ‘শ্রূয়তাং মে তথ্যবচনম্। নাহং বিদ্যাবিক্রয়ং শাসনশতেনাপি” আমার পরিষ্কার কথাটি শুনুন হে রাজন! একশত গ্রামের অধিপতি করলেও বিদ্যাবিক্রয়ে আমি আগ্রহী নই। তথাপি আপনার পুত্রদের যদি ছয়মাসের মধ্যে আমি রাজনীতিশাস্ত্রে অভিজ্ঞ করে তুলতে না পারি তাহলে আমি আমার নিজের নাম পরিত্যাগ করবো। আমার এই সিংহনাদ আপনি শ্রবণ করুন। আমার অর্থলিপ্সা নেই। আমি একজন অশীতিপর বৃদ্ধ আমার ইন্দ্রিয়গুলিও তার ভোগ্য বিষয়গুলি থেকে নিবৃত্ত হয়েছে, তাই অর্থের আমার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আপনার প্রার্থনা সিদ্ধির জন্য আমি বাগ্বিনোদে, মানে বিদ্যাচর্চায় আগ্রহী। ‘তল্লিখ্যতামদ্যতনো দিবসঃ’ তাই লিখে রাখুন আজকের এই দিনটি। যদি ছয় মাসের মধ্যে আমি আপনার পুত্রদের নীতিশাস্ত্রের অনন্যসাধারণ পণ্ডিত না করে তুলতে পারি তবে ঈশ্বর যেন আমায় স্বর্গের পথ থেকেও বঞ্চিত করেন।”
অশীতিপরবৃদ্ধ ব্রাহ্মণের এইরকম অসম্ভব প্রতিজ্ঞা বাক্য শুনে প্রহৃষ্ট রাজা বিস্ময়ান্বিত হয়ে সাদরে রাজকুমারদের তাঁর কাছে সমর্পণ করলেন। বিষ্ণুশর্মাও তখন তাঁদের এনে, তাঁদের জন্য “মিত্রভেদ-মিত্রপ্রাপ্তি-কাকোলূকীয়ম্-লব্ধপ্রণাশম্-অপরীক্ষিতকারকম্” নামে পাঁচটি তন্ত্র বা অধ্যায় রচনা করে রাজপুত্রদের পড়ালেন আর রাজপুত্রেরাও সেইটি পড়ে ছয়মাসের মধ্যে নীতিশাস্ত্রে অনন্যসদৃশ হয়ে উঠল। পঞ্চতন্ত্রের কথামুখ অংশের দাবি অনুযায়ী সেই সময় থেকেই পঞ্চতন্ত্র নামক রাজনীতিশাস্ত্রের এই গ্রন্থটি বালকদের সহজে রাজনীতিশাস্ত্রে বোধ জন্মাবার সহায়করূপে এই পৃথিবীতে প্রচার লাভ করে। এই গ্রন্থটি সম্পর্কে সেই ভূমিকা অংশেই বলা হয়েছে—
অধীতে য ইদং নিত্যং নীতিশাস্ত্রং শৃণোতি চ।
ন পরাভবমাপ্নোতি শক্রাদপি কদাচন।।
অর্থাৎ, যে [পঞ্চতন্ত্ররূপ] এই নীতিশাস্ত্র নিত্য অধ্যয়ন করে অথবা শ্রবণ করে দেবরাজ ইন্দ্রকেও তাকে রাজনীতিতে পরাজিত করতে পারে না।
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৯: প্লেগে কন্যার মৃত্যু, সেই শোক অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে পায় ভিন্নতর মাত্রা
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৫: সারদা দাদার থেকে চিল্পিঘাটি
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭: পঞ্চমের কথা মতো ড্রাম ছেড়ে অমরুতের পিঠের উপর স্যাম্পল রিদম বাজাতে শুরু করলেন ফ্রাঙ্কো!
প্রথমটির নাম হল “মিত্রভেদ” — এই তন্ত্রে বা অধ্যায়ে দুইটি অভিন্নহৃদয় বন্ধু বা মিত্রের মধ্যে কী ভাবে ভেদ বা দূরত্ব তৈরী করা যায় সেই সংক্রান্ত কাহিনি রয়েছে এই তন্ত্রে। পরবর্তী “মিত্রপ্রাপ্তি” নামের তন্ত্রে রয়েছে যাদের নিজেদের দুজনের মধ্যে চিরশত্রুতা, প্রয়োজনে কীভাবে তাদের মধ্যে মিত্রতা তৈরি করা যেতে পারে। “কাকলূকীয়ম্” তন্ত্রেরও মূল বিষয় হল, পূর্বে যে রাজা বা ব্যক্তি আপনার বিরোধিতায় মগ্ন থাকতেন, পরবর্তীকালে সেই রাজা বা ব্যক্তিই যদি আপনার মিত্র হন, তবে সেইরকম মিত্ররূপধারী শত্রুকে বিশ্বাস করলে তার পরিণাম কী প্রকার হতে পারে সেই সংক্রান্ত কাহিনি সমষ্টি। “লব্ধপ্রণাশম্” নামক চতুর্থ তন্ত্রের বিষয় হল কারোর অর্জিত বা লব্ধ দ্রব্য কীভাবে বিনাশ হয়ে যায় বা কীভাবে বিনাশ করে দেওয়া সম্ভব। আর পঞ্চম “অপরীক্ষিতকারকম্” নাম তন্ত্রে, না বুঝে, না শুনে, না জেনে, না পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কাজ করবার ফল যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেই সংক্রান্ত কাহিনিগুলি একত্র সন্নিবিষ্ট হয়েছে।
তাহলে বুঝতেই পারছেন কেমন চিত্তাকর্ষক ছিল এই কাহিনিগুলো যা ৫ম বা ৬ষ্ঠ শতাব্দীর ইরাণী চিকিত্সক বুর্জুয়েঁ, বা অষ্টম শতাব্দীর ইরানি কবি আবদুল্লা-ইবন-আল-মুকাফ্ফা (Ibn al-Muqaffa) বা আলি-আল্-ওয়াইজ কাশেফি (Ali al Waiz Kashefi) বা বিংশ শতাব্দীর জার্মান পণ্ডিত জোহানস হের্টেল (Johannes Hertel) বা আমেরিকান ভাষাতাত্ত্বিক ফ্রাঙ্কলিন এডগার্টন (Franklin Edgerton) কেন বার বার ডুব দিয়েছেন এই কাহিনি সাগরে। কীভাবে এই গ্রন্থটি ছড়িয়ে পরে সারা পৃথিবীতে। এই সব নিয়ে কথা বলবো আমরা আমাদের পরবর্তী পর্বে। —চলবে