শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় দিনটা তাদের জন্য যারা “কথা কইতে জানে না।” আন্তর্জাতিক ইনট্রোভার্ট দিবস। ইনট্রোভার্ট কারা? অভিধান যাই বলুক, যারা যুগের ভাষায় “ইনট্রো” দিতে পারে না, তারাই ইনট্রোভার্ট। এরা তথাকথিত স্মার্ট নয়, অন্তর্মুখী, লাজুক। অন্তরেই যাদের কারবার, যারা অন্তরের ভাবকে বাইরে আনতে পারে না, জানে না, চায় না; তারাই এই গোত্রের। স্কুল থেকে কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র এদের দেখতে পাওয়া যাবে।

সমাজতত্ত্ব কিংবা মনোবিজ্ঞান সকলেই যে যার মতো করে এদের মনোবৃত্তি ব্যাখ্যা করে। কেউ কেউ হয়তো বলতে চাইবেন, এদের সমস্যা আছে বুঝি কিছু। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষমতা, বন্ধু শত্রু আত্মীয় অনাত্মীয় দেখলে “হাই” করার ক্ষমতা, বুকের পাটা, মেরুদণ্ডের শক্তি এবং পথ্যে অনুপানের মতো উপযুক্ত পড়াশোনা, এটিকেট, ডেকোরাম, শিক্ষা, মনোবল তাদের নেই। আলস্যে হাই তোলাই বুঝি এদের জীবনের পরা গতি।
প্রাকৃতিক নিয়ম বলে একদিকে ভাঙলে অন্যদিকে গড়ে। এদিকের কূল ভেঙে ওদিকে পলি জমে দ্বীপ গজায়। তো, এইসব “ভেঙে পড়া অক্ষম কাঁচা নামানুষের” না বলতে পারা “হাই” টা উঁচু (High) তারে বেঁধে বলে দেন উল্টোদিকের চরম স্মার্ট, পরম পাকা অতিমানব কিংবা মানবীর দল। সত্যি কথা, সৃষ্টির প্রাক্কাল থেকে আজ অবধি জীব থেকে মানুষ হয়ে ওঠাই নাকি মনুর সন্ততিদের লক্ষ্য ছিল। তবে আকাঙ্ক্ষা ছাপিয়ে, কেউ কেউ যদি অতিমানব হয়ে ওঠেন তবেই গোল বাঁধে। তাঁদের “প্রবল প্রজ্ঞা”র কাছে বাকি সকলের মুখের দরজায় ফুলস্টপ পড়ে যায়।

এইসকল অতিমানুষরা কেউ হয়ত সবে প্লে স্কুলে বসতে শিখেছেন, কেউ আবার অফিসের, ইন্টারভ্যুয়ের টেবিলের ওপারে, বাসে আপনারই পাশে কিংবা মিষ্টি হেসে বাঁশের একটা কিউট লাঠি হাতে আপনার পিছনেই দণ্ডায়মান। এদের আশেপাশে, পিছনে সামনে চতুর্দিকে যারা কেঁচো-কেন্নো-উইপোকা বা ছারপোকার মতো কিলবিল করছে তারাই ইনট্রোভার্ট।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৬: কে জানে ক’ঘণ্টা?

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৭: আশাপূর্ণা দেবী—স্বপ্ন আর সত্যির লেখক!

ভালো ছাত্র, ভালো শিক্ষক, ভালো মানুষ, ভালো গায়ক, লেখক সকলেই ইনট্রোভার্ট হতে পারেন। উল্টো দিকে মানুষ দেখলেই এদের গলা শুকিয়ে কাঠ, চোখে চোখ রাখতে হৃদকম্প, বলবো বলবো ভেবেও বলা হয়ে ওঠে না, যদি লোকে হাসে, কেউ কিছু বলে, চোখ কটমটিয়ে তাকায়, বাবাকে বলে দেয়, পাড়ায় গেলে ঠ্যাং ভেঙে দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি উপসর্গ এই রোগের স্পষ্ট লক্ষণ। খেলার মাঠে এরাই আব্বা কিংবা দুদুভাতু, স্কুলে এরা দাদাদের চাকর, সমাজজীবনে ক্যাবলা, কর্মক্ষেত্রে অকর্মণ্য। অথচ যারা কথা কইতে পারে, উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়ে, প্রবল আতিশয্যে উদ্বেল হয়, তাদের মুখে যদি কথার দোকান বসে, তো এই মুখচাপা বোকাদের মনে আর চোখে ভাবের শপিংমল।
আরও পড়ুন:

বারো ক্লাস ফেল ছেলের প্রায় জগৎ জয়ের কাহিনি মন ছুঁয়েছে সবার

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা

প্রাজ্ঞ মানুষ বলবেন, শূন্য কলসেই আওয়াজ বেশি, গাম্ভীর্য পক্বতার লক্ষণ। যারা প্রথিতযশা হয়েছেন তাঁরা কাজ করেই হয়েছেন, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হয়েছেন যুগে যুগে। গুটিয়ে থাকলে উষ্ণতা বাড়ে, মনের সঙ্গেও মুখোমুখি বসতে হয় কখনও কোনও গোধূলি বা শ্রান্ত বর্ষার দিনে। একটা সময় ছিল, মুখ-ই কেবল মনের ভাবের মাধ্যম ছিল। এখন আর তা নেই। আর মন-মুখ যাদের মেলে না তাদের অন্তর কি আর বাহির-ই বা কি? তাদের বহির্মুখী ঝকঝকে মিথ্যার প্রতারণায় কীসের সুখ কীসের তৃপ্তি? তাই মুখের ভাষায় মনের কুয়ো থেকে ভাব তুলে আনতে না পারলেই যে সব শেষ একথা বলা যায় কী করে? মূক মানুষ ক্ষেত্রবিশেষে বাঙ্ময় হয়, নির্জন নিস্তব্ধতা মুখর হয়। আর ভাব না জাগলে ভাষাই বা ফোটে কবে?
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

ডায়াবিটিসে ভুগছেন? সকালের জলখাবারে কী ধরনের খাবার খেতে পারেন? রইল ডক্তারবাবুর জরুরি পরামর্শ

মহাকবি বলেছিলেন, “তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার, নামাতে পারি যদি মনোভার”… ভার নামে কী নামে না তা রহস্য-ই থাকে বুঝি, তবে যারা সাবলীল হয়ে মন ভরাতে পারে না, আড়ষ্ঠতাই যাদের আশ্রয় তাদের জন্য-ও একটা দিন আছে, চারপাশের স্মার্ট এবং আলট্রার অতিকর্মাদের নিত্যদিনের ভিড়ে ভীতুর ডিম, “কী করে বলব” এ কথা সে কথা ভেবে বলতে না পারা মুখচোরা মনচোরাদের-ও একটা দিন আছে, এটাও কম কীসের!!
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content