শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

ঋষি কৌত্স বললেন, হে মহাপারঙ্গম! কলির মনুষ্যের-ই এতো দুর্নাম কেন? অতীত মহামতিগণ কি নিষ্কলুষ তুলসী পাতা ছিলেন?

বৈশম্পায়ন বললেন, এমনটি না বললে কলিস্থগণ এই বিপুল শাস্ত্রের যোগক্ষেম বহন করবেন কী করে? তাঁরা স্বভাবতই মহাত্মা ও পরমপুরুষ। আচার্য যেমন প্রখর ধীমান ছাত্রের সম্মুখে তার প্রশংসা না করে “ততটাও তেমন হয়নি, মনযোগ বাড়াও, আরও ভাল করতে হবে” ইত্যাদি বলে তাকে নিয়ন্ত্রিত রাখেন, এও তেমনটাই।
কৌত্স করজোড়ে বললেন, হে মহাত্মন্, আপনি সর্বদাই কলিস্থগণের প্রশংসায় দশানন, তবুও শাস্ত্রাদিতে কলিকালের অপযশ দেখা যায়। এও সত্য তো বটে। তবে আপনি তত্ত্বজ্ঞ, আপনিই বলুন প্রকৃত গূঢ় বার্তা কি?

বৈশম্পায়ন হেসে বললেন, তোমাদের শাস্ত্রপাঠ ও প্রবচনশ্রবণের অভিজ্ঞতা ও গভীরে অবগাহনের সামর্থ্য এখনও পক্ব হয়নি। তাই বিভ্রান্ত হচ্ছো। শাস্ত্র বলেন, অজ্ঞানের রাজ্য কলিতে সঙ্ঘশক্তি ও ভক্তির জয়জয়কার হবে। সঙ্ঘবল ঐক্য আনে আর ভক্তি বিভক্ত ও দ্রবীভূত করে। সুতরাং কলির জীবগণ একাধারে কঠিন ও তরল। এই হল কলির যথার্থ রূপ।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?

এই বিপরীতগামী বৈচিত্র্য নিয়ে ব্রহ্ম অবাঙ্মনসগোচর থাকেন। কলির জীবগণ তাই যথার্থ সাকার ব্রহ্ম, প্রকৃতঃই তাঁদের লীলা মনবুদ্ধির অগোচর। কাঠিন্য তাঁদের আত্মা, মন ও বুদ্ধির মধ্যে মধ্যে চৈনিক প্রাচীর হয়ে দণ্ডবত্ থাকে। ভক্তিপ্রসূত সিক্ততাই তাঁদের সম্বল। নিন্দাপ্রবণগণ একে কটাক্ষ করে “জল মেশানো” বলেন, তবে পৃথিবীর অধিকাংশই জল। তাই এ তেমন কিছু সমস্যার নয়। আর অগম্যতাই কলিস্থগণের শক্তি, অজ্ঞেয়ত্ব-ই তাঁদের সাধনার ধন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮১: কবির ‘গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ বৈষয়িক-কারণে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছিলেন

এই যেমন মধ্যরাত্রে সরমার আদরের পুত্রকন্যার দল মোড়ে মোড়ে এই সঙ্ঘশক্তির প্রাবল্যের উদ্ঘোষণ করেন। মনুর সন্তানগণ দিবাভাগে সর্বত্র এর অভ্যাস করেন। কী বিচিত্র সেই কথা! নিদাঘতপ্ত কর্ণে তা অমৃতবাণীর তুল্য। চায়ের ঠেক থেকে ট্রেনে, বাসে, কোজি কর্ণারে, বৈঠকী আড্ডায় কিংবা সমিতির বৈঠকে এই বস্তু পুরোদমে চলে। একটি মূল মাথা হুহু রবে তান তোলে, আশেপাশের সকলেই তা ধরে রাখে রাগ-রাগিনীর বিস্তারে, ধ্রুপদী সূক্ষতায়!! এই প্রকল্পে তাঁরা বোধগম্য হওয়ার পরিবর্তে অগম্য, দুর্জ্ঞেয়, অজ্ঞেয় হয়ে ওঠেন। তখন সরমাকুলপ্রদীপগণের মতো তাঁরাও বিপরীতগামী হন। তাঁরা সুধী ভক্ত কিংবা দুর্বার যম হতে পারেন একই অঙ্গে, নানা রূপে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৩: ইন্দিরা দেবী—ঠাকুরবাড়ির আলো!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া

শক্তের ভক্ত আর নরমের যম হয়ে তাঁদের এই সূক্ষ্মাচারের নিদিধ্যাসন করলে লোকশিক্ষা হবে। আজ আমার কিছু আশু কর্ম আছে। মহর্ষি বাজশ্রবার থেকে দানগ্রহণে যেতে হবে। আমার ছত্রটিও মাঝে মাঝে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। যেতে যেতে পূর্বাহ্ন না অতিক্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে উপস্থিতির প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম ব্যাহত হবে! আজ উঠি, সত্রান্তরে বিশদ ব্যাখ্যা করা যাবে। হে মনস্বিন্! কলির অনুধ্যান করো, কলিজ শূন্যগর্ভ পূর্ণ ব্রহ্মাত্মাগণের কথা মনন করে পূর্ণ হও এই আশীঃ জানাই।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content