অলঙ্করণ: লেখক।
মার্চ মাস এমনিতেই স্কুলের থার্ড পিরিয়ডের অঙ্ক ক্লাস কিংবা নিউজ পেপারের পেজ থ্রি-র মতো। জমজমাট। সবে বছর শুরু হয়েছে। কোনও ঝিমুনি কী আড়ষ্টতার প্রশ্ন নেই। তবে রোদ বাড়ছে, গরম বাড়ছে, আর এসব বাড়লে ট্রেনে-বাসে কিংবা পাড়ার মোড়ে মোড়ে উত্তাপ বাড়ে। ঠেলাঠেলি একটু বেশি হয়। কোণে কোণে সিটে বসা নিয়ে গদির লড়াই। যে বসে পড়ল তাকে খুঁচিয়ে সরানোর জন্য অচিরেই নানা কোর কমিটি গড়ে ওঠে। এসব কাজকর্ম দুটি জিনিসের জোরে চলে। একটা হল চা। চা খেতে খেতেই এসব পরিকল্পনা তৈরি হয়ে যায়। যেমন অমুকবাবু রোজ ওই সিটটা দখল করেন যেমন তেমন করে। তমুক বাবু সেটা একটুর জন্য-ই রোজ পারেন না। তিনি আদ্যানাথের মেসো আর কাঠবুড়োর সঙ্গে মতলব আঁটেন, কী করে পরের বার চাকা ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। এই চাকা ঘোরাতে ‘চা’ লাগে, আর চায়ের ব্যাপারে না বললে, বিশুদ্ধ বায়ুতেও কাজ চলে। যাকে ইংরাজিতে ‘গ্যাস’ বলে।
গ্যাসের কাজ হল উত্তপ্ত হয়ে ঊর্ধ্বগামী হওয়া, আর ইচ্ছুক ব্যক্তিকে সঙ্গে নেওয়া। যেমন, তমুকবাবু কাঠবুড়োকে বোঝালেন যে, অমুকবাবুর জায়গাটা আসলে কাঠবুড়োর হকের সিট। তাঁর এই প্রস্তাবকে সমর্থন করলেন আদ্যানাথের মেসো। কাঠবুড়োর বাড়িতে আদ্যানাথ ভাড়া থাকে। তাই হাতে রাখা জরুরি। এভাবে উত্তপ্ত গ্যাসে চড়ে কাঠবুড়ো অমুকবাবুর সঙ্গে ডুয়েলে নামলেন। যখন দেখা গেল, অমুকবাবুকে তুলতে গেলে সিটটাই বুঝি উল্টে যায় আর তার চাপে বুঝি কাঠবুড়োর বাড়িটাই খসে পড়ে আর অমুকবাবু যখন “জানিস্ আমি স্যাণ্ডো করি?” ফের লাফাচ্ছিস অল্রাইট কামেন ফাইট! কামেন ফাইট! “ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি, টেরটা পাবে আজ এখনি !” এইসব বলে মামাকে ডাকাডাকি করছেন, তখন বিপদ বুঝে কাঠবুড়ো পিছন ফিরে তাকায়, তার হিতাকাঙ্ক্ষীর দল তাকে যদি কিছু অতিরিক্ত প্রাণবায়ু দেয়, কিন্তু একী!! পিছনে কেউ নেই, বেবাক ফাঁকা! কেউ কোনওদিন ছিল বলেও মনে হয় না। কাঠবুড়ো বোঝে কি যে প্রাণবায়ু আর গ্যাস এক নয়?
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৪: নারী দিবস ও শিবরাত্রি
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরা সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম
এ সব হয়, কারণ গরম বাড়ছে। আর এসবের জন্যই মার্চ মাসের পনেরো তারিখ আন্তর্জাতিক ঘুম দিবস।
দেবতারা পর্যন্ত একটা বড়ো সময় স্রেফ ঘুমিয়ে কাটান। সৃষ্টিকর্তার মহানিদ্রার শেষেই নাকি জগতের আবির্ভাব। নিন্দুকে বলে, ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, তাই গোলযোগ সইতে পারেন না। কবি বলেছেন, একের পিঠে দুই চৌকি পেতে শুই। ঘুম নিয়ে মানুষ আর মানুষ নয় যারা, তাদের অনেক আশ্চর্য ভাবনা-চিন্তা। সেই নিয়ে গল্প কবিতা উপন্যাস। স্রেফ জীবন দেবতা জাগিয়ে রাখতেন বলেই কবিরা কতো কবিতা আর গান লিখে ফেলেছিলেন। বিনিদ্র সময় যাপনের সেই আকুতি তাঁদের লেখাতেই ধরা আছে। জীবনের তিনভাগের একভাগ ঘুমিয়ে না কাটালে আরও কতো কাজ করে ফেলা যেতো একথা ভেবে যখন একদল অস্থির, অন্যদল তখন “আরেকটু বেশি হলে ক্ষতি কী!”
এই ভেবেই…
দেবতারা পর্যন্ত একটা বড়ো সময় স্রেফ ঘুমিয়ে কাটান। সৃষ্টিকর্তার মহানিদ্রার শেষেই নাকি জগতের আবির্ভাব। নিন্দুকে বলে, ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, তাই গোলযোগ সইতে পারেন না। কবি বলেছেন, একের পিঠে দুই চৌকি পেতে শুই। ঘুম নিয়ে মানুষ আর মানুষ নয় যারা, তাদের অনেক আশ্চর্য ভাবনা-চিন্তা। সেই নিয়ে গল্প কবিতা উপন্যাস। স্রেফ জীবন দেবতা জাগিয়ে রাখতেন বলেই কবিরা কতো কবিতা আর গান লিখে ফেলেছিলেন। বিনিদ্র সময় যাপনের সেই আকুতি তাঁদের লেখাতেই ধরা আছে। জীবনের তিনভাগের একভাগ ঘুমিয়ে না কাটালে আরও কতো কাজ করে ফেলা যেতো একথা ভেবে যখন একদল অস্থির, অন্যদল তখন “আরেকটু বেশি হলে ক্ষতি কী!”
এই ভেবেই…
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪০: স্বভাবে অনন্য সুন্দরবনের বাঘ
বাবা মায়েদের কাছে ঘুমের এক মূল্যায়ন, প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে আরেকরকম। পরীক্ষার্থীর কাছে ঘুমের তাত্পর্য যেরকম, ট্রেন ফেল করা হতভাগ্যের কাছে তা নয়। কারও দুচোখের পাতা জুড়ে নিদ্রার নৃত্যলীলা, কেউ বলেন নিদ্রা মোক্ষের মতোই সাধনার বস্তু, কারও ঘুম উড়ে যায়, তো কেউ দিব্যি পাশের কাঁধে মাথা রেখে অকাতরে নাসাগর্জনে নিজের পরাক্রম প্রদর্শন করেন। কোনও কোনও জাতি ঘুমকাতুরে বলে প্রসিদ্ধ। বিশেষ কিছু খাদ্য উদরে প্রবেশ করলে নিদ্রার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। ধর্মশাস্ত্রকার দিবানিদ্রাকে রীতিমতো খারাপ কাজ বখ ব্যসন বললেও তাতে কিছু আসে যায় না!
ভাতঘুম যেমন সত্য, বিনা নোটিশে নিদ্রাকুল হওয়ার ঐতিহ্য-ও ততোধিক সত্য। কাউকে এড়িয়ে যেতে চান? স্রেফ ঘুমিয়ে পড়ুন। হেড আপিসের বড়বাবু, অনন্তশয়ান বিষ্ণু কিংবা সংস্কৃতের পণ্ডিতের দল, ঘুমের চর্চায় এঁরা সামনের সারিতে। বাকিরাও পিছিয়ে নেই। “তাইতো আমায় জাগিয়ে রাখো” বলে কবির আকুতি আমাদের অস্থির করে, কেউ যদি বলেও যান যা ঘুমাতে দেয় না সেটাই প্রকৃত স্বপ্ন, তাতে কিছু যায় আসে না। ঘুম প্রাণীর জীবনে অপরিহার্য, অবশ্যম্ভাবী, সব থেকে বড় সত্য। এটি নেসেসিটি, বিলাস-ও, মৌলিক কর্তব্য ও চাহিদা তো বটেই, অধিকার-ও। চেয়ার থেকে চৌকি, ফুটপথ থেকে পালঙ্ক, সেমিনার হল কিংবা গানের আসর, ঘুম সর্বত্র অবাধ। কোলে, অন্যের ঘাড়ে, দাঁড়িয়ে, বসে, চোখ বুজে বা খুলে সবরকম ভাবেই ঘুমানো যেতে পারে। সারমেয় কিংবা মার্জারকুলের নিদ্রাবিলাস যেমনটা অনুপ্রেরণার, ততোধিক প্রাণিত করে দূরগামী ব্যথার মাঝে এই ঘুমিয়ে পড়া….
“কাল থেকে ঠিক পালটে যাব
দেখে রাখিস তোরা, ”বলতে-বলতে ঘুমিয়ে পড়ল অশ্বমেধের ঘোড়া
পথের মধ্যিখানে।”
ভাতঘুম যেমন সত্য, বিনা নোটিশে নিদ্রাকুল হওয়ার ঐতিহ্য-ও ততোধিক সত্য। কাউকে এড়িয়ে যেতে চান? স্রেফ ঘুমিয়ে পড়ুন। হেড আপিসের বড়বাবু, অনন্তশয়ান বিষ্ণু কিংবা সংস্কৃতের পণ্ডিতের দল, ঘুমের চর্চায় এঁরা সামনের সারিতে। বাকিরাও পিছিয়ে নেই। “তাইতো আমায় জাগিয়ে রাখো” বলে কবির আকুতি আমাদের অস্থির করে, কেউ যদি বলেও যান যা ঘুমাতে দেয় না সেটাই প্রকৃত স্বপ্ন, তাতে কিছু যায় আসে না। ঘুম প্রাণীর জীবনে অপরিহার্য, অবশ্যম্ভাবী, সব থেকে বড় সত্য। এটি নেসেসিটি, বিলাস-ও, মৌলিক কর্তব্য ও চাহিদা তো বটেই, অধিকার-ও। চেয়ার থেকে চৌকি, ফুটপথ থেকে পালঙ্ক, সেমিনার হল কিংবা গানের আসর, ঘুম সর্বত্র অবাধ। কোলে, অন্যের ঘাড়ে, দাঁড়িয়ে, বসে, চোখ বুজে বা খুলে সবরকম ভাবেই ঘুমানো যেতে পারে। সারমেয় কিংবা মার্জারকুলের নিদ্রাবিলাস যেমনটা অনুপ্রেরণার, ততোধিক প্রাণিত করে দূরগামী ব্যথার মাঝে এই ঘুমিয়ে পড়া….
“কাল থেকে ঠিক পালটে যাব
দেখে রাখিস তোরা, ”বলতে-বলতে ঘুমিয়ে পড়ল অশ্বমেধের ঘোড়া
পথের মধ্যিখানে।”
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৭: শ্যামাসুন্দরী দেবীর লোকান্তর গমন
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৪: রাজনীতিতে, যুগান্তরেও স্বার্থচিন্তার আবহমান প্রভাব
নিদ্রার নানা স্তর আছে। দর্শন সুষুপ্তির কথা বলেন। অন্তর থেকে জেগে উঠে বরণীয় যা কিছু পেয়ে ধন্য হওয়ার কথা বলা হয় বটে, তবে ঘুমের ওপরে কিছুই নয়। তাই “ঘুম”ই উচ্চতম স্টেশন। ঘুম একটা রাজ্যের নাম। ঘুম একটা বিস্ময়। ঘুম বাড়ির কাছে আরশিনগর। যেভাবে গরম বাড়ছে উষ্ণায়নের যুগে, অমুকবাবু অমুকবাবু সকলেরই একটু সত্যিকারের ঘুম দরকার, মিথ্যেকারের নির্জীব অনন্তনিদ্রা কাটাতেই। নিজের এবং জাতির স্বার্থেই। আন্তর্জাতিক ঘুম দিবসে “অঘোরের ঘুমের বাজনা” বেজে উঠুক সকলের পাতালঘরে, দিনের শেষে ঘুমের দেশে তলিয়ে যান, শুধু নামতে গিয়ে “স্লিপ” খাবেন না যেন!
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।