অলঙ্করণ: লেখক।
এই গত বছর আমরা যখন চিড়িয়াখানা গিয়েছিলাম… গতকাল যখন সে তাকে ওই কথা বলল… গত মাসে… গত সপ্তাহে… এই তো একটু আগেই…
কিন্তু মুশকিল হল, এসব কতটা ঠিক সে নিয়ে সংশয় হতেই পারে। আমি ভাবছি, ঘণ্টাখানেক কাটল, ঘড়ি দেখেই ভাবলাম। সে বলল, কই? মোটে তো পঁয়তাল্লিশ মিনিট হল, সেও ঘড়ি দেখেই বলছে, তবে তার ঘড়ি একটু পিছিয়ে…
কিন্তু মুশকিল হল, এসব কতটা ঠিক সে নিয়ে সংশয় হতেই পারে। আমি ভাবছি, ঘণ্টাখানেক কাটল, ঘড়ি দেখেই ভাবলাম। সে বলল, কই? মোটে তো পঁয়তাল্লিশ মিনিট হল, সেও ঘড়ি দেখেই বলছে, তবে তার ঘড়ি একটু পিছিয়ে…
সূর্য সর্বত্র একভাবে নেই, কোথাও বছর তিনশো পঁয়ষট্টি দিনে, কোথাও বা তিরিশ দিন না হতেই বছর হয়ে যায়। কেউ সারা বছরের কাজ দু’মাসেই করে ফেলে, কারও বছর বারো মাসে তো, কারও আবার আঠারো মাসে। পৃথিবীর এক বছর নাকি দেবতাদের একদিন। কোথাও দিন ফুরোয় না, কোথাও রাত কাটতে চায় না। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি নানা কলাকৌশল আর হিসেব দিয়ে চারপাশের বয়ে যাওয়া সময়কে ভেঙে ভেঙে দেখায়, যেমন করে একটা শরীর কেটে কেটে তার অন্দরের পথ-ঘাট চিনতে হয় তেমনটাই আর কী!
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৫: সে ব্যাটা চড়ছে তেরো সেমি, তো পড়ছে চোদ্দো কিমি, ভাঙবে ঠ্যাং কি?
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’
আসলে, কাল অখণ্ড। যা-ই কাল ছিল, তা-ই আজ। আজকের বর্তমান আগামীর ভবিষ্যতে প্রবেশ করবে। দর্শন এ নিয়ে বহু ভাবনার বিস্তার ঘটায়। বিজ্ঞান নানা গাণিতিক হিসেবে তাকেই মাপে। তাই, যাকে অতীত ভাবি, তাকেই অনায়াসে বর্তমান কী ভবিষ্যৎ ভাবতে পারা যায়। অনেকদিন আগের কথা এই তো সেদিনের বলেই মনে হয়। যা পঞ্চাশ বছর আগে ঘটেছিল তা আবার সত্তর বছর পরে ঘটতেই পারে। যা অতীত তা গত নয়। যা অনাগত, তা কোনওভাবে বর্তমানেই আছে হয়ত বা, যা আগে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, তা ঘণ্টা-মিনিট-সেকেণ্ড কিংবা মাস, দিন, বছরের হিসেবে আগে ঘটেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু, যেখানে ওই মাপকাঠিগুলোই আপেক্ষিক, অর্থাৎ ধ্রুব নয়, সেখানে ওই আগে আগে কিংবা পরে পরে ঘটা ঘটনাগুলো কি সত্যিই অতোটা আগে কিংবা পরে ঘটেছে, নাকি ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে কেবল? মনে হয়, সাগরের বুকে বিচ্ছিন্নভাবে ভাসমান নৌকার মতোই কালসমুদ্রে ছোট বড় দ্বীপ, চড়া বা ভূখণ্ডের মতোই আলোর যাত্রী তারা।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?
খ্রিস্টাব্দের বিচারে যিশুর জন্ম বঙ্গাব্দ বা শকাব্দের হিসেবে ভিন্নতর হবে, এতো বলাই বাহুল্য। তবেই তো বছর-যুগে মাপা সময়ের মাপ ভিন্ন ভিন্ন, কালের বিচারে এসব ঘটনা অখণ্ডের মধ্যে খণ্ডিত সত্তায় ভিন্ন হয়েও অভিন্ন, এক হয়েও স্বতন্ত্র, মণিমালার রত্নগুলির মতোই সামগ্রিকতায় পূর্ণ ও অনন্ত, আবার নিজের ঔজ্জ্বল্যেও ভাস্বর।
তবে নতুন বছরের কি আলাদা করে কোনও তাত্পর্য নেই? শিব্রাম এমন ভাবতেন নাকি যে বিপুল নাচানাচি করেও কোনও নতুন বছরকে এক বছরের বেশি ধরে রাখা যায় না। তা পুরনো হয়ে বিগত হবেই। নূতন দেখা দেবে, বহু বাসনায় প্রাণপণে চেয়েও তার পুরাতন হওয়া ঠেকাবে কার সাধ্য?
তবে নতুন বছরের কি আলাদা করে কোনও তাত্পর্য নেই? শিব্রাম এমন ভাবতেন নাকি যে বিপুল নাচানাচি করেও কোনও নতুন বছরকে এক বছরের বেশি ধরে রাখা যায় না। তা পুরনো হয়ে বিগত হবেই। নূতন দেখা দেবে, বহু বাসনায় প্রাণপণে চেয়েও তার পুরাতন হওয়া ঠেকাবে কার সাধ্য?
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩২: যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের জীবন একটি কুকুরের থেকেও কঠিন
তবুও, পুরনো বছর চলে যাবে, যেমন দু’ হাজার তেইশ চলে গেল। রাত এগারোটা ঊনষাটেও যা সত্য, বারোটা বাজতেই তা বিগত। এ ভাবেই পুরাতনের বারোটা বাজিয়ে নতুনের আগমনের ঘণ্টা বাজে। তবে ছাত্রজীবন কিংবা শৈশব অথবা সাইকেল, সাঁতার বা স্মৃতি যেমন পুরাতন হয় না, তেমনই এক মিনিটের ব্যবধানে যা থাকে না অথবা যা এসেছে বলেই মনে হচ্ছে তার অস্তিত্ব সংখ্যাতাত্ত্বিক, মানসিক ও নানাভাবে গাণিতিকভাবে সত্য, তা সত্য-ও বটে; আবার তা-ই সব নয়। আজ নতুন বছরের আগমন একটি গাণিতিক হিসাবের এগিয়ে চলা, তাকে উপলক্ষ্য করেই যাবতীয় উন্মাদনা, হাসি-ঠাট্টা-তামাশা, নাচ-গান, বাজি-পটকা, আমোদ-উল্লাস, স্বপ্ন-ভাবনা, আনন্দ আর উদযাপন।
আসলে সেটা তেইশের বা পঁচিশের মতোই উনিশ-কুড়ির ব্যবধানে দাঁড়িয়ে। বলা ভালো, তার সকল সম্ভাবনা, সত্য ও সাফল্য অথবা ব্যর্থতা অখণ্ড কালস্রোতে এক একটি ঢেউ ছাড়া আর কীই বা? তা সাময়িক হয়েও সার্বিক। তিনশো পঁয়ষট্টি দিন পরেই আরেকটা বারোটার ঘণ্টা পড়বে একইভাবেই। যে কোনও নতুনেই কিছু সমস্যা থাকে, নতুন জুতোয় ফোস্কা, নতুন কাজে অনভিজ্ঞতা, নতুন বছরে ভুল করেই তেইশ লিখে ফেলা। তবে কি “আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি।”
একটুকু রইলেম চুপ করে; তারপর বললেম, “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।”
আসলে সেটা তেইশের বা পঁচিশের মতোই উনিশ-কুড়ির ব্যবধানে দাঁড়িয়ে। বলা ভালো, তার সকল সম্ভাবনা, সত্য ও সাফল্য অথবা ব্যর্থতা অখণ্ড কালস্রোতে এক একটি ঢেউ ছাড়া আর কীই বা? তা সাময়িক হয়েও সার্বিক। তিনশো পঁয়ষট্টি দিন পরেই আরেকটা বারোটার ঘণ্টা পড়বে একইভাবেই। যে কোনও নতুনেই কিছু সমস্যা থাকে, নতুন জুতোয় ফোস্কা, নতুন কাজে অনভিজ্ঞতা, নতুন বছরে ভুল করেই তেইশ লিখে ফেলা। তবে কি “আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি।”
একটুকু রইলেম চুপ করে; তারপর বললেম, “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।”
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।