অলঙ্করণ: লেখক।
জানুয়ারি মাসের উনত্রিশ তারিখ আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র দিবস। ইন্টারন্যাশনাল নিউজপেপার ডে। সে এক দিন ছিল, যখন ‘খবরের কাগজ’ একটা সিম্বল ছিল। চায়ের আড্ডা থেকে ট্রেনে বাসে অপরিহার্য ছিল। আজও অনেকের কাছেই সেরকমটাই থেকে গিয়েছে। ছোট, বড়, মাঝারি, অণু কিংবা হলুদ, আশমানী অথবা রামধনু খবরের কথা শোনা যায়।
এমন দিন ছিল, যখন খবরের কাগজ পরের দিন বা পরের সপ্তাহেও পৌঁছতো কোথাও কোথাও। তবু, খবরের গুরুত্ব কমতো না একবিন্দু। যুদ্ধ, বাজারদর কিংবা রাজনীতি, নাটক কিংবা খেলা, টাকা কিংবা ডলার, সিনেমা কিংবা উত্সব, ময়দান থেকে ময়দানব, ফিল্মস্টার অথবা ধন্ধুমার… সব খবরের আওতায়। হিরো বাজার করেন কিনা, নেতা সিনেমায় নামবেন কি, যুদ্ধ লাগবে কী লাগবে না, সাগরের জল কতটা কমল, বৃষ্টির দিনে কি রঙের ছাতা নেবেন, পুকুরচুরি হলে কী কী সাবধানতা নিতে হয়, কী কী খাওয়ার সময় কী কী খেতে নেই, আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করলে কোন গান গাইতে হয় ইত্যাদি মনোহর খবর খবরের কাগজে থাকে।
এমন দিন ছিল, যখন খবরের কাগজ পরের দিন বা পরের সপ্তাহেও পৌঁছতো কোথাও কোথাও। তবু, খবরের গুরুত্ব কমতো না একবিন্দু। যুদ্ধ, বাজারদর কিংবা রাজনীতি, নাটক কিংবা খেলা, টাকা কিংবা ডলার, সিনেমা কিংবা উত্সব, ময়দান থেকে ময়দানব, ফিল্মস্টার অথবা ধন্ধুমার… সব খবরের আওতায়। হিরো বাজার করেন কিনা, নেতা সিনেমায় নামবেন কি, যুদ্ধ লাগবে কী লাগবে না, সাগরের জল কতটা কমল, বৃষ্টির দিনে কি রঙের ছাতা নেবেন, পুকুরচুরি হলে কী কী সাবধানতা নিতে হয়, কী কী খাওয়ার সময় কী কী খেতে নেই, আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করলে কোন গান গাইতে হয় ইত্যাদি মনোহর খবর খবরের কাগজে থাকে।
তবে খবরের কাগজে ‘কাগজ’ ব্যাপারটাও বেশ আকর্ষণীয়। বিশেষ বিশেষ দিনে অনেক কাগজ নিয়ে নানা কিসিমের ‘পাতা’ নিয়ে হাজির হয় কাগজের দল। রাত পোহালে তার আর দাম থাকে না, নিশি ফুরালে কেহ চায় না তখন। একমাত্র বাতিকগ্রস্ত পড়ুয়া, সিধুজ্যাঠার মতো সংগ্রাহক, অনুসন্ধিত্সু গবেষক আর অতলচারী ঐতিহাসিকের কাছে তার দাম অমূল্য হয়ে ওঠে। আর্কাইভ কিংবা লাইব্রেরির তাকে তখন তারা মণিমুক্তো ছড়ায়। গান্ধীজির গান থেকে দেড়শো বছর আগের লোডশেডিং, তিরিশ বছর আগের ঝড়ের খবর, আশি বছর আগে কেমন গরম পড়েছিল, স্বাধীনতার পরে বারোয়ারী পুজোয় কোন গান বাজতো কিংবা তেজপাতার বাজার কোন সালে বেশ তেজী হয়েছিল এসব ছাড়া সেখান থেকে আর কিছু মিলবে না।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৮: দুরন্ত ঘূর্ণি
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৪: সুন্দরবনের মৃত ও মৃতপ্রায় নদী
শোনা যায়, যেদিন খবরের কাগজ বিক্রি হতো না তেমন, সেদিন শহরের কোনও এক সিনেমা হলের শোয়ের দর্শকরা বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি যাই হোক একটা কিছু কাগজ নিয়ে হলে ঢুকতো। বাসি কাগজ বিক্রি হতো হু হু করে। তারা খবরের কাগজ পেতে সিটে বসতো, কারণ, সিট ছারপোকার। শেষে কাগজ-ওয়ালাও সরিয়ে রাখা শেষ কাগজ নিয়ে হলে ঢুকে পড়ত। তার নাম শিব্রাম চকরবরতি বা শিবরাম চক্রবর্তী এইরকম একটা কিছু। সে যাই হোক না কেন, ট্রেনে কোনও কেতাদুরস্ত বাবুকে ইংরেজি পেপার পড়তে দেখে উল্টো দিকে বসে থাকা কারও একটা খুব ইচ্ছে জাগল। সেও একটা ইংলিশ পেপার কিনে ভালো করে পড়তে লাগল… সব খবর আগাপাশতলা। কেবল সোজা করে ধরলে খবরগুলো সোজাসুজি জানার সম্ভাবনা বাড়ত খানিক। তবে উল্টো করে ধরায় সব সে বুঝেছিল উল্টো। ‘আগে’ বললে ‘পরে’ বোঝার দল তো ছোট নয় মোটেই।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান
ব্যাকরণে বলে, কর্তার অভীষ্টতম হল কর্ম। তো সকাল হলেই খবরপিপাসু কর্তার দল তাদের ঈপ্সিততম বস্তু সংবাদপত্র নিয়ে বসে পড়েন ট্রেনে বাসে, কিংবা বিছানায় বা বারান্দার রোদে। কিন্তু রাত পোহালেই, সাধারণ খবরের কাগজের দল অধিকরণে পৌঁছে যায়।
অধিকরণ হল আশ্রয়। সংবাদপত্র তখন ঠোঙা হয়ে মুড়ির, বসার আসন হয়ে দুষ্টু কাকের ঠেকে বটতলায়, চিড়িয়াখানা কিংবা ময়দানের বিপত্তারণ। সারি সারি কালো অক্ষরের মা সরস্বতীর উপর তখন ভর করে নগরবাসী আট থেকে আশি।
অধিকরণ হল আশ্রয়। সংবাদপত্র তখন ঠোঙা হয়ে মুড়ির, বসার আসন হয়ে দুষ্টু কাকের ঠেকে বটতলায়, চিড়িয়াখানা কিংবা ময়দানের বিপত্তারণ। সারি সারি কালো অক্ষরের মা সরস্বতীর উপর তখন ভর করে নগরবাসী আট থেকে আশি।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৮: ষাট-বাষট্টি, বড়োজোর সত্তর বছর বাঁচবেন রবীন্দ্রনাথ, বলেছিল এক গণৎকার
তেলের দাম কমবে কিনা তখন বেগুনির তেলে চুপচুপে, কিংবা, বিধ্বংসী আগুনের খবরের ওপর বসেই ওপাড়ার দীনবন্ধু অথবা কচি মেসো কিংবা মন্দোদরীর সেজো খুড়িমা এক গ্লাস জল চোঁ চোঁ করে শেষ করলেন এইমাত্র। অথবা, কুখ্যাত দস্যু রঘু ডাকাত দিল্লি মেলে মুখের সামনে একটা খবরের কাগজ মেলে বসে আছে। খানিক তফাতে আরেকজন তাকে ওই কাগজের আড়াল থেকেই নজরে রাখছে। তিনি জগদ্বিখ্যাত ডিটেকটিভ জ্যাঠাবাবু। আর অলিম্পিকে মেডালের খবর-ওয়ালা ঠোঙা থেকে কিং সাইজের গোল গোল বেকারি-বিস্কুট কামড়ে অর্ধেক করে টেনিদা তখন বলে চলেছে, “সেবার বোল্টকে ক্লিন বোল্ড করে দিয়েছিলাম। টাঙ্গানিকা অলিম্পিকে দুশো মিটার রান। সকলেই জানে বোল্ট জিতবে। রানের আগের দিন রাতে খুব কাঁচুমাচু মুখ করে সে আমার ঘরে উপস্থিত। আর তারপরেই তো ম্যাজিক। সেবার ভারতের জন্য একান্নটা সোনার পদক এই আমি একাই, টেনিরাম শর্মা এনেছিলাম!!’
ক্যাবলা অবাক হয়ে বলেছিল ‘তুমি আবার অলিম্পিকে নামলে কবে?’
হাবলা বলল ‘সব গুল, ইয়ে, মানে, গোলাপ ফুল।
টেনিদা বলল, ‘চারাপোনার দল, তোদের খবরের কাগজে এইসব খবর পাবি নাকি?”
ক্যাবলা অবাক হয়ে বলেছিল ‘তুমি আবার অলিম্পিকে নামলে কবে?’
হাবলা বলল ‘সব গুল, ইয়ে, মানে, গোলাপ ফুল।
টেনিদা বলল, ‘চারাপোনার দল, তোদের খবরের কাগজে এইসব খবর পাবি নাকি?”
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।