শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫


অলঙ্করণ: লেখক।

ঋষি ধৌম্য শ্মশ্রূসঞ্চালন করে নিতান্তই কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন, “মহাত্মন্! কলিযুগে প্রাণীগণের সৃষ্টি কীভাবে হবে? তারা কেউ যোনিজ, কেউ অণ্ডজ, কেউ বা তদ্ভিন্ন… কলির জীব যেরূপ বিচিত্র ও অদ্ভুতকর্মা, বোধ হয় তাঁরা স্বয়ম্ভূ হবেন!

বৈশম্পায়ন বললেন, আপনি যথার্থ বলেছেন। অণ্ডজগণ দ্বিজ বলেই কথিত। আর অণ্ডজীবী মানবগণ বিশ্বরূপ। কলির জীব অদ্ভুতকর্মা, তাঁরা স্বয়ম্ভূ একথাও সত্য, কিন্তু প্রাণীদেহ ধারণ করায় তাঁরা ব্রহ্মতুল্য নতুবা দেবতুল্য হয়েও শরীরী, এ দুঃখদায়ক হলেও সত্য। কলির জীব বস্তুত-ই যে কীদৃশ তা নিয়ে আমি বহু বলেছি, তবুও তাঁদের স্বরূপপ্রকাশের শক্তি অনন্ত তপস্যার সাধ্য। এঁরা পুরাকালের তুল্য যোনিজ-ই হবেন, কিন্তু চরিত্রে স্বয়ম্ভূ। কলিকালে এঁদের-ই ভুঁইফোড় বলা হবে। কিন্তু এ বললেও যথেষ্ট হল না। প্রকৃত সত্য হল যে, কলির জীব মাতৃগর্ভে কালহরণ করে আত্মপ্রকাশ করবেন বটে, কিন্তু এঁরা চরিত্র-বৈশিষ্ট্যে অণ্ডজ। এঁদের কর্মে অকর্মে অণ্ডের বিপুল মহিমা সদা ভাস্বর হয়ে থাকবে। অক্টোবর মাসে দ্বিতীয় সপ্তাহে তাই বিশ্বব্যাপী অণ্ডদিবসের উদযাপন কলিতে প্রসিদ্ধ হবে।
কলির মানবগণ ডিমের মাহাত্ম্যে অভিভূত হবেন। কেউ বলবেন, আগামীতে মুরগি হওয়ার চেয়ে আজকের ডিম অধিক প্রীতিদায়ক। কেউ বলবেন, রাষ্ট্রের কল্যাণে তিনি ডিম্বপ্রসবেও সক্ষম। কেউ বা বলবেন, অতীতের কর্ম বর্তমানের ডিম্বে, যার মধ্যে ভবিষ্যৎ সুপ্ত আছে। পৃথিবীর গোপনতম বস্তুটি নাকি একটি অখণ্ড ডিম, মনীষীগণ একথা বলবেন। তবে স্বর্ণডিম্বপ্রসবকারী হংস লোভবশত নিধন করতে নেই, এই শিক্ষায় কলিজীবীগণ নিরাসক্ত। স্বর্ণডিম্ব নয়, কুক্কুটাণ্ডেই তাঁদের পরিতৃপ্তি।

শোনা যায়, পরভৃত বায়সের নীড়ে অণ্ডপ্রসব করেই দীর্ঘকাল বংশবিস্তার করে আসছে। কলির জীবগণ কুক্কুটাণ্ডে আসক্ত হলেও অন্যান্য পক্ষী ও প্রাণিবিশেষের অণ্ডের প্রতিও লোলুপ হবেন। অণ্ডে এঁদের এতোই আগ্রহ যে, আপন বাসস্থলকে তাঁরা ব্রহ্মাণ্ড ও আদিত্যদেবকে মার্তণ্ড বলে জানবেন। অণ্ড এঁদের ভাষায় ‘আণ্ডা’ হবে। বোধ করি, সর্বজীবকে নিয়ন্ত্রণে, অর্থাৎ ‘আন্ডারে’ রাখার মনোবাসনাতেই কলির মহাপুরুষগণ অণ্ডাসক্ত হবেন। কিন্তু কার্যকালে প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে এঁরা লিঙ্গনির্বিশেষে অশ্বডিম্ব প্রসব করবেন। কলির প্রিয় খাদ্য কচুপোড়া অশ্বডিম্বের সহযোগেই আস্বাদনীয় হবে। শুধু খাদ্য নয়, ঘোড়ার ডিম-পাড়া এঁদের প্রিয় কর্ম বলেই গণ্য হবে। কলির প্রত্যেক জীব পণ্ডিত। প্রত্যেকেই অদ্ভুতকর্মা। প্রত্যেকেই ব্রহ্মতুল্য অবাঙ্মনসগোচর। প্রত্যেকেই সাংখ্যবর্ণিত পুরুষতুল্য অবিচল, অকর্মা অর্থাত্ ঘোড়ার ডিমের উত্পাদনকুশল।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৭: অ্যাঁ, বলো কী নন্দলাল…!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫০: স্বপ্নের ‘যাত্রা হলো শুরু’

এঁরা গ্রীষ্মে অতিশয় গরমে কাহিল হয়ে অশ্বডিম্ব প্রসব করে সেই ডিম্বে তাপদানকর্মে নিরত থাকেন। বর্ষাতেও প্রবল বর্ষণের আতিশয্যে তাদৃশ কর্ম করেই কালহরণ করেন। শীতে শৈত্যবশত, বসন্তে বাসন্তিক উত্ফুল্লতার আতিশয্যবশত তাঁরা এই কর্মেই নিরত থাকেন। এই কারণে কলির ঋতুবৈচিত্র্য হ্রাস পেয়ে জীবগণের কর্ম অনায়াসসাধ্য করার প্রচেষ্টা করা হবে, কিন্তু জীবগণ কলিকালের কেবল দুইটি ঋতু, গ্রীষ্ম ও বর্ষায়, তাপে ও বর্ষণে সেই অভিন্ন কর্মেই রত থাকবেন। কলিকালে মনুষ্য-ব্যতিরিক্ত মত্স্য ও সরীসৃপগণ-ও ডিম্বপ্রসব করবেন, তবে তাঁদের ডিম্ব নিয়ে মনুষ্যকুল আকুল নয়। তাঁরা শৈশব থেকেই ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর নানাবিধ অণ্ডের তাৎপর্য জেনে জ্ঞানী হবেন, কখনও বা, তাঁরাও স্বয়ং অণ্ডজ একথা পিতৃমাতৃগণের দ্বারা পরিজ্ঞাত হবেন। উত্তরকালে নিজেদের মহান স্বরূপ পরিজ্ঞাত হয়ে কুক্কুটাণ্ড ও হংসের ডিম্বে আসক্ত হবেন, কিন্তু স্বীয় চাতুর্যে অপরের মুণ্ডপাত করে তাকে ‘মুরগী’ করতেও ছাড়বেন না। তবে কেবল খাদ্য নয়, রূপচর্চায় ডিম্ব প্রসিদ্ধ হবে। এমনকী হোলিকোত্সবে অতর্কিতে পচা ডিম নিক্ষেপ করে কলির মহাত্মাগণ উত্ফুল্ল হবেন।”
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৯: আহা, মরি—কেটেলবেরি

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১৩: সাগর দীঘির ধারে হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দির ও মধুপুর ধাম

ঋষি জহ্নু বললেন,” কিন্তু হে মহাত্মন্, কলিকালে অণ্ড কি ভক্ষ্য না অভক্ষ্য? আমরা তো ডিম্ব বলতে প্রজাবিদ্রোহকে বুঝি। অণ্ডের প্রতি কলিজীবীগণের এমন দ্বিচারিতা কেন? অণ্ডের স্বাদ-ই বাদ কীদৃশ?”

বৈশম্পায়ন হেসে বললেন,” বত্স! কলিকালের সন্ধ্যায় যদিও বা অণ্ডভক্ষণে মানবগণের দ্বিধা থাকবে, তবুও অণ্ডে নিরাসক্ত জীব দুর্লভ। এটি সর্বগুণাধার বলেই কথিত হবে। তবে প্রাথমিক ব্রীড়া দূর করে কলিজীবীগণ যখন অণ্ডজীবী হবেন, তখন তাঁদের প্রাতরাশ থেকে নৈশভোজন সর্বত্র তার অধিষ্ঠান হবে। এমনকী, ক্রীড়াঙ্গন থেকে আরোগ্যালয়, স্পোর্টস থেকে ব্লাড ডোনেশন, সর্বত্রই সিদ্ধাণ্ডের রমরমা। এই সর্বত্রগামী অণ্ড-ই ডিম্ব। তবে তা
রাজনীতিশাস্ত্রের বিষয় নয়। আহার্যবস্তু। অণ্ড থেকে প্রাণের সূচনা। তবে কলিজীবীগণের কাছে অণ্ডের আদর খাদ্যগুণে। পুরাকালে একেই বুঝি দেবগণ অমৃত বলেছিলেন। অণ্ড পুষ্ট করে, পরিপূর্ণ করে। অণ্ড শুভ নয়, এই ভেবে কেউ কেউ তা প্রত্যাখ্যান করবেন সত্য, তবে তাতে অণ্ডের মূল্য কিছু কমতে পারে, তার অধিক কিছু নয়। জীবের বহিরিন্দ্রিয়ের আবরণে যেমন অন্তরিন্দ্রিয় মন আবৃত, তেমনই সিদ্ধাণ্ডের মূল পীতগোলকটি শ্বেত আবরণে আবৃত থাকে। মন যেমন দুর্জ্ঞেয়, তাই রহস্যময় ও আকর্ষক, তেমনই এই পীতবস্তু সর্বাধার, অণ্ডজীবীগণের মূল আকর্ষণ হবে এটিই। শ্বেতাংশটি নিয়ে অনেকেই বিশেষ ভাবিত হবেন না। অনেকেই শ্বেতাংশটি অগ্রে গলাধঃকরণ করে সন্তর্পণে গৃহকোণ আশ্রয় করে পীতগোলকের নির্ভয় সদ্ব্যবহার করবেন। যদি পার্শ্ববর্তী জনগণ ঐ দ্রব্যটি যাচ্ঞা করেন, এই অমূলক ভয়েই তাঁরা এটি করবেন। এতে কলিযুগে অণ্ডের কী বিপুল মহিমা তা উপলব্ধ হয়। অণ্ড এমনই একটি পদার্থ, যা বহুরূপে সম্মুখে উপস্থিত হলেও, তার মূল রসগ্রহণে তত্ত্ববিদগণ কখনও বিফল হবেন না। ওই অধিবৃত্তাকার দ্রব্যের একদল একনিষ্ঠ উপাসক কলিতে প্রসিদ্ধ হবেন। তাঁদের ‘এগেটেরিয়ান’ বলা হবে।
আরও পড়ুন:

শ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১০: রেমন্ড কোপা এক কিংবদন্তি ফুটবল বাদশা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

অণ্ডের স্বাদ মন্দ নয়। তবে ঘোরকলিতে কুক্কুটাণ্ড ঘুঘুর ডিমের তুল্য আনুবীক্ষণিক ও সূক্ষ্ম হয়ে উঠবে। কখনও কখনও তাকে নকুলদানা বলেও ভ্রম হতে পারে। “ফেলো কড়ি মাখো তেল” সূত্রানুসারে অর্থের সঙ্গে সমানুপাতিক হয়ে এই কুক্কুটাণ্ডের আকার বৃদ্ধি পাবে। কুক্কুটগণ এবিষয়ে অবগত থাকবেন কি না নিশ্চিতরূপে বলা যায় না, তবে কলিজীবীগণ অণ্ডের ক্রমবর্ধমান মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে এই ব্যবস্থা করবেন। তবে সার্বিক সূক্ষ্মতা মানবজীবনের কাম্য। বৌদ্ধিক, দার্শনিক সূক্ষ্মতার পাশাপাশি তার দৈনন্দিন জীবনের আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম হবে। তার প্রতিবেশ-ও ন্যূন হয়ে আসবে। তবে অণ্ড যদি তাদৃশ হয় তবে তা মানুষের উন্নতিকল্পেই হবে, এই আমার নির্ণয়। হে ধীমানগণ, অণ্ড ভক্ষণ অতি সুখকর এই তত্ত্ব জ্ঞাত হয়ে আপনারা প্রীত ও নিশ্চিন্ত হন।
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content