সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

ভৃগু, অঙ্গিরা, পুলহ, জৈমিনি, জহ্নু প্রমুখ ঋষিগণ ঘন ঘন শ্মশ্রূসঞ্চালন করে জিজ্ঞাসু নেত্রে প্রশ্ন করলেন, “কলিকালে বিচক্ষণতা কি? জগতে সর্বাপেক্ষা বিচক্ষণ কে, যদি সম্যক ব্যাখ্যা করেন আমাদের কুতূহল চরিতার্থ হয়।”

বৈশম্পায়ন স্মিত হেসে বললেন, “হে ভুয়োদর্শী মুনিসকল! কলিকালে জগতে মনুষ্য-ই একমাত্র বিচক্ষণ। তাঁরা কর্মে-অকর্মে-অপকর্মেও বিচক্ষণ পদক্ষেপ থেকে বিচ্যুত হন না। তাঁদের যুক্তিসিদ্ধ কর্ম ও অকর্মগুলিই এর জাজ্বল্যমান উদাহরণ।”

ভৃগু সবিস্ময়ে বললেন, “কলিস্থ জীবগণ দেবপ্রতিম বলেই জানি। পুরাকালে দেবগণ বহু মহাকর্ম সম্পাদন করেছিলেন বলেই শোনা যায়। কলিবাসী জীবশ্রেষ্ঠগণের মধ্যেও যাঁরা উৎকৃষ্ট, তাঁরা স্বয়ং ব্রহ্ম হবেন এমন কথাও বিদিত, তবে তাঁদের কর্ম কীদৃশ হবে তা আমাদের অজ্ঞাত, আপনি আমাদের মার্গ প্রদর্শন করুন।”
বৈশম্পায়ন বললেন, “মানুষ কীদৃশ বিচক্ষণ তার পরিচয় তাঁদের অপ্রতিহত মতিতেই। কলির সেই তাঁরা প্রকৃতিতে অকারণে চঞ্চল, অস্থির হবেন। এই চাঞ্চল্য ও নব নব উন্মাদনাকে যুগপত পুষ্ট ও সংহত করার জন্য তাঁরা নানা দিবস ঘোষণা করবেন। যেমন বৃক্ষদিবসে বৃক্ষরোপণ করবেন, নির্দিষ্ট কালে ক্ষৌরকর্ম করবেন, পরীক্ষার পূর্বদিনে অধ্যয়ন করবেন, অরন্ধনে বায়ু ভক্ষণ করবেন। অতিরিক্ত ভোজনের পরে অম্লশূলের নিরাময়ে যেমন বটিকা প্রদান করা হয় তেমনই কলিকালে ভাদ্রমাসে ইংরাজি মতে সেপ্টেম্বরের অষ্টাদশ ও একবিংশতিতম দিবসে তাঁরা যথাক্রমে “বিশ্ব বাম্বু দিবস” ও “আন্তর্জাতিক শান্তিদিবস” পালনে ব্রতী হবেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৪: মুহূর্ত মিলায়ে যায় তবু ইচ্ছা করে, আপন স্বাক্ষর রবে যুগে যুগান্তরে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

এই যৌথযাপন অতি তাৎপর্যপূর্ণ। আঠারো সংখ্যার মাহাত্ম্য স্মরণ করে এবং কুরুক্ষেত্রপর্বের দিবস-সংখ্যা গণনা দেখুন, সেই মহাযুদ্ধে স্ববংশীয় একে অপরকে বংশপ্রদান করে প্রাতঃস্মরণীয় হয়েছিলেন। কলিযুগ বস্তুত বংশবদগণের মহাপীঠ। বংশের কৌলিন্যরক্ষাই কলির ধর্ম। বংশপ্রদানেই কলির সিদ্ধি। কলিকালে শ্রেণিকক্ষে কলহপরায়ণ ছাত্রগণ একে অপরকে “বাম্বু” দেবে। তাঁদের গুরুগণ যখন লঘু থাকবেন তাঁরাও তাদৃশ কর্মমুখর হবেন, গুরু হয়ে গুরুতর হয়ে উঠবেন। কলির পথে-ঘাটে, হট্টে-ক্ষেত্রে, কার্যালয়ে-মাতুলালয়ে, ন্যায়ালয়ে কী যমালয়ে সকল গুরুগণ এই বাম্বুযাপনে নিরত থাকবেন। মনসবদারী প্রথার মতোই, যাঁর তূণীরে যতো লক্ষ্য ও অলক্ষ্য বাম্বু সে ততোই গুণবান। বাম্বুর শক্তি ও সামর্থ্য এবং বাম্বুপ্রদানের নৈপুণ্য ও কৌশলের উপর নির্ভর করেই এঁদের শ্রেণিভেদ থাকবে।

এদের মধ্যে কেউ কেউ বয়ঃক্রম-নিরপেক্ষে এসব কর্মে শিশু, কেউ কিশোর, কেউ সদ্যযুবা কেউ বা পক্বকেশ মহাপুরুষ হবেন। কেউ বংশপ্রয়োগে পীড়িত করবেন, আবার কোনও কোনও বংশ আপাত মনোরম হলেও কালান্তক হবে। বংশস্থবিল ছন্দের কথাই কেবল আপনারা জ্ঞাত আছেন, বংশপ্রদানে আপনাদের ততো পারদর্শিতা নেই। কলিযুগের প্রত্যেক দিবস-ই বংশদিবস। তবুও এই মহাস্ত্রের মাহাত্ম্য স্মরণ করে একটি দিন তার অনুধ্যান অত্যাবশ্যক বটে।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১১: দেব-দেউল কথা ও মদনমোহন মন্দির

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

তবে কেবল বংশদিবসের উদযাপক হলে মানবগণ বাম্বুপ্রবণ বলে নিন্দিত হতে পারেন, তাই দু’দিন বাদেই তাঁরা স্বকৃত ক্ষতে স্বীকৃত মলম লাগানোর প্রয়াস করবেন। তা-ই হল বিশ্বময় শান্তির উদযাপন। লক্ষ্য করবেন, বিশকে পার হয়ে একুশে এই শান্তির আয়োজন। এ বাহ্যতঃ নির্বিষ হলেও এর অন্তরে একুশে আইন। কবিও বলবেন, যা অপ্রাপ্য, যাকে নাহি পাই, তাকেই মন পেতে চায়। এই সমীকরণেই, দুর্লভ বা অলীকের প্রতি মানুষের অনন্ত আগ্রহ। কলিকালে শান্তির উদযাপন তাদৃশ। বাসে-ট্রেনে, স্টেশনে-বাজারে, কর্মে-ধর্মে, সাগরে-বন্দরে, জন্মে ও মরণে কলিকালে অপার আলোড়নের যে আয়োজন নিত্য-ই প্রতীয়মান হবে, তাদৃশ বিষয়কেই কলিতে “শান্তি” বলা হবে। উত্তুঙ্গ তৈলাক্ত বংশরূপ বাম্বুতেই কলির শান্তিপ্রিয় মানবগণ সদাই ঊর্ধ্ব ও অধোগামী হয়ে নিত্যচঞ্চল থাকবেন। এই চাঞ্চল্য-ই শান্তি। আর এই শান্তির আশ্রয়-ই হল বাম্বু।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ

এই হল কলির জীবগণের অপার মহিমা। এই হল কলির অচিন্ত্যনীয় পৌরুষগাথা। যা কিছু স্মরণীয়, তা বস্তুতঃ গতায়ু। শান্তির উদযাপন-ও এমন একটি গতবস্তুর স্মৃতিচর্চা, কলি স্বীয় মহিমায় তাকে নিত্যসত্য করে তুলবেন। আবার, যা কিছু প্রবলরূপে বিদ্যমান তা-ই কলির একমাত্র বুদ্ধিগ্রাহ্য, বাম্বু এমন-ই একটি বস্তু, যা দুর্বল, অস্ফুট তা সত্য ও শিব হলেও কলিতে অপাঙক্তেয় হবে। বাম্বুর ওই সবলতা যেমন কলির অশান্তি, তেমনই প্রাণ-ও বটে। কখনও কখনও বংশের চেয়ে কঞ্চি দড় হলেও তা নিত্য নয়। প্রাবল্যে-ই কলির অস্তিত্ব ও বিনাশ। কলিকালে সঙ্ঘশক্তি তাই বিশ্রুত হবে। আপনারা কলিকালের অনুধ্যান করুন।”—চলবে।
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content