বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলী বৈশম্পায়নকে বললেন, মহাত্মন, শিক্ষক দিবসের তাৎপর্য কী? কী এই ব্রত? কেন এই তিথি কলিতে সমাদৃত হবে? আমাদের এই কৌতূহল নিরসন করুন।

বৈশম্পায়ন হেসে বললেন, এটি কলির একটি বিশেষ মহোত্সব। ভাবে এটি ব্রত হলেও স্বভাবে ভিন্নতর। দক্ষিণায়নে ভাদ্র মাসে সকালবেলা অন্তেবাসী অর্থাৎ বিদ্যার্থীর দল সুশোভিত হয়ে বিদ্যামন্দিরে এই ব্রত পালন করবেন। তবে দক্ষিণায়ন হল অকাল। এই সময়ে দেবগণ নিদ্রিত থাকেন। এই কালে দেবগণের প্রতিভূ গুরুগণের এই অকালবোধনের পার্বণ ধরায় সুবিদিত হবে। বিবাহে কী জন্মবাসরে যাদৃশ আড়ম্বর ও আধিক্যতা কলিতে পরিলক্ষিত হবে, গুরুবাসরের সমাগম তার তুলনায় কিঞ্চিদপি ক্ষীণ হবে না। যাঁরা গুরুপদসেবী হয়ে এই দিনে কেক কেটে বেলুন ফাটিয়ে লজেন্স বিলিয়ে মোমবাতি নিবিয়ে দীপ-ধূপ-বাদ্য-আতোদ্য-ব্যাজন-নৈবেদ্য-ঢোল-খোলসহকারে কলিতে গুরুগণের গৌরব বৃদ্ধি করবেন তাঁরা যথেষ্টই সুকুমারমতি, বুদ্ধির বৃহস্পতি হবেন, সন্দেহ নেই। তবে এই বন্দনা যদিও মন্দ না, তবুও তা পূর্ণিমার পরের ক্রমক্ষীয়মান চন্দ্রের তুল্য হবে, এ বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ কোথায়?
যেকালে দেবগণ নিদ্রিত, সেকালে গুরুগণ-ই দেবতা, তাঁদের আসন-ই দেবপীঠ, তাঁদের বচনমাত্রেই উপদেশ, হস্ত-পদসঞ্চালনমাত্রেই অনুসরণীয় হবে। যদিও ক্ষেত্রবিশেষে গুরুগণের আদ্য উকারের লোপে লঘুত্বের সম্ভাবনা, তথাপি এঁরাই অচলায়তন যেমন গড়তে পারবেন, ভাঙতেও পারবেন, তাতেও সন্দেহ নাস্তি।

ঋষিগণ উৎফুল্ল হয়ে বৈশম্পায়নকে বললেন, হে গুরুদেব! গুরুমাত্রেই পরম্ ব্রহ্মতুল্য একথা আমরা জানি। ব্রহ্ম যেমন বিরুদ্ধ বৈশিষ্ট্যেই স্বপ্রভ হন, কলিজীবী শিক্ষককুল-ও কি তাই? জীবাত্মাগণ যেমন পরমাত্মার আংশিক প্রকাশরূপে প্রসিদ্ধ হন কলিস্থ বিদ্যার্থীসকলও তেমনই কি তাদৃশ হবেন?

বৈশম্পায়ন বললেন, বাপু! কলির শিক্ষককুল কেবল বিদ্যামন্দিরেই আবদ্ধ হবেন, এমন ভাবনাই সংকীর্ণতা। শিষ্য সিদ্ধিলাভের আশায় গুরু-সন্নিধানে গমন করেন। কলির বিদ্যার্থী স্বয়ং সুসিদ্ধ হয়ে সান্দ্র ও হাঁড়ির অন্নে বিলীয়মান আলুর তুল্য হবেন। তাঁরা কোথায় যে কখন প্রকট হবেন তা অনুমানসাধ্য হলেও কদাপি ধ্রুব নয়। এঁরা পাঠনকালে স্বগৃহে, পরীক্ষাকালে টয়লেটে, মূল্যায়নের পর গুরুগণের গুরুভার হয়ে প্রকটিত হবেন। গুরুগণকে এরা কখনও পিতা, কখনও ভ্রাতা, কখনও মাতা, কখনও উদ্গাতা, কখনও লোষ্ট্রবত্ বলে জানবেন ও মানবেন। বস্তুতঃ কলিতে বিদ্যার্থীর সিদ্ধি কেবল গুরুমুখী নয়, বিচিত্রগামী ও বহুস্তরীয়। কলির বিদ্যাও কেবল গুরুমুখী নয়, গুরুগণ অজ্ঞাত হলেও বিদ্যা নির্বাধ হবেন। কখনও তিনি আন্তর্জালবাসিনী, কখনও চৌর্যবৃত্তিরূপে পরীক্ষাকেন্দ্রস্থা হবেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১২: আমাকে আমার মতো থাকতে দাও

ফেলে আসা স্মৃতি, সুরসম্রাজ্ঞী দীপালি নাগ, পর্ব-১: প্রায় ৪২ বছর আগেকার কথা, আমি তখন ফ্রক পরা স্কুলের মেয়ে

বস্তুতঃ কলিকালে সকলই বৈকল্পিক। কলির শিক্ষকমাত্রেই গুরু নন, গুরুই কখনও বা লঘু। গুরু আলোকগামী হবেন এটিই শাস্ত্রের ইঙ্গিত। আলোকের প্রতিশব্দ ‘গো’। কলিকালের গুরুগণ কখনও মার্গপ্রদর্শক আলোকতুল্য বটে, কখনও বা দোহনযোগ্য গাভীসদৃশ-ও। গাভীও গো শব্দের অর্থই বহন করেন। এছাড়াও গমনার্থক go শব্দের সঙ্গেও গুরুগণের আত্মীয়তা লক্ষণীয়। অতীতে যে গমনের ভাব ‘চরৈবেতি’ বলেই জ্ঞাপিত হতো, তা-ই কলিযুগে ‘I go up, We go down’-এর শিক্ষায় ভাবিত হবে।

কলিস্থ শিক্ষক-অধ্যাপক-আচার্যগণ স্থান-কাল-পাত্র-লিঙ্গনির্বিশেষে ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ হবেন। কলির সর্বত্রই এই স্যার ও ম্যাডামগণের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যাবে। জ্ঞানদানের প্রবণতা কলির মার্গে-নগরে-বন্দরে-জনপদে-হট্টে-ক্ষেত্রে সর্বত্রই বিদ্যমান হবে। কখনও তা আদেশ, কখনও উপদেশ, কখনও প্রবচন কখনও বা তর্জনরূপে প্রকট হবে। যে আত্মজ্ঞান একদা প্রজ্ঞানির্ভর পরমাত্মার জ্ঞান বলে পরিজ্ঞাত হতো, তা-ই কলিকালে ‘ওহে মূর্খ আমি কতো জানি এই দেখুন’ এতাদৃশ আত্মপ্রচার হবে। শিক্ষণ বা জ্ঞাপনের তুলনায় বিজ্ঞাপন ও প্রদর্শন-ই হবে কলির প্রাণ। শ্রেণিকক্ষ অতিক্রম করে এই পঠন-পাঠন অহোরাত্র ও আজীবন সচল থাকবে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭১: ছোট মাছকে অবাঞ্ছিত না ভেবে প্রতিপালন করলে বিকল্প আয়ের দিশা পাওয়া যাবে

বস্তুতঃ, কলিকালে সকলেই শিক্ষক, সকলেই জ্ঞাপনে ও বিজ্ঞাপনে একান্ত উত্সুক হবেন, বিদ্যার্থী, শিষ্য, ছাত্র ইত্যাদি পদাবলী ক্রমশঃ অভিধানে সংকীর্ণ হবে। কলিকালে ‘বর্ষে বর্ষে দলে দলে’ র ছাত্রধারা দৃশ্যতঃ বিচিত্রগামী থাকবে বটে, তবে এঁরা তীর্থস্থানে পুণ্যার্থীর তুল্য বিদ্যাস্থানে পরীক্ষার্থী হয়েই প্রকটিত হবেন কেবল। শিক্ষক এঁদের কাছে পরীক্ষকরূপেই পরিজ্ঞাত হবেন।

শিক্ষকগণ ব্রহ্মতুল্য-ই নিরাকার ও বিরুদ্ধস্বভাবগ্রস্ত-ই হবেন। যিনি নিকটস্থ রূপে অনুমিত, তিনিই আবার দূরস্থ, যিনি সমদর্শীরূপেই জ্ঞাত, তিনিই আবার বিপরীতধর্মী, যিনি নক্ষত্রতুল্য দূরস্থ তিনিই আত্মার আত্মীয়, প্রাণের আরাম বলেই অনুভূত হবেন। এঁরা যুগপত্ ভুয়োদর্শী ও একদেশদর্শী, এঁরাই ত্রিগুণাতীত ও সর্বজ্ঞ, এঁরাই আবার অজ্ঞেয়, অবাঙ্মনস্-গোচর, এই শিক্ষককুল-ই যুগপত্ Hot এবং Cool… কলির মহিমা এমনই যে, শিক্ষকগণ পরমাত্মাতুল্য মহান্ হলেও ছাত্রগণ জীবাত্মা নন, তাঁরাও পরমাত্মা কিন্তু মহত্তর, কলির এমনই বিচিত্র মহিমা, কলি এমনই বিচিত্রগামিনী।

হে মুনিগণ! শাস্ত্রে অবয়ব-অবয়বী, জন্য-জনকাদি নানাবিধ সম্বন্ধ সুবিদিত, কিন্তু আশ্চর্য এই যে ছাত্র-শিক্ষকসম্বন্ধ কলিযুগের একটি বহুচর্চিত পদবন্ধ হলেও বস্তুতঃ এঁদের মধ্যে তাদৃশ কোনও কোনও সম্বন্ধ নেই, এটি একটি জীবনধর্ম, কলিস্থ সকলেই শিক্ষক—এটিই অভ্রান্ত, সেকারণেই কলিযুগে শিক্ষকদিবসের মহিমা এতো বিপুল। কলিস্থ জীবগণের মধ্যে কখনও ছাত্রভাব বিদ্যমান হয়, তবে এ রজ্জুতে সর্পভ্রমমাত্র, গগনে প্রদীপ্ত ভানু যেমন অদ্বিতীয়, সলিলবর্তী তাঁর অজস্র মণ্ডল যেমন মায়ামাত্র তেমনি কলিযুগে শিক্ষকগণ-ই বিদ্যমান, ছাত্রগণ মায়াজীবীমাত্র।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

যত মত, তত পথ, পর্ব-৪: শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান

জীবন যেমন প্রকৃত শিক্ষক, জীবন যেমন একমাত্র সত্য, তেমনই কলির জীবমাত্রেই শিক্ষক, শিক্ষকতামাত্রেই জ্ঞানদান, জ্ঞানমাত্রেই বাগাড়ম্বর, আড়ম্বরমাত্রেই উত্সবরূপে বিবেচিত হবে। শিক্ষা দানরূপে সর্বদাই বিবেচিত হয়। সম্প্রদানে সত্ত্বনাশ হয়, শিক্ষাদানে জ্ঞান বৃদ্ধি পায় একথা শাস্ত্রে সুবিদিত। কলিকালে এর যথার্থ উপযোগ। যা দান করা হয়, সে বিষয়ে দাতার পুনরায় আগ্রহ নিন্দিত। কলিকালে শিক্ষক দানের পর গ্রহণসামর্থ্য ও জ্ঞানের পরিমাণ যাচাই করতে গেলেই জানবেন ‘যা গেছে তা যাক’…যিনি তা গ্রহণ করবেন নবনবোন্মেষশালিনী প্রতিভায় অর্জিত বিদ্যাকে তুষার থেকে সলিল, বারি থেকে বাষ্পের রূপান্তরের মতোই নবীনতর করে তুলবেন। বিদ্যুৎ ও সময় যেমন বন্দী করা যায় না, তা বহমান ও রূপান্তরগ্রহণে যেমন একান্ত কুশল, তেমনই প্রদত্তা বিদ্যাকে যাচাই করা একান্ত নিষ্ফল। পরীক্ষাকালে তার পূর্বরূপ আর বিদ্যমান থাকে না, ক্ষণজন্মবাদের সূত্রে তা তখন নবীনতর।

এই বিদ্যা এবং তাঁর ধারক-বাহকগণ কলিকালে অদ্ভুতকর্মা হয়ে বিপুল মহিমা ও তরঙ্গে জ্ঞান ও অজ্ঞানের বেলাভূমিতে সর্বদাই ক্রিয়াশীল হবেন। শিক্ষককুল-ই কলির সর্বাধার, শিবরাত্রির দেবাদিদেব, অকালবোধনের মহাশক্তি। পূজান্তে বিসর্জন যেমন বিহিত, তেমনই উত্সবান্তে এঁরাও গমিতমহিমা… তবু, ব্রহ্মতুল্য অজ্ঞেয় কোন শক্তিবলে গতায়ু হয়েও এঁরা প্রাতঃস্মরণীয়, হতায়ু হয়েও শতায়ু, এঁদের আয়ু, এঁদের জীবন তাঁদেরই ছাত্রনামক মহত্তর সত্তায় ভাস্বর থাকবে। হে পুণ্যাত্মাগণ, কলিযুগ-ই স্বয়ং শিক্ষক, কলিজীবীগণমাত্রেই শিক্ষক, কলির প্রতিটি ক্ষণমাত্রেই পরীক্ষা, প্রতিটি দিবসমাত্রেই শিক্ষকদিবস। ওহে তোমরা কলির জয়ধ্বনি দাও, শিক্ষকগণ অমর হয়ে কলিকালে স্বীয় মসী ও বিদ্যারূপ অসির গুণে কৃতকর্মা হয়ে উঠুন এই প্রার্থনা সার্থক হোক।
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content