অলঙ্করণ: লেখক।
সদ্য আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পিছনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। লেখাপড়া করলে নাকি ঝঞ্ঝাটের সম্ভাবনা থাকে। মূকের যেমন শত্রু নেই শোনা যায়, তেমনই অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও মহা সুবিধা। কে যেন আদালতে কিছুই জানে না বলে কেবল “ব্যা” বলেছিল। তাতেই বাজিমাত। অন্যদিকে অক্ষরজ্ঞান আছে বলেই অনেকে ভয়ানক রকমের জ্ঞানী বলে জানা যায়। আসলে, এ সবই শোনা কথা। সাক্ষরতা অভিযান, সর্বশিক্ষা পার হয়ে সাক্ষর হওয়ার পরিচয় কেবল স্বাক্ষরে, সকারের পায়ে একটা ত্রিকোণ জুতো না পরালে চলার মতো পরিস্থিতি আসে না বটে। কেন? সদ্য সাক্ষর থেকে আমলা, গাড়িচালক থেকে দেশচালক সকলকেই ওই স্বাক্ষর করতেই হয়। যাকে সিগনেচার বলে।
এখন দেশকালের পরিস্থিতিতে অক্ষরজ্ঞান থাকাটা বাঞ্ছনীয়, সাহেবরা যাকে লিটারেসি বলেন। অ আ ক খ, এ বি সি ডি, কম্পিউটার, মাউস, এমএস এক্সেল কিংবা ওয়ার্ড জানাটা লিটারেসির মধ্যেই পড়ে। লিটারেট হয়ে লিটারেচর পড়তে হবে এমন কিছু ব্যাপার নেই, তার চেয়ে সাক্ষর হয়ে স্বাক্ষর হওয়া ভালো। কিন্তু যে অক্ষর নিয়ে এতো কথা, পড়তে লিখতে শিখে যেটা একজন পারবে বলেই মনে হয়, সেটা হল বানান করে করে লেখা। কিন্তু ‘বানান’ আর ‘বানানা’ এখন সমার্থক। দুটির মধ্যেই কিছু কলা, বলা ভালো শিল্পের অবকাশ আছে। সাক্ষর মানুষ সমদর্শী। শাস্ত্র থেকে সংবিধান, জীবন থেকে রাষ্ট্র তেমনটাই করতে বলে।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৩: মালিকা পরিলে গলে/ প্রতি ফুলে কে-বা মনে রাখে?…
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?
অক্ষরজ্ঞান হলেই সাক্ষর মানুষ ‘দলে দলে যোগ দিন’ এই মহামন্ত্রের প্রেরণায় এক মহামিলনের গাথা রচনা করতে বসে। সেখানে সব এক। স্বর ব্যঞ্জন হ্রস্ব দীর্ঘ য-ফলা, য-ফলা, রেফ হসন্ত বিসর্গ ভাওয়েল কনসোন্যান্ট স্পর্শ বর্ণ উষ্ম বর্ণ কোনও ভেদাভেদ, বিধিনিষেধ, অস্পৃশ্যতা না মেনে যে যেমন পারে সিট দখল করে, যেমনটা লোকাল ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছলেই উল্টো দিকের যাত্রীর দল করে থাকে। সেখানে সকলেই সকলের পাশে সক্ষম, যোগ্য। যে অদ্ভুত বানান, বানানার মতোই রাস্তার ধারে সাইনবোর্ড কী পরীক্ষার খাতায় লম্বমান হয়ে ঝোলে, ঝুলে ঝুলে নিরন্তর শোভা বাড়িয়ে চলে, সেই অদ্ভুত কলার পশ্চাতে কী মহান সাম্যের ভাব আছে তা ভাবলে আশ্চর্য হতেও বিস্ময়বোধ জাগে।
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১০: সাবিত্রীদেবীর দৃষ্টিতে টুকরো সময়
প্রথম আলো, পর্ব-৫: বিশ্বের প্রথম ঘড়ি কোনটি? আবিষ্কারক কে?
এই যে রকমারিতে ইকার না ঈকার তা বোঝা ঝকমারি, রীতিমতো চলতে গেলে সেই রীতি ভেঙেই আগে ঈকার আর পরে ইকার কেন তা বুঝতে গেলে বোঝা বাড়ে। কৃষ্ণ-বিষ্ণু পিঠে যে বোঝা নিয়ে চলেন, ঝঞ্ঝাটেও কি সেই ভার? এসব জেনে ন্যগ্রোধ বৃক্ষের নিচে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বুঝি, নয়তো দোকানে “দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ,/ চিনি-পাতা চাল, দুটা পাকা ডাল, ডিম ভরা দৈ” চেয়ে হতাশ হতে হয়।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৫: একটাই ডেনজার জুজু যদি ধরে
তাই সাক্ষরের থেকে স্বাক্ষরের দাম বেশি। আঁকা-বাঁকা প্যাঁচ খেলিয়ে জলের ওপর হাওয়ার দাগের মতো অথবা আদ্যানাথের মেসোমশাইকে খোঁজার কায়দায় নিজের স্বাক্ষর রাখুন, আমড়াতলার মোড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমড়াতলার মোড়েই এসে দাঁড়ান, অযথা জল আর জলপাই কিংবা আলু-আলুবোখরার তফাত্ খুঁজলে হাতে বুঝি পেনসিলটাও থাকবে না!—চলবে।
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।