বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


স্কেচ: লেখক।

সদ্য পেরিয়ে আসা গেল আন্তর্জাতিক মশকুইটো দিবস। কী কিউট না? পেরিয়ে গেল, কিন্তু পার পাওয়া গেল না। মশকরাও কুইট করবে না, মানুষের-ও লড়াই জারি থাকবে। প্রতি বর্ষায় ডেঙ্গি লেঙ্গি দেবে। সেই কবে পোস্টমাস্টার ম্যালেরিয়াতে ভুগে চাকরি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল। রোনাল্ড রস এরপর ম্যালেরিয়াকে জব্দ করতে পারলেও মশাকে পারলেন কই? বর্ষায় জগতে রসাধিক্য ঘটলেই মশাধিক্য-ও ঘটে। তবে মশা ‘উইমেন ইম্যানসিপেশন’ বা নারীমুক্তির আন্তর্জাতিক ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডর।
ভাবতে হবে, মশা কোন শব্দরূপ? হ্যাঁ, লতা-র মতো। স্ত্রীলিঙ্গ। তো সেই মশার পছন্দের খাবার রক্ত। এদিকে পুরুষ মশা যারা, তারা ওই ‘লতার’ রস খেয়ে বাঁচে নাকি। মশাদের সঙ্গে ফাইট কার? কেন, মানুষের। বাকিদের ফাইট লেজ নেড়ে। ডগ থেকে কাউ, পিগ থেকে গোট… একটা গোটা লেজ নাড়িয়েই মশার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। মানুষ কী করে? তেল মেশানো জল, জল মেশানো তেল, ধোঁয়া, থাপ্পড়, গ্যাস, বাষ্প, ইথার তরঙ্গ, এক্স রে, ইলেকট্রিক শক, হুণ, মারাঠা, মোগল সব নিয়ে ছুটে গিয়েছে, পিচকিরি থেকে বন্দুক, কামান থেকে বোমা সব ছুঁড়েই দেখেছে মশার দিকে। তবুও প্রলয়কালের নটরাজের মতো মশা নেচে নেচে বেরিয়ে আসে খাটের তলা থেকে কিংবা স্টেশনে মেল ট্রেন এলে যেমন নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে হয়, তেমন করেই মানুষকে অস্পৃশ্য জেনে চেয়ারের বাম দিকের হাতলের উত্তর-পশ্চিম কোনে গিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়। তারপর আবার…
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১০: ধনু হেসে বলে, শর, জান না সে কথা—আমারি অধীন জেনো তব স্বাধীনতা

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৭: প্রকৃত শাসক মহারাজ, একটি রাজ্যের আলোয় উত্তরণ

মশাই! মশা নিয়ে মস্করা নয়। মশাট কিংবা মশানজোড় থেকে মস্কো কিংবা বঙ্গ থেকে কঙ্গো, মশার দাপটে কম্পমান। সর্বত্র-ই মসনদে আসীন তিনি। এই কম্পন কখনও ম্যালেরিয়া, কখনও ডেঙ্গি, কখনও ভয়ে, কখনও আর কীসে কে জানে। ঘনাদা পর্যন্ত মশাকে সমঝে চলেন।

গল্পে দেখা যায়, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীকে বধ্যভূমি মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তারপর কী হয় তা আর বলা হয় না যদিও। খুব সন্দেহ হয়, মশানে মশা কামড়ায়। কামড়ে কামড়ে মেরে ফেলে। একইভাবে, জুতা আবিষ্কার করতে গিয়ে রবিবাবু মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তির কথা বলেছেন। এ মশক জলের পাত্র হলেও, মশারাও কিন্তু ছাড়ার পাত্রী নন। তাঁরাও মানুষের কাঁখে, পিঠে ইত্যাদি অগম্য স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে রক্তপান করেন। নিতান্ত ব্যায়ামবীর বা ব্ল্যাকবেল্ট না হলে এদের সঙ্গে এঁটে ওঠা কঠিন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭: গৃহিণী সারদার প্রথম দক্ষিণেশ্বর আগমন

পৃথিবীতে মানুষের আদিকাল থেকেই রক্তের অক্ষরে যে ইতিহাস লেখা আছে তা পড়ে শুনে সুকুমারমতি ছাত্রছাত্রীদের ধারণা হয়, সকল অধিকার ও স্বাধীনতা রক্তের বিনিময়ে পেতে হয়, রক্ষা করতে হয়। এতে ভুল কিছু নেই। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে, একথা মানুষেরই। পরোপকার করা মানুষেরই স্বভাব। মশার উত্তরপ্রজন্মকে পৃথিবীতে আনার জন্য তাহলে এই ত্যাগটুকু স্বীকার করতেই হয়। রক্তদানের কথাই বলা হচ্ছে মশাই! কোন গ্রুপের, সর্বজনীন দাতা-গ্রহীতা এসব ভেবে লাভ নেই, বুক চিতিয়ে অথবা পিঠ পেতে দাও। তোমরা সকলেই, মানুষ-গরু-ছাগল নির্বিশেষে সর্বজনীন দাতা।

দেবী মশা হাসিমুখে সব রক্ত গ্রহণ করবেন। ঠান্ডা, গরম, এ বি সি ডি, লাল-নীল-কালচে, ইঙ্গ-বঙ্গ, সকল লিঙ্গ সকল পুরুষ সকল বচনের প্রোডাক্ট তিনি নেবেন। তোমরা রক্ত দেবে, তিনি শরীর জ্বালিয়ে দেবেন। এই পথে মুক্তিও আসতে পারে, আপনি চাইলে। না চাইলে পোস্টমাস্টারের মতোই পালাতে হবে। আরে! পালিয়ে যাবেন কোথায়? ঝোপে-ঝাড়ে, গৃহকোণে, নীরবতায়, সরবতায়, কাছে-দূরে সেই তিনি পরম পুরুষের মতো সদা বিরাজমান।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১০: সুন্দরবনের রক্ষয়িত্রী বনবিবি

আপনার নিরাপদ আশ্রয় হতে পারে নিশ্ছিদ্র মশারি। তবে মশারিতে ঢোকা ও বেরোনোর উপায় বাতলিয়ে ইদানীং নানা ট্রেনিং কোর্স হয়। সেটা না করলে সারারাত বিপ্লব অবধারিত। এখন প্রশ্ন হল, মশা কী কী জানে? যা যা মানুষকে কষ্ট করে শিখতে হয়। মশা আন্তর্জাতিক মানের স্ট্রাটেজিস্ট, কৌশলী। মশা অধিকাংশ সময়েই গেরিলাযুদ্ধ করে। মশা কূটনীতি বোঝে। মশা অ্যানাটমি বা শারীরবিদ্যা গুলে খেয়েছে। হ্যাঁ, মশা রক্ত-ও খায় বটে, বলা ভালো রক্ত খাওয়ার জন্যই এত আয়োজন। সে তো মানুষও করে থাকে। কিন্তু মশাকে বুঝে ওঠা? ‘স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম্ দেবাঃ ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ’ একথা যে মশার জন্যই বলা হয়েছে সেকথাই কি মানুষ জানে? মানুষ জানে, সব থেকে খেতে ভালো পাউরুটি আর ঝোলাগুড় আর…আর কীসের রক্ত যেন?

মশা অবশ্য এতো বাছবিচার করে না। আপনি মশারিতে ঢুকলেন, মশা এসে আপনার রক্তনালীতে বসল। অ্যানাটমি। কানের কাছে গুনগুনিয়ে কিছু বলল। আপনি না বুঝে হাওয়ায় থাপ্পড় দিলেন। উনি নিমেষে অদৃশ্য হলেন। আপনি ভাবলেন যুদ্ধ জিতে গিয়েছেন। অশ্বত্থামা হতো। কিন্তু খানিক পরেই কী অদ্ভুত ম্যাজিক, বালিশের নিচে থেকে তিনি বেরিয়ে মশারির ধার ঘেঁষে ঘেঁষে নেচে নেচে আপনার কোমরের উত্তর-পূর্ব কোণে তিনি সূঁচ ফোটালেন। অপারেশন মিডনাইট। আপনার বাম কনুই-এর পূর্ব দিকটা একটু খচমচ করে উঠল। আপনি ভাবলেন হাতের কোথাও বুঝি অথবা ঘাড়েই হয়তো তিনি আছেন। আপনি পশ্চিমোত্থাসনের কায়দায় আপনার পশ্চার বদলাতে গেলেন। দেখলেন কোমরের কাছটা অচল টাকার মতো ফুলে উঠছে। কূটনীতি, যুদ্ধ আর কৌশলে কৌটিল্যতুল্য তীক্ষ্ণতা নিয়ে আপনার মরমে প্রবেশ করেন এঁরা।
আরও পড়ুন:

ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে তারাপীঠ পুণ্যভূমির পবিত্র নদী দ্বারকা

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৩: কোচ কামতেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য এক অনন্যসাধারণ মিশ্রশৈলীর উদাহরণ

আপনি যদি একান্তই নিন্দুক না হন, তাহলে উপলব্ধি করবেন কার সঙ্গে এক মশারিতে আছেন। যে কৌশলী যোদ্ধাকে আটকানোর জন্য বর্ম সাঁটিয়েছেন, সে বর্মের নিচেই নিজের ফর্মে আছে। তবে কখনও কখনও প্রবল রক্তপানে এরা বলরামের চ্যালা হয়ে হামা দিতে থাকেন। তখন গালিভারের চাপে লিলিপুটদের মতোই আপনার হাতপায়ের নিচে এঁদের রুধিরসিক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। কেউ কেউ এদের রক্তপিপাসু ভ্যাম্পায়ার বলে গালি দেবে, তাদের জন্য নীরবতা পালন করুন।

অদূর ভবিষ্যতে মশার জীবনচক্র বাদ দিয়ে যদি মশার জীবনী পড়ে উদ্বুদ্ধ হতে হয়, ঘাবড়াবেন না। কিংবা, স্বয়ং মশা-ই যদি শিক্ষয়িত্রী হয়ে তাঁর অদম্য মনোভাবের গোপন রহস্য শেখাতে আসেন, জেনে রাখুন। কৌশলী দংশনে আপনারাও কম পারদর্শী নন, তবে গুরু বিনে গতি নাই। আপনার দুই হাতের ফাঁক কিংবা আঙুল গলে অনায়াসেই যারা মারের সাগর পার হচ্ছে, তাদের জন্য একটা হলেও হাততালি দিন।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content