রবিবার ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫


স্কেচ: লেখক।

“ব্যাঘ্র কহিল, ভাই হে! তোমার সুখ তোমারই থাকুক, আমার অমন সুখে কাজ নাই। নিতান্ত পরাধীন হইয়া রাজভোগে থাকা অপেক্ষা, স্বাধীন থাকিয়া আহারে ক্লেশ পাওয়া সহস্রগুণে ভালো। আর আমি তোমার সঙ্গে যাইব না। এই বলিয়া বাঘ চলিয়া গেল।”

বিদ্যাসাগর মশাই এমন বলেছিলেন বটে, কিন্তু এই আমি-তুমির স্বাধীনতা-অধীনতার মাপ আর কাঠির মাঝে একটু ফাঁক আছে। আমাদের জন্য স্বাধীনতা, তোমাদের জন্য? ন্যাশনাল রিল্যাক্সেশন ডে। তোমরা কারা? যারা ‘আম’ বা সাধারণ নয়, আমেরিকা। এঁরা চিত্তবিনোদন অথবা মনে মনে নির্ভার হওয়ার জন্য একটা দিন বেছে রেখেছেন। আমরা যেমন একটা দিন বেছে রাখি কিছু কাজ করবো বলে।

তবে হ্যাঁ, আমাদের কাজের পিছনে একটা কাম থাকে, নিষ্কাম কাজ-ও করি আমরা। নিষ্কাম অথবা সকাম কাজকাম করতে করতে মেমোরি ফুল হয়ে গেলে আমরা একটু রিফ্রেস করে নিই, আমাদের যন্ত্রগুলো একটু আরাম পায়। সে মাথা হোক, বা নাক, সবসময় গলানো যায় নাকি? কাঠিগুলোতে অয়েলিং করতে হয়, বিশদে পরিচর্যা করতে হয় দাঁত নখ ইত্যাদির।
যতক্ষণ এই লকডাউন থাকে ততক্ষণ-ই আমাদের রিল্যাক্সেশন, তারপর সব যন্ত্র নিয়ে যখন আবার আমরা কর্মদিবসে ঝাঁপিয়ে পড়ি তখনই যদিও আমাদের যথার্থ রিল্যাক্সেশন শুরু হয়। কে যেন বলেছিলেন, কর্মেই আমাদের মুক্তি। যে যখন যে কাজটি করবে, সেটির যথাযথ উদযাপনেই তার মুক্তি। এখন প্রশ্ন হল, এই দিবস আন্তর্জাতিক নয় কেন? নিদেনপক্ষে আমাদের জন্য দরকার ছিল বৈকি!

তবে, আমাদের বিনোদনের সুযোগ ও সুবিধা অনেক বেশি, তাই হয়তো আলাদা করে উদযাপনের প্রয়োজন হয় না। কী করে? কেন, সকালে বাসে ট্রেনে যে ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ খেলতে খেলতে যাতায়াত করেন অনেকেই, সে তো ‘রিল্যাক্সেশন’-ই… কেন? খেলা তো বিনোদন, আর বিনোদন মনকে আনন্দ দেয়। শুধু “যেমন খুশি সিটে বোসো” এই ইভেন্ট ছাড়াও ‘যেমন খুশি দাঁড়াও’, ‘যেমন খুশি বলো’ এসব ইভেন্টেও আপনি নামতে পারেন। এসবেও রিল্যাক্সেশন। বাস-ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছে গেলেও এই ‘যেমন খুশি’ ইভেন্ট চলতে থাকে। এটাই আমাদের স্বাধীনতা। অফুরন্ত রিল্যাক্সেশন-ও।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৯: তা বলে কি প্রেম দেব না!

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭১: ইংরেজের চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘দাগী আসামী’

আসলে, স্বাধীনতার ইংরাজি যা-ই হোক, বাংলা হল ‘রিল্যাক্সেশন’।
কেউ কেউ বলবেন, রিল্যাক্সেশন স্বপ্নে থাকুক, দিবা-স্বপ্নে নয়, স্বাধীনতা চলায়-বলায় থাকুক, মজা কিংবা মজানোয় নয়।

তবুও যা হওয়ার ছিল যাপন, তা হয়েছে বিজ্ঞাপন, তা বুঝি রোটি-কাপড়া-মকানের দোকান কেবল, ঝলমলানোর জন্য, অন্ধকার পেরিয়ে আগুন হয়ে জ্বলার জন্য কই? যাকে ঘিরে জীবনের ফুল থেকে মরণের ফল ফলার ভাবনা ছিল, তা হয়েছে বোকা বোকা ‘fool’ থেকে পতনমুখী ‘fall’ এর দই-চিড়ে ফলার। কখন যে নেপোয় সেই দই মেরে দেয় তা বোঝা কঠিন। রিল্যাক্সেশনের সেশন ওভার হলে সেদিকে তাকানো যাবে’খন।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৬: ঐতিহাসিক বিরল বিবাহ ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া

যত মত, তত পথ, পর্ব-১: শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দ-পাঠশালা

আসলে, স্বাধীনতার সঙ্গে ‘ল্যাজ’ গজানোর একটা সম্পর্ক আছে নাকি। শোনা যায়, স্বাধীনতা এলে ‘পাখা’ গজায়। পাখাওয়ালা স্বাধীনতা ততদূর ভাল যতক্ষণ না ‘পিপীলিকা’র সঙ্গে তুলনা ওঠে। লেজওয়ালা স্বাধীনতা মাছি তাড়াতে বেশ কাজে লাগে, রাস্তা ছেড়ে ডালে ডালে চলতে গেলেই বিপদ ভারি! নখ দাঁতওয়ালা স্বাধীনতায় বেজায় মুশকিল, রক্তপাতের ভাবনা আছে, আঁচড়ানোর সুখ থাকতে পারে, কামড়ের ভয় ষোলো আনা।

আসলে, কর্ম হল আনন্দের উদযাপন। স্বাধীনতার সম্ভোগ। কাজ করও আনন্দ পাও, অন্যকে আনন্দ দাও। ফল? রিল্যাক্সেশন, আবার কী!! এই ধরুন, সন্ধেবেলা টিভি দেখছেন। কী করছেন? দেখছেন বুঝি শুধু? শিখছেন, জানছেন-ও। চ্যানেল জুড়ে আনন্দের হাট। ‘যেমন খুশি করো’, ‘এসো ঝগড়া করি’, ‘তুমি অধম হলে আমি উত্তম’, ‘আমরা সবাই রাজা’, ‘তেঁতুলপাতায় নজন’ ‘কুমির-ডাঙা’, ‘চোর-পুলিস-ডাকাত-বাবু’, ‘মামারবাড়ি’ ইত্যাদি নানান মজার খেলা চলছে। আর খেলা মানেই বিনোদন, বিনোদন মানেই রিল্যাক্সেশন। আপনি রিল্যাক্স করছেন? আজ্ঞে না। ওই যে! শিখছেন, জানছেন, আপনি কাজ করছেন। কর্ম। যদি তা সোনার তরীতে জায়গা পায়।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’

এটা যখন আপনি সকালের মিউজিক্যাল থেকে বিকালের মেলোড্রামায় কাজে লাগাবেন, তখন আপনার রিল্যাক্সেশন। কর্মই মুক্তি দেবে। যেমন খাঁচা থেকে পায়রা বেরিয়ে আকাশ দেখে, তেমনই ট্রেনে-বাসে-ক্লাসে চাষে-Rush-এ-ফাঁসে-বাঁশে আমাদের মুক্তি। তেমনই হেসে, খেলে, কাজ খুঁজে না পেলে, পাশে কিংবা ফেলে-ও আমাদের মুক্তি। অনন্ত বন্ধনে মুক্তি, লাইন দিয়ে গণতন্ত্রে মুক্তি, ভাবনা কিংবা গণজনের ভিড়ে মুক্তি, আলোয় আলোয় এই আকাশে মুক্তি।
রিল্যাক্সেশন-ই আমাদের স্বাধীনতা, স্বাধীনতাই আমাদের মুক্তি।

নিজের ইচ্ছামতো চলে আমাদের স্বাধীনতার উদযাপন, মুক্তির আস্বাদন। কিছু কথার ফোড়ন, টিপ্পনীর তেজপাতা, বাঁকা হাসির ঝাঁঝলঙ্কা চোখা যুক্তির আগুনে ফুটিয়ে সামান্য নীতিকথা আর কূটনীতি-সহযোগে গরম গরম পরিবেশন করতে হবে এই রিল্যাক্সড ইণ্ডিপেণ্ডেন্সকে। দরকারে অকাজেই রিল্যাক্সেশন। আসল কথা হল, আনন্দ পেতে হবে, দিতেও হবে। আপনি সোনার ‘কাঠি’ রূপোর ‘কাঠি’ নিয়ে জাদু দেখাচ্ছেন, এতে ক’জন একটু বিপদে পড়লেও বাকিরা আনন্দ পাচ্ছে। এটাই বা কম কীসের। রিল্যাক্সেশন। বেশি লোকের ভার যেখানে সেখানেই সমষ্টির উন্নয়ন, সেখানেই তো কল্যাণ। স্বাধীন আনন্দে রিল্যাক্সড হয়ে শুধু খুঁজে নিতে হবে কিছু ঘাড়, তাতে চাপিয়ে দিতে হবে কর্মভার। তারপর নিষ্কাম হয়ে তার উদযাপনে ব্রতী করতে হবে। সামনে কিছু গাজর থাকবে। পিছনে ঝলমলে কাঠি। করতে না চাইলে? স্বাধীনতার বুলি আর Bully শোনালেই…রিল্যাক্সড!
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content