শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


গৌরব বিলেত ছেড়ে এল । ছবি: সত্রাগ্নি।

এত দিনের বসুন্ধরা গ্রুপের কর্মজীবনে গৌরবমোট কত দিন ছুটি নিয়েছে সেটা আঙুল গুনে বলা যায়। ক্লাইভ রো থেকে অফিস লোয়ার রডন স্ট্রিটের ঝকঝকে অফিসে চলে আসার পর থেকেই সপ্তাহে পাঁচদিনের নিয়ম চালু হল। স্বয়ং গৌরব দাদুকে বুঝিয়েছিল এতে প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে, কর্মীরা খুশি থাকবে। ছুটি কম নেবে। গৌরব সঠিক ছিল। কিন্তু সে প্রত্যেক শনিবার অফিসে আসতো, কখনও কখনও রবিবারেও। পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নিত, কিন্তু অফিস বাদ দিয়ে নয়। এমনকি বসুন্ধরা ভিলার অত বড় দুর্গাপুজোর সময়েও গৌরব অফিস ঘুরে আসত। বড় দিন থেকে বছরের শেষটুকু ছুটি নিয়ে গৌরব সপরিবারে বেড়াতে যেত। সারা বছরে ওই ৫-৬টা দিন।
সেই গৌরব সেনগুপ্ত এক সপ্তাহের ছুটির জন্য আবেদন করল। বাচ্চাদের স্কুল কামাই করিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গেল উত্তর বাংলার জঙ্গলে। চিনু দাদাকে এই নিয়ে বড় জ্যাঠামণি বেশ বকাবকি করেছিলেন। চিনুদাদা বলেছিল, সে এতটা বুঝতে পারেনি। চিনুদাদার থেকে বেশি কুণ্ঠিত হয়েছিল সুপ্রিয়া বৌদি। ঘরোয়া ব্যাপার হিসেবে চিনুদাদা নিজে গৌরবের সঙ্গে কথা বলে ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিতে চেয়েছিল। গগনকান্তি ও বিকাশকান্তি রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু তারকবাবুর সঙ্গে কথা বলার পর তারা দু’জনেই বুঝতে পারলেন কথা বলে হয়তো আরও কোন লাভ নেই। ভাগ্নে হিসেবে গৌরবকে তার মামারা যতটা চেনেন তারক নিয়োগী বোধহয় তার চেয়েও তাকে বেশি চেনেন কাজের সূত্রে। এমন একটা দিনও যায়নি যেদিন গৌরব তারকবাবুর সঙ্গে কথা বলেনি।
আরও পড়ুন:

৩য় খণ্ড, পর্ব-৬: শ্রীতমার কাছ থেকে বাবলিকে অন্যভাবে দেখলাম চিনলাম জানলাম

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৮: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-পরিচয়

গৌরব যতটা বিনীত যতটা ভদ্র ঠিক ততটাই সিরিয়াস ততটাই নিজের সিদ্ধান্তে কঠিন। সেদিন লোয়ার রডন স্ট্রিটে অফিসে গগনকান্তির ঘরের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তারকবাবু বলেছিলেন—
—দেখুন গগনবাবু-বিকাশ বাবু, আজ একটা কথা বলি আপনাদের। যখন বিকেডি প্রথম বিদেশে গৌরবকে ফোন করেছিলেন তার আগে তিনি যথেষ্ট মানসিক দোলাচলে ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন —”বাবু গৌরবকে দেশে ডেকে পাঠানোটা কি ঠিক হবে? সে যদি কোনওভাবে তার দাদুকে ভুল বোঝে। হ্যাঁ ওকে ছোটবেলায় পড়াশোনার ব্যাপারে সাহায্য যা করার করতে হয়েছে। কিন্তু কালিম্পং-এ ভর্তির ব্যাপারে তার কোনও সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। এত মেধাবী ছাত্র পেয়ে ফাদার নিজে আমাকে বলেছিলেন আপনার নাতি না হলেও এই ছেলেটিকে আমার স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য আমি কালিম্পং ছেড়ে তার বাবা-মার কাছে যেতাম। তারপর সে লন্ডন স্কুল ইকোনমিক্স-এ গেল নিজের মেধার জোরে। তার দাদা সৌরভ ও বাবার হঠকারিতার জন্য মায়ের কষ্ট তাকে যন্ত্রণা দেয়। এগুলো আমি বুঝি। এখন আমি যদি তাকে বসুন্ধরা গ্রুপের চাকরির জন্য ডেকে পাঠাই সে মুখে কিছু বলবে না, কিন্তু এটা ভাববে না তো দাদু প্রতিদান চাইছে। যেহেতু তার মাকে ভাইকে মামার বাড়ি থেকে সাহায্য করা হয়েছে বসুন্ধরা ভিলা সেই সবকিছুর রিটার্ন চাইছে?”
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৫: মা সারদার ভ্রাতৃবিয়োগ

—আমি বিকেডিকে বলেছিলাম, আপনি এত সফল একজন মানুষ। আর আপনার সাফল্যের মূল কারণ হল আপনি মানুষের মন বুঝতে পারেন। আপনি একবারটি তার সঙ্গে কথা বললেই বুঝতে পারবেন তার মনে কি চলছে? যদি বিন্দুমাত্র কোনও বাধা থাকে সেটা তার কথায় প্রকাশ পাবেই। কিন্তু আপনি যদি কিছু না বলেন তাহলে তো তার একটা অভিমান হতে পারে। যেহেতু তাদের পদবী দত্ত নয়, তারা সরাসরি এই পরিবারভুক্ত নয়। মায়ের সূত্রে মামার বাড়িতে আশ্রিত। তাই বসুন্ধরা ভিলার ঐশ্বর্যে তাদের কোনও অধিকার নেই। তার তো মনে হতে পারে যে, এই যে দাদু এত পরিশ্রম করে ক্লাইভ রোয়ের ছোট্ট অফিস থেকে আজ লোয়ার রডন স্ট্রিটের ঝকঝকে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংয়ে বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিজে পৌঁছল সেখানে তার বুদ্ধিমত্তা তার প্রচেষ্টা যোগ করতে পারলে সে সেটাকে হয়তো আরও আরও বড় হতে পারতো। সেখানে তার মামারা বা মামার ছেলেরা সবাই এক একটা অংশ হয়ে উঠেছে, কিন্তু তার কোনও অস্তিত্ব সেখানে নেই। বিকেডি আমার কথা মেনে সেদিন রাতেই গৌরবকে ফোন করেছিলেন। তারপর বসুন্ধরা গ্রুপ অব কোম্পানিতে গৌরব সেনগুপ্তর কন্ট্রিবিউশন নিয়ে আমি আর কি বলব? তবে আর একটা কথা যেটা আপনারা জানেন না সেটা শুনুন। গৌরব এখানে জয়েন করার পর প্রথম দিন আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় সে আমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। আমি অফিসের মধ্যে ওই কাণ্ড দেখে চমকে তাকে ধরে ফেলেছিলাম।
—আরে আরে এটা যে অফিস?
—সেই জন্যই তো প্রণাম করছি।
—মানে।
—সে বলেছিল, “আমি যে আজকে আপনার সামনে এ ভাবে দাঁড়িয়ে এখানে জয়েন করলাম, তার পেছনে আপনার চেষ্টাও কম নেই বাবু। আমি সব জানি মা আমাকে সব বলেছেন। বাবু একটা দাবি আছে, আমাকে আপনি করে বা আমার নামের সঙ্গে বাবু জুড়ে প্লিজ বলবেন না। একসঙ্গে কাজ করবো আমার অসুবিধে হবে।” সেই থেকে গৌরবকে আমি তুমি করেই বলতাম।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮১: কবির ‘গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ বৈষয়িক-কারণে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছিলেন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫২: রামচন্দ্রের বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে নৈতিকতার জয়? নাকি পিতার প্রতি আনুগত্যের জয় ঘোষণা?

এতদিন বাদেও সে সব স্মৃতি মনে পড়ায় তারকনিয়োগী কি চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখটা চেপে ধরলেন!
—জানেন আমি পরে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। বিদেশে তুমি তো পাউন্ডে রোজগার করতে। সে সব ছেড়েছুড়ে এই যে আমাদের এখানে চলে এলে, তা তোমার স্যালারি বা পার্ক্সের ব্যাপারে কারও সঙ্গে কিছু কথা বলেছ। সে বলল স্যালারি নিয়ে কথা বলতে গেলে আমার ক্ষতি হতো। না বলে আমার লাভ হয়েছে। অনেক লাভ।
—কী রকম?
—দাদুর কাছে মাইনে চাইলে আমি একটা টাকা চাইতাম। সে জায়গায় উনি হাজার হাজার টাকা আমাকে দিচ্ছেন। তাছাড়াও কলকাতা শহরে একটা ফ্ল্যাটে আমি ভাড়া থাকি। কারণ বসুন্ধরা ভিলায় যে আমি থাকবো না সেটা দাদু আমার থেকে ভালো জানতেন।—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content