লেখনী: ছবি: প্রতীকী। সৌজন্য: সত্রাগ্নি।
স্বর্ণময়ীর হার্টের সমস্যা ছিলই। আচমকা বুক ধড়ফড় শুরু হতো। প্রথমবার হয়েছিল অনেকদিন আগে। স্বর্ণময়ীর মা কণিকা বা বাবা আনন্দমোহন বাবুর তখন বেশ বয়স হয়ে গেছে। মেয়েদের বিয়ে’থা বহুদিন হয়ে গেছে। স্বর্ণময়ীর রফিক চাচা তখনও আনন্দমোহনের গাড়ি চালান। বরাননগর থেকে গ্রে স্ট্রিট আসা-যাওয়ার বেশ সুবিধে ছিল। এখন শহরের এ মুড়ো থেকে সে মুড়ো। বরানগর থেকে বালিগঞ্জ অনেকটা রাস্তা। কিন্তু তখন আনন্দমোহন এবং কণিকা দুজনেই শক্তপোক্ত ছিলেন। নাতিরা হুটহাট করে গাড়ি নিয়ে বরানগর চলে যেত বাড়ি গমগম করত। তারপর তারা বিয়ে-থা ব্যবসা বড় হওয়া এসব নিয়ে এত জড়িয়ে পড়ল তখন আর দাদুর বাড়িতে যাওয়ার সময় হতো না। ওদের কোন মামা নেই তাই বরানগরের বাড়িটা দাদুর বাড়িই ছিল। ছেলেমেয়ে বৌমাদের সময় না হলেও স্বর্ণময়ীর তো মা বাবা। তাকে তো যেতেই হয়। বিনয় কান্তির রাজ্যের ব্যস্ততা। সারাদিনই নানান মিটিং। তার মধ্যেও অন্তত ১৫ দিনে একটা রবিবার সময় করে স্বর্ণকে নিয়ে নিজে যেতেন বরানগরের বাড়িতে। স্বর্ণময়ী মাঝে মাঝে অবাক হয়ে বিনয়কান্তিকে দেখতো। কাজে ব্যস্ত বা অন্যমনস্ক বিনয়কান্তি খেয়াল করে হয়তো জিজ্ঞেস করলেন—
—স্বর্ণ? কী?
—কিছু নয়।
—কী দেখছো?
এই বলে বিনয় হয়তো মুখে বা চুলে হাত দিয়ে অজান্তে ঘটে যাওয়া গন্ডগোলটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করত।
—উঁহু! সব ঠিক আছে।
—তবে?
— আমি তোমায় দেখছি। দেখছি আর ভাবছি কোথা থেকে শুরু করে তুমি কোথায় এসে পৌঁছেছো।
— জীবনের পথে একা এগোনো যায় না স্বর্ণ। কবি একলা চলার কথা লিখেছেন বটে সেটা পথিকের মনে সাহস যোগানোর জন্য। এগোতে গেলে গড়তে গেলে বাধা টপকাতে গেলে সঙ্গে লোক চাই ফ্রেন্ড ফিলোজাফর গাইড চাই। আমার দাদামশাই মুকুন্দ সেনগুপ্ত, আমার মা বসুন্ধরা, কত্তাবাবু গিরিজাশংকর, উইলিয়াম পিটারসন, তারকবাবু, তুমি, আমার ছেলে বৌমা নাতিনাতনি এই গোটা পরিবার। এঁরা না থাকলে আমি একা কোথাও পৌঁছতে পারতাম না স্বর্ণ। জীবনের গোলক ধাঁধায় হয়তো এখনও ঘুরে মরতাম।
—স্বর্ণ? কী?
—কিছু নয়।
—কী দেখছো?
এই বলে বিনয় হয়তো মুখে বা চুলে হাত দিয়ে অজান্তে ঘটে যাওয়া গন্ডগোলটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করত।
—উঁহু! সব ঠিক আছে।
—তবে?
— আমি তোমায় দেখছি। দেখছি আর ভাবছি কোথা থেকে শুরু করে তুমি কোথায় এসে পৌঁছেছো।
— জীবনের পথে একা এগোনো যায় না স্বর্ণ। কবি একলা চলার কথা লিখেছেন বটে সেটা পথিকের মনে সাহস যোগানোর জন্য। এগোতে গেলে গড়তে গেলে বাধা টপকাতে গেলে সঙ্গে লোক চাই ফ্রেন্ড ফিলোজাফর গাইড চাই। আমার দাদামশাই মুকুন্দ সেনগুপ্ত, আমার মা বসুন্ধরা, কত্তাবাবু গিরিজাশংকর, উইলিয়াম পিটারসন, তারকবাবু, তুমি, আমার ছেলে বৌমা নাতিনাতনি এই গোটা পরিবার। এঁরা না থাকলে আমি একা কোথাও পৌঁছতে পারতাম না স্বর্ণ। জীবনের গোলক ধাঁধায় হয়তো এখনও ঘুরে মরতাম।
স্বর্ণময়ী বুঝতে পারেন, কোনও মানুষকে বড় হতে গেলে নিঃস্বার্থ হতে গেলে তার উপলব্ধিকেও অনেক বড় হতে হয়।
কচিৎ-কখনও একেবারেই সময় করে উঠতে না পারলে সঙ্গে মেজ বউ ছন্দা যেত বা ছোট ছেলে কমলকান্তি। অমলকান্তিকে নিয়ে স্বর্ণময়ী যেতে চাইতেন না। নিজে আজীবন সাহিত্য পিপাসু ছিলেন। ছেলে হলেও সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর কাছে অমলকান্তির মর্যাদা অনেক। বরানগরের বাড়ি থেকে তার সমস্ত বই আর পরবর্তীকালে অমলকান্তির বই —এসব নিয়েই বসুন্ধরা ভিলার লাইব্রেরি ঘর তৈরি হয়েছিল। তিনি জানতেন যিনি লেখেন তাঁকে একপাতা লিখতে হয়তো কখনও কখনও পঞ্চাশ পাতা পড়তে হয়, হয়তো বা একশ পাতা ভাবতে হয়। আবার কখনও বা নাওয়া-খাওয়া ঘুম ভুলে না থেমে পাতার পর পাতা লিখে যেতে হয়।
কচিৎ-কখনও একেবারেই সময় করে উঠতে না পারলে সঙ্গে মেজ বউ ছন্দা যেত বা ছোট ছেলে কমলকান্তি। অমলকান্তিকে নিয়ে স্বর্ণময়ী যেতে চাইতেন না। নিজে আজীবন সাহিত্য পিপাসু ছিলেন। ছেলে হলেও সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর কাছে অমলকান্তির মর্যাদা অনেক। বরানগরের বাড়ি থেকে তার সমস্ত বই আর পরবর্তীকালে অমলকান্তির বই —এসব নিয়েই বসুন্ধরা ভিলার লাইব্রেরি ঘর তৈরি হয়েছিল। তিনি জানতেন যিনি লেখেন তাঁকে একপাতা লিখতে হয়তো কখনও কখনও পঞ্চাশ পাতা পড়তে হয়, হয়তো বা একশ পাতা ভাবতে হয়। আবার কখনও বা নাওয়া-খাওয়া ঘুম ভুলে না থেমে পাতার পর পাতা লিখে যেতে হয়।
আরও পড়ুন:
৩য় খণ্ড, পর্ব-১: কথাগুলো বিনয়কান্তিকে বলার সময় সুরঙ্গমার মনের মধ্যে একটা ঝড় চলছিল
শ্রীলা মজুমদারের যেমন সুমধুর কণ্ঠস্বর তেমন অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা
সাহিত্য পিপাসু কোন পাঠককে বইয়ের পাতায় শব্দে অক্ষরে আটকে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। তাই অমলকান্তির অনেকটা সময় লাগে একা থাকার একা ভাবার একা লেখার। ছেলের নিজে পছন্দ করলেও সুরঙ্গমাকে ঈশ্বরই জোগাড় করে দিয়েছেন। সুরঙ্গমার মধ্যে যদি ঈশ্বর শিল্পসুষমা না দিতেন, তাহলে অমলকান্তির সঙ্গে তাঁর এই লেখার কারণেই দূরত্ব তৈরি হতে পারতো। তা হয়নি। ঈশ্বর একে অপরের পরিপূরক দুজন সঠিক মানুষকেই মিলিয়ে দিয়েছেন। আর সুরঙ্গমাকে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই অন্য কারণে। এত কম ছবিতে অভিনয় করেছে, এতদিন অভিনয় করছে না কিন্তু তবুও বাংলা ছবির দর্শকের কাছে এসে এতটাই প্রিয় যে রাস্তায় ঘাটে গাড়িতে বা বরানগরে এখনও তাকে দেখতে লোকে ভিড় করে।
বিনয়কান্তি একটি ছেলেকে তাদের দেখাশোনার জন্য রেখেছেন। ঠিক কাজের লোক নয়। ভাগ্যক্রমে বরানগরেই বাড়ি। লেখাপড়া জানা। ছেলেটির নাম রাহুল। সেরকম চাকরিবাকরি পায়নি, তাই তারক বাবুর কাছে এসেছিল চাকরির খোঁজে। বরানগরে স্বর্ণময়ীদের বাড়িতে একটি ছেলের দরকার হবে এটা তারকবাবুকে বিনয় জানিয়ে রেখেছিল। এই ছেলেটিকে দেখে তারকবাবুর মনে হল যে, এ বেশ ভদ্র বিশ্বাসী। এরকম একটি ছেলেকে এই কাজে বহাল করা যায়।
বিনয়কান্তি একটি ছেলেকে তাদের দেখাশোনার জন্য রেখেছেন। ঠিক কাজের লোক নয়। ভাগ্যক্রমে বরানগরেই বাড়ি। লেখাপড়া জানা। ছেলেটির নাম রাহুল। সেরকম চাকরিবাকরি পায়নি, তাই তারক বাবুর কাছে এসেছিল চাকরির খোঁজে। বরানগরে স্বর্ণময়ীদের বাড়িতে একটি ছেলের দরকার হবে এটা তারকবাবুকে বিনয় জানিয়ে রেখেছিল। এই ছেলেটিকে দেখে তারকবাবুর মনে হল যে, এ বেশ ভদ্র বিশ্বাসী। এরকম একটি ছেলেকে এই কাজে বহাল করা যায়।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৩: সুন্দরবনের এক অনন্য প্রাণীসম্পদ গাড়োল
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৯: নিরুপমা দেবী— তাঁকে নিয়েই গল্প হোক!
রাহুল আনন্দমোহন বাবুকে কাজে সাহায্য করত। আনন্দমোহনবাবু তখন আর হাইকোর্টে এসে প্র্যাকটিস করতে পারতেন না। তবে বাড়িতে বসে দলিলপত্র বানিয়ে দেবার কাজ করতেন। স্ত্রী কণিকার নানা রকম শারীরিক দুর্বলতা ছিল। বাড়িতে যদি রাহুলের মত একটি ছেলে থাকে তাহলে প্রয়োজনে ডাক্তার ডাকা বা অফিসে তারক বাবুকে বা বসুন্ধরা ভিলায় খবর দিতে পারবে। তবে রাহুল নিয়মিত যোগাযোগ তারকবাবু সঙ্গেই রাখতো। বরানগরের চৈতন্য ঘাটের কাছে বাপের বাড়ি থেকে বাবা আনন্দমোহন বসু মা কণিকাকে দেখে স্বর্ণ সেদিন সবে বসুন্ধরা ভিলায় ঢুকেছেন।
আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝন ঝন করে ফোন বেজে উঠলো বসুন্ধরা ভিলায় । রাহুল সচরাচর বসুন্ধরা ভিলায় ফোন করে না। কিন্তু আজ করেছে কারণ সে সময় নষ্ট করতে চায়নি। স্বর্ণময়ী বিনয়কান্তি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার খানিক পরেই আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন আনন্দমোহন। বুকে ব্যথা অনুভব করেন সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে খবর করে দিয়েছে রাহুল। তিনি এসে দেখেছেন।
আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝন ঝন করে ফোন বেজে উঠলো বসুন্ধরা ভিলায় । রাহুল সচরাচর বসুন্ধরা ভিলায় ফোন করে না। কিন্তু আজ করেছে কারণ সে সময় নষ্ট করতে চায়নি। স্বর্ণময়ী বিনয়কান্তি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার খানিক পরেই আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন আনন্দমোহন। বুকে ব্যথা অনুভব করেন সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে খবর করে দিয়েছে রাহুল। তিনি এসে দেখেছেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩০: গিরীশচন্দ্রের মা সারদা
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৭: পলায়নপর পঞ্চপাণ্ডব-ভীমসেনের গতিময়তায় কোন মহাভারতীয় দিগদর্শন?
তারক বাবুকে খবরটা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বিনয়কান্তি ছুটে গিয়েছে বরানগর । সঙ্গে উৎকণ্ঠিত স্বর্ণময়ী। যতটা দ্রুত গাড়ি চালানো সম্ভব ড্রাইভার চালিয়েছিল। কিন্তু বাবাকে শেষ দেখা আর দেখতে পারেনি স্বর্ণ। আসলে শেষ দেখার উপায় ছিল না। রাহুল সেটা বিনয়কান্তিকে জানিয়েছিল। গোটা রাস্তাটা সেই নির্মম সত্যিকে চেপে রেখেছিল বিনয়।
আনন্দমোহন চলে গেলেন। বাবাকে শেষ মুহূর্তে দেখতে না পাওয়ার এই আক্ষেপটাই তার মধ্যে একটা ভয় সৃষ্টি করল। একসময়ের অত্যন্ত ডাকাবুকো সাহসী স্বর্ণময়ীর এরপর থেকে কোনও আশঙ্কা হলেই বুক ঢিপঢিপ করে। বসুন্ধরা ভিলার হাউস ফিজিশিয়ান ড. রথীন চ্যাটার্জি বলেন ভয় হলো নেশার মতো। ধরে গেলে ছাড়ানো শক্ত। নেশা যাকে ধরেছে, নেশা তাকেই ছাড়তে হবে, নিজের থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। ছুঁড়ে ফেলতে জানতে হয়। কিন্তু এই বয়সে এসে স্বর্ণময়ী আর সেটা পারেন না। এদিকে মা কণিকা কিছুতেই বসুন্ধরা ভিলায় এসে থাকতে রাজি হলেন না। —চলবে।
আনন্দমোহন চলে গেলেন। বাবাকে শেষ মুহূর্তে দেখতে না পাওয়ার এই আক্ষেপটাই তার মধ্যে একটা ভয় সৃষ্টি করল। একসময়ের অত্যন্ত ডাকাবুকো সাহসী স্বর্ণময়ীর এরপর থেকে কোনও আশঙ্কা হলেই বুক ঢিপঢিপ করে। বসুন্ধরা ভিলার হাউস ফিজিশিয়ান ড. রথীন চ্যাটার্জি বলেন ভয় হলো নেশার মতো। ধরে গেলে ছাড়ানো শক্ত। নেশা যাকে ধরেছে, নেশা তাকেই ছাড়তে হবে, নিজের থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। ছুঁড়ে ফেলতে জানতে হয়। কিন্তু এই বয়সে এসে স্বর্ণময়ী আর সেটা পারেন না। এদিকে মা কণিকা কিছুতেই বসুন্ধরা ভিলায় এসে থাকতে রাজি হলেন না। —চলবে।
এ শহরপ্রান্তর। চিত্রশিল্প সৌজন্য: প্রচেতা।
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com