যুদ্ধের প্রস্তুতি। ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি।
যুদ্ধের প্রস্তুতি
বসুন্ধরা ভিলায় যেন নিঃশব্দ যুদ্ধের প্রস্তুতি। বিমান দুর্ঘটনায় তন্ময়ের আচমকা মৃত্যু বিনয়কান্তি ও স্বর্ণময়ীকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে গিয়েছে। বিনয়কান্তি চলাফেরা করলেও স্বর্ণ মোটামুটি শয্যাশায়ী। তাঁর সর্বক্ষণের আশংকা বসুন্ধরা ভিলায় অভিশাপ লেগেছে। তাঁর সাধের পরিবার এ বার না ভেঙে যায়। ডাক্তার নার্স খেয়াল রাখে কিন্তু তিনি সারাক্ষণ সুরঙ্গমাকে কাছে চান।
ওদিকে অফিসে বেশ কিছুদিন ধরে অন্য একটা অশান্তি পাক খাচ্ছিল। প্রণয় স্টাফ ওয়েলফেয়ার এক্সিকিউটিভ। আর গৌরব সেনগুপ্ত চিফ ফাইনান্সিয়াল এক্সিকিউটিভ। দুটো পদেই এক্সিকিউটিভ শব্দটা জোড়া আছে বটে। কিন্তু যে কোন লোকই বুঝবেন যে কোম্পানিতে এদের দুজনের গুরুত্বের তফাৎটা অনেকখানি। প্রণয় এটা বোঝে যে শুধুমাত্র তার ইগোকে শান্ত করার জন্য স্টাফ ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের মাথায় বসিয়ে সেটাকে এক্সিকিউটিভ করে দেওয়া হয়েছে। এই ডিপার্টমেন্টের খুঁটিনাটি সবকিছুই সামলান তারক নিয়োগী। বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ-এ যাঁর গুরুত্ব অপরিসীম। অন্য সব ডিপার্টমেন্ট থেকে কোম্পানির বোর্ড মিটিংয়ে রেভিনিউ ভার্সেস প্রফিটের খতিয়ান দেওয়া হয়।
বোর্ড মিটিংয়ে প্রণয়ের ভূমিকা কাটা সৈনিকের মতো। শুধু বসে বসে অন্যের কথা শোনা, মিটিং শেষ হলে খাওয়া-দাওয়া। তার কিছু বক্তব্য নেই কিছু করে দেখাবার নেই। কারণ তার ডিপার্টমেন্টের সবটাই খরচা। গৌরব সেনগুপ্তকে সেই খরচার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব দিয়ে অনুদানের জন্য আবেদন। দিনের পর দিনই এক রুটিন প্রণয়ের সহ্য হয় না। সে একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তারক বাবুর বয়স হচ্ছে। তিনি হাই ব্লাড সুগার ব্লাড প্রেসারের রোগী। কিছুদিন যাবৎ কিডনিরও সমস্যা ধরা পড়েছে । আগে কেউ কখনও তাঁকে ছুটি নিতে দেখেনি। কিন্তু ইদানিং দু-তিন মাসে একবার তারকবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তারের পরামর্শে একটা বা দুটো দিন ব্রড স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে তাঁকে বিশ্রাম নিতে হয়।
যতীন ঘোষাল একজন অনেক দিনের পুরনো কর্মচারী। বিনয়কান্তি দত্তর সঙ্গে সরাসরি কাজ করতেন। তাঁর টাইপিস্ট ছিলেন। পরে তাঁকে ফাইনান্স ডিপার্টমেন্টের হেডক্লার্ক করা হলো। মানে গৌরবের ডিপার্টমেণ্ট। আর মাসখানেক বাদে তাঁর রিটায়ারমেন্ট। হঠাৎ তাঁর গুরুতর হার্টের অসুখ ধরা পড়ল। পেসমেকার বসাতে হবে। বসুন্ধরা গ্রুপ বেসরকারি কোম্পানি হলেও কর্মচারীদের চিকিৎসা বাবদ সমস্ত খরচা দিত। সব কর্মচারীদের স্বাস্থ্য বিমা করানো থাকতো। প্রাথমিকভাবে কর্মচারীর চিকিৎসাবাবদ সব খরচ কোম্পানি করতো পরে বীমা কোম্পানি থেকে প্রাপ্য টাকা দাবি করা হোত। সব টাকা পাওয়া যেত না যে টাকাটা বাকি থাকতো এযাবৎকাল সেটা কর্মচারীদের দিতে হতো। কিন্তু উইলিয়াম পিটারসেন তার প্রাপ্য সমস্ত টাকা বসুন্ধরা গ্রুপকে ফিরিয়ে দেবার পর বিনয়কান্তি ঠিক করেন তিনি সে টাকা কোম্পানির মূলধনের যোগ করবেন না। বোর্ডের অনেকেই তার বড়ছেলে বা মেজোছেলে বিনয়কান্তিকে বলেছিলেন যে এই টাকা এতদিন গ্রুপ উইলিয়াম পিটারসনকে ধার শোধ করেছে। পিটারসন সেই টাকা গ্রুপকে ফেরত দিয়েছে। সুতরাং এ টাকা তো গ্রুপের মূলধনেই ফেরত যাবার কথা। কোম্পানির চেয়ারম্যান ম্যানেজিং ডিরেক্টর বিনয়কান্তি দত্ত বলেছিলেন।
—যখন বহু প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে লড়াই করতে করতে পিটারসনসাহেবকে তার শোধ করছিলাম। তখন আমরা ভাবিনি এ টাকা তিনি নেবেন না। গ্রুপকে ফেরত দিয়ে দেবেন। আমি চাই যাঁদের ঘণ্টা মিনিট মাসের পরিশ্রমে এই টাকা আমরা সাহেবকে দিয়েছিলাম এবং এখন আবার ফেরত পেয়েছি সেটা স্টাফ ওয়েলফেয়ার ফান্ডে যাক। এটা একটা অনেক বড় মূলধন। এর থেকে সুদবাব আমরা যে টাকা পাবো সেটা কর্মীদের চিকিৎসা বাবদ খরচ হবে। এখন থেকে বিমা কোম্পানি টাকা ফেরত দেবার পর বাকি টাকা আর কোন কর্মীকে নিজেদের থেকে দিতে হবে না সেটা এই ফাণ্ড থেকে আসবে চিকিৎসাবাবদ খরচার জন্য এই কোম্পানির কোন কর্মচারীর কোন ভেদাভেদ থাকবে না। সকলে সমান সুযোগ পাবে।
সেই নিয়ম অনুযায়ী সব ধরনের খরচাসাপেক্ষ চিকিৎসা গ্রুপের কর্মচারীরা করাতে পারেন। বসুন্ধরা গ্রুপের কোন কর্মচারী চিকিৎসা অর্থের জন্য থেমে থাকে না। কিন্তু যতীন ঘোষালের পেসমেকার লাগানো থমকে গেল। তারকবাবু দুদিন অফিসে আসেননি। যতীনের পেসমেকার বাবদ একটা বড় খরচার অ্যাপ্রুভাল প্রণয়কান্তি দত্তের টেবিলে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। প্রণয় এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সে চাইছিল একটা বড় ঝামেলা হোক। যতীন ঘোষালের ফাইলটা নিজের ডেস্কে চাবি দিয়ে প্রণয় অফিস ছেড়ে ক্লাবে চলে গেল।
দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং...,, ২য় খণ্ড, পর্ব-৫২: এরপর আর সুরঙ্গমার কাছে কোনও কথা ছিল না
মুভি রিভিউ: আদুরের ‘মাথিলুকাল’ সারা ছবি জুড়ে মামুটির অসামান্য অভিনয় প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়েছে
—গৌরববাবু দোষটা আমার। অসুস্থ হয়ে আমি দুদিন অফিস আসতে পারিনি। পরশুই ফাইলটা এসেছিল। কিন্তু আমারই ভুলে বোধহয় যতীন ঘোষালের পেসমেকারের অ্যাপ্রুভালটা সম্ভবত আমার টেবিলেই পড়ে রয়েছে। আমি ওটা প্রণয়বাবুকে দিয়ে সই করিয়ে নিতে পারিনি ফলে হাসপাতালে যতীনবাবুর পেসমেকারের অপারেশনটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
গৌরব ছোটবেলা থেকে তারক নিয়োগীকে চেনে। তার দাদা সৌরভকে এই তারক নিয়োগী লালবাজার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন গৌরব বড় হয়ে তার সেজোমামা সেজমামীর কাছে সব শুনেছে। তারক নিয়োগী কখনও কর্তব্যচ্যুত হননি। গত পরশু তাঁর টেবিলে আসা এরকম গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তিনি প্রণয়কে দেননি এমনটা হতে পারে না। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে তাঁর ভুল হয়েছিল তাহলে প্রয়োজনে তিনি বসুন্ধরা ভিলাতে গিয়ে সে ফাইল দিয়ে আসবেন।
গৌরবের সাড়া শব্দ না পেয়ে তারক নিয়োগী উৎকণ্ঠিত।
—হ্যালো গৌরববাবু, আপনি শুনতে পাচ্ছেন তো?
—বাবু আমি সব শুনেছি আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আপনি অসুস্থ। বাড়িতে বিশ্রাম করুন। যতীন বাবুর বাড়ির লোক শুধু শুধু আপনাকে বিরক্ত করলেন কেন? আমার ডিপার্টমেন্টে উনি কাজ করেন। আমাকে সরাসরি ফোন করতে পারতেন। আমি একদম চিন্তা করবেন না যতীন ঘোষালের পেসমেকারের অপারেশনটা আজ হবে আমি নিজে দেখব।
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩১: সুন্দরবনের ঐতিহ্য গঙ্গাসাগরমেলা ও কপিল মুনির আশ্রম
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৮: শুরু হল কঠিন জীবনচর্যা
২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যে কীরা অসাধ্যসাধন করেছে। ছোট মেয়ে শ্যানন আর অ্যান্ডি অ্যালেনের সঙ্গে কথা বলে তাদের রিং সেরিমনি এক মাস এগিয়ে এনেছে। কারণ শ্যাননের ঠাকুরমা স্বর্ণময়ীর শরীর খুব খারাপ -তাই কীরা চান ছোট নাতনির বিয়ের ব্যাপারটাও তিনি যেন জেনে যান। এবার আর কোন ভুল হবে না সুরঙ্গমার ফুল ঠাকুরপো মানে ডাক্তার বিমলকান্তি দত্ত নিজে ফোন করে তাঁর মার কাছে এই অনুমতি নেবেন। সেইসঙ্গে বসুন্ধরা ভিলার থেকে যাতে সুরঙ্গমা ও অমলকান্তি অন্তত এই উপলক্ষে সেখানে আসেন সেটাও তিনি জানাবেন।
এ বার সুরঙ্গমাকে ঘুঁটি সাজিয়ে ফেলতে হলো। পরামর্শ নিতে হলো তাঁর সব সমস্যার সমাধান – সব শক্তির উৎস সাহিত্যিক স্বামী অমলকান্তির কাছে।বহু আলোচনায় স্থির হল।
অমলকান্তির সাহিত্য সম্মেলন তাই তার বিলেত যাওয়া হবে না। সুরঙ্গমার সঙ্গে কারও একটা যাওয়া দরকার – বউদের মধ্যে চিন্ময়কান্তির স্ত্রী সুপ্রিয়া তার দুই স্কুলপড়ুয়া ছেলে নিয়ে ব্যস্ত। বাবলি ছাড়া তরুণকান্তি অসহায়। থাকার মধ্যে ঋতু। তার ছেলে ছোট হলেও সেখানে স্বয়ং – কীরা বিমলকান্তি এবং শ্যানন নিজে তিন-তিনজন ডাক্তার থাকছেন।আর ঋতুরও একটু চেঞ্জ দরকার। কিন্তু বিদেশবিভুঁই-য়ে এতটা রাস্তা দুজন মহিলা আর একটা বাচ্চাকে তো পাঠানো যায় না। তাই ঠিক হলেও সঙ্গে মুমু মানে মৃন্ময় কান্তি যাবে। সানন্দা সব শুনে বলল—
—প্ল্যান তো ঠিক আছে। কীরা কাকিমা ওখানে ঠিক ব্যবস্থা করে ফেলবে। কিন্তু একদম দেরি করোনা। যত দেরি করবে তত ঋতুর কম্প্লিকেশন্স বেড়ে যাবে।
কীরার ব্রিটিশ এম্ব্যাসিতে খুব ভালো জানা শোনা ছিল। সেই সূত্র ধরে ভিসার কাগজপত্র জমা পড়ে গেল এয়ার টিকিট হয়ে গেল। কিন্তু বিমলকান্তির ফোন পেয়ে বাদ সাধলেন স্বর্ণময়ী স্বয়ং।
কীরাকে কোনওদিনই পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে পারেননি স্বর্ণময়ী। সেই কবে তার মানা না শুনে ছোট নাতনির নাম নদীর নামে রাখা হয়েছিল তা এখনও ভোলেননি বৃদ্ধা স্বর্ণময়ী। শ্যানন হলো আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় নদী আবার মানে ওয়াইজ রিভার বা জ্ঞানী নদী। এছাড়াও বৃদ্ধার অনুযোগের শেষ নেই কীরা বিমলকান্তির নিজেদের বিয়েই যখন চার্চে হয়েছে,- তখন বসুন্ধরা ভিলার লোকজন ডেকে নিয়ে গিয়ে বাঙালি মতে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কি মানে আছে? আর বিমলের সঙ্গে কীরার তো কবেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। সেই-বা বিয়েতে কর্তাতি করছে কেন? তারা যখন নিজেরা বিবাহবিচ্ছেদ করল তখন কি বসুন্ধরা ভিলার কারও মতামত নিয়েছিল? তাহলে আজ কিসের মতামত?
বরসে গা সাওন: স্মরণে উস্তাদ রাশিদ খান
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা
সুরঙ্গমা পড়ে গেল মহা বিপদে সুরঙ্গমার থাকা আর না থাকার মধ্যে ঋতুর ভালো থাকা মন্দ থাকা নির্ভর করছে। এদিকে বৃদ্ধা স্বর্ণময়ীর এতদিনের ভালবাসার এত প্রিয় সেজবৌমা তাঁর দাবিকে অস্বীকার করতে পারছেন না।
এ কি উভয় সংকটে পড়লেন সুরঙ্গমা? এক নতুন অধ্যায়ে পা রাখতে যাচ্ছে বসুন্ধরা এবং… কী করে এই বিপদ থেকে সব দিক রক্ষা পাবে। সুরঙ্গমা রাতে ঘুমোতে পারছেন না, সানন্দা ফোন করে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে এর বেশি দেরি হলে কলকাতাতেই যাহোক করে কিছু করতে হবে। সুরঙ্গমার জানেন কলকাতাতে এ কাজ সম্ভব নয়। বিদেশে সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে – ভিসা হয়ে গিয়েছে, যাওয়ার টিকিট হয়ে গিয়েছে … সুরঙ্গমার দরজায় টোকা পড়ল। সুরঙ্গমা অমলকান্তি দুজনেই ভীষণ অবাক। এত রাতে কে?
দরজা খুলতে দেখা গেল বিনয় কান্তির ঘরের বহুদিনের পরিচারক ভূষণ এসে ডাকছে।
—ভূষণ তুমি এত রাতে? বাবার কি শরীর খারাপ?
—আঁজ্ঞে না সেজমা। সাহেব একবার আপনাকে ডাকছেন
—এত রাতে বাবা ঘুমোননি?
—না। সাহেব জেগে। বেল দিয়ে ডেকে বললেন খুব দরকার। আপনাকে ডেকে আনতে।
—আচ্ছা আমি আসছি।
দ্রুত পোশাক বদলাতে বদলাতে সুরঙ্গমা একবার অমলকান্তিকে জিজ্ঞেস করলেন—
—তুমি একবার যাবে আমার সঙ্গে?
—বাবা তোমায় ডেকেছেন। তুমিই যাও।
হালকা আলো জ্বলতে থাকা বসুন্ধরা ভিলার নিশ্চুপ করিডোর পেরিয়ে যাবার সময় সুরঙ্গমা ভাবছে কি অপেক্ষা করছে বিনয়কান্তির ঘরে। এত রাতে এ ভাবে কেন তিনি ডাকলেন।