বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। ছবি: সংগৃহীত।

দু’জনেই আচমকা হো হো করে হেসে ওঠে। জেএনইউ-এর ক্যান্টিনে যেরকম ভাবে হাসতো, ঠিক তেমন। দু’জনেই পাশে তাকিয়ে নিজেদের সংযত করে নিল। হঠাৎ যেন খেয়াল করল সেই দিন থেকে আজ ওরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। অরুণাভ প্রসঙ্গ পাল্টালো—
—তোর শ্বশুর বাড়ি তো বিরাট ব্যাপার মোটামুটি কলকাতার হেরিটেজ স্পট। দ্য বসুন্ধরা ভিলা।
—ওই আর কি।
—তোদের বাড়িতে নিশ্চয়ই অনেক ভিসিপি মানে ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার আছে।
—অনেক না হলেও আছে। সেজমা’র কাছে আছে।
—সেজমা?
—আমার সেজ কাকিমা। সুরঙ্গমা সেনগুপ্ত এখন দত্ত।
—ও মাই গড। অ্যাক্ট্রেস সুরঙ্গমা! শুভা মাল্যদান তাইতো?
—হুঁ। দেখেছিস?
—না, শুনেছি।
—তা হঠাৎ ভিসিপি-র খোঁজ কেন?
—তোকে একটা জিনিস দেখতে দিতাম।
—তোর সিরিয়াল?
—উঁহু। তোর নাটক।
—মানে।
—আমিও জানতাম না প্রকাশজি আমাদের রক্তকরবী’র ভিডিও রেকর্ডিং করিয়েছিলেন। প্রকাশজি যে মারা গেছেন যেটা শুনেছিস নিশ্চয়ই।
—হ্যাঁ। হার্ট অ্যাটাক।
—হুঁ। কিছুদিন আগে দিল্লি গিয়েছিলাম তো প্রকাশজির এক বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ আলাপ হল। তিনি কথায় কথায় বললেন যে আমাদের রক্তকরবীর রেকর্ডিং তাঁর কাছে আছে। তবে সেটা অন্য ফরম্যাটে। অডিও ক্যাসেটের থেকে একটু বড়। সুপার এইট। দিল্লিতেই তার থেকে আমি ভি এইচ এসে মানে তোর নর্মাল ভিডিও ক্যাসেটে ট্রান্সফার করালাম। আমার সঙ্গেই ছিল আমি তোর জন্য নিয়ে এসেছি।
ক্যাসেটটা হাতে নিয়ে কয়েকমূহুর্ত তাকিয়ে রইল বাবলি। এক মুহূর্তে জেএনইউ ক্যম্পাসের দিনগুলো তার হাতের মুঠোয়। আচমকা দূর্ঘটনায় বাবার মৃত্যুর পর জীবনের সব খুশি যেন হারিয়ে গিয়েছিল। ক্যাম্পাসের সময়টা আবার সব বদলে দিয়েছিল। তারপর দূর্গাপূজোয় কলকাতা আসা বসুন্ধরা ভিলা। প্রণয়ের সঙ্গে দেখা দুম করে বিয়ে যেন স্বপ্ন!

তবে কয়েকমাস কাটতে না কাটতেই সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে বদলে গেল। বাবলি এখন মাঝে মাঝে ভাবে প্রণয়ের মতো এরকম উদ্ধত বদমেজাজি মানসিকভাবে অস্থির একজন মানুষের থেকে সে নিজেকে সরিয়ে নেয়নি কেন। শুধু কি সেজকাকিমা সুরঙ্গমার অনুরোধ, বা অন্যদের ভালোবাসা। বোধহয় না। নিজের বাবাকে অকালে হারিয়ে ফেলার পর জগদীশ্বর বাবলিকে তরুণকান্তির মত একজন বাবাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। একজন অসহায় পঙ্গু অসুস্থ চিত্রশিল্পী। বাবলি যদি বসুন্ধরা ভিলা ছেড়ে যায় তাহলে চিকিৎসার হয়তো ত্রুটি হবে না। শারীরিকভাবে তরুণকান্তি বেঁচে থাকবেন কিন্তু মানসিকভাবে মানুষটা শেষ হয়ে যাবেন। শুধু কি বাবলির প্রতি তরুণকান্তির আকূল নির্ভরতা, গভীর স্নেহ মমতা? নাকি আরও কিছু? বাবলি কি এখনও প্রণয়কে ভালোবাসে? বাবলি কি এখনও অপেক্ষা করে যে প্রণয় তার সমস্ত সংশয় সমস্ত অস্থিরতা ভুলে বাবলিকে নিয়ে আবার নতুন করে শুরু করবে?
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৪৮: বাবুদাদা কেমন যেন উদভ্রান্তের মতো থাকে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪৫: নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জ ছায়ায়

ক্যাসেটটা নেবার পরে অল্প কিছু স্ন্যাক্স খেয়ে বাবলি চলে এসেছে। ক্যাসেটটা হাতে নিয়ে চোখটা করকর করছিল। অনেক কষ্টে চোখের চশমা মোছার ছল করে নিজেকে সামলেছে। অরুণাভর সঙ্গে কলেজে অনেকগুলো দিন একসঙ্গে কাটিয়েছে। একসঙ্গে অভিনয় করেছে। বন্ধু হিসেবে। আজ সে বিবাহিত। হতে পারে তার দাম্পত্যজীবন রুক্ষ বন্ধুর। কিন্তু এই মুহূর্তে এই চোখের জল বা তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের আঁচটুকুও এখনও অবিবাহিত অরুণাভর কাছে ভুল সংকেত বয়ে নিয়ে যাবে।

অরুণাভ সঙ্গে গাড়ি এনেছিল। কলকাতায় এসে কিনেছে। সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি। বলেছিল বাবলিকে বাড়িতে ড্রপ করে দেবে। বাবলি অপরপারে মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি নোনতা এসব কেনার অছিলায় অরুণাভর প্রস্তাব এড়িয়ে গিয়েছিল। অরুণাভর কেনা গাড়িটা দেখবার উৎসাহ পর্যন্ত দেখায়নি। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আবার গড়িয়াহাটের দিকে হাঁটা দিয়েছিল।
—ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস তোর বাড়ি তো বালিগঞ্জ প্লেস। ওপারে।
—ওই তো হাজরা রোডের আগে জেব্রা ক্রসিং।
—কিন্তু তোর মিষ্টির দোকান তো জাস্ট ওপারে। এটাই তো শর্টকাট।
—সব শর্টকাট সবসময় সেফ নয়।

মুমু বা মৃন্ময়কান্তি ঋতমকে তার বাবার অভাব বুঝতে দিত না। ছোট্ট ঋতমকে সে আদর করে চ্যাম্প বলতো। সেই থেকে ঋতমের ডাকনাম চ্যাম্প হয়ে গেল। মুমুদাদা কাগজে পত্রিকায় ফ্রিল্যান্স লেখালেখি ফটোগ্রাফি সিনেমা তৈরি করার পাগলামি বয়ে নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। দশটা পাঁচটা অফিসের মতো তার কাজের কোন সময় ছিল না। তাই সে বাড়িতে অনেকটা সময় কাটাত। মাঝে মাঝে দিন চার-পাঁচ বা সপ্তাহখানেক পর্যন্ত গায়েব। আমার থেকে বছর তিনেকের বড় কিন্তু ওর মত একজন হ্যান্ডসাম ছেলে কেন বিয়ে না করে জীবন কাটাবার সিদ্ধান্ত নিল সেটা একটা ধাঁধা। বাবা এই লেখাটা শুরু করেছিলেন ২০০৯ নাগাদ। লেখাটার কোন নাম ঠিক করেননি। মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা লেখার শেষ করে তারপর লেখার নাম ঠিক করতেন। ২০১০ এ বাবা যখন মারা যান সেদিনও এই লেখাটা নিয়েই বসেছিলেন। সেদিনের লেখার কাগজ পেন মা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। পরে আমাকে দিয়ে বলেছিলেন—
—সু এই লেখাটা তুমি তোমার কাছে যত্ন করে রেখো। তোমার বাবার সম্ভবত বসুন্ধরা ভিলার আত্মকথা লিখছিলেন। শেষ করে যেতে পারেননি। আর লেখা যেহেতু লেখকের অকপট স্বীকারোক্তি। তাই এই লেখায় এমন সব ঘটনার উল্লেখ করা রয়েছে যেগুলো বহির্জগতে প্রকাশ না পাওয়াই ভালো। তুমি পড়লে কিছু কিছু বুঝবে। কিছু কিছু বুঝতে পারবে না। আমাকে জিজ্ঞেস করো, যদি আমার জানা থাকে তার উত্তর আমি তোমায় দেবো। কিন্তু অনেক অপ্রিয় গোপন কথা গোপনে থাকাই বোধহয় শ্রেয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৮: সুন্দরবনের তিন গাজী—রক্তান গাজী, তাতাল গাজী ও শতর্ষা গাজী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

আমার বিয়ে হয়েছে অনেক পরে ১৯৯৫ সালে, কিন্তু যে সময়ের ঘটনা এখন লিখছি তার অনেক ইঙ্গিত সংকেত বাবার লেখা থেকে পাওয়া। সেই লেখা উদ্ধার করতে গিয়ে জানতে পারলাম এমন কিছু তথ্য যে তথ্য সত্যিই অকথিত থাকাই উচিত। মায়ের মতো আমি শ্রীতমাকেও কথা দিয়েছিলাম বসুন্ধরা ভিলা ও এই পরিবারের মর্যাদার কথা ভেবে এই লেখা হয়তো কোনদিনই প্রকাশ করা যাবে না।

ঋতু চ্যাম্পকে সামলাতে পারতো না। মুমুদাদা সামলাতো। দুপুরে বা রাতে খাবার পর মুমুদাদা চ্যাম্পকে নিজের ঘরে নিয়ে যেত। ঘুম পাড়াত। তারপর ঘুমন্ত চ্যাম্পকে ঋতুর ঘরে পৌঁছে দিত।

বাড়ির কুঁচোদের কাছে মুমুদাদা সবচেয়ে প্রিয়। তারা কেউ কাকা বা জেঠু বলতো না। মুমু বলে ডাকতো। সকলের সব অভিযোগ অনুযোগ মুমুদাদা মন দিয়ে শুনত। কখনও কখনও তারা বেড়াতে যাবার বায়না করত মুমুদাদা একাই নিয়ে যেত- তার গাড়িতে। চিড়িয়াখানা এদিক সেদিক। কিন্তু গাড়ি ড্রাইভ করা সারাদিন এতগুলো কুঁচোকে সামলানো। সমস্যা হতো। একদম চুপচাপ হয়ে যাওয়া ঋতু তখন একটু একটু স্বাভাবিক হচ্ছে। এক-দুবার ঋতু সাথে গেল। এবার কুঁচোরা বায়না ধরল তাদের সঙ্গে ঋতুকেও যেতে হবে। ক্রমে সেটাই রুটিন হয়ে উঠল। কোথাও না গেলে মাঝেমধ্যে রাত্তিরবেলায় আইসক্রিম খাবার বায়না। মুমু ঋতু বাড়ির অন্য কুঁচোকাঁচাদের সঙ্গে চ্যাম্পকে গাড়িতে নিয়ে বের হত বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে আইসক্রিম খাইয়ে আনার জন্য। বহুদিন পর ঋতুকে আবার ঝর্ণার জলধারার মতো সহজ স্বাভাবিক দেখে বাড়ির সকলে আশ্বস্ত।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৩: মালতীর কথা…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন

বসুন্ধরা ভিলার এতগুলো ঘর এত কাজের লোকজন। তখন ঠাকুর চাকর।এখন এজেন্সির লোক। এত গাড়ি। এত লোক যাতায়াত করে যে কখন কে কোথায় রয়েছে কোথায় যাচ্ছে বলা ভারি শক্ত। এখন নয় মোবাইল হয়েছে। কে কোথায় আছে জানা যায়। সেটা তো ল্যান্ড ফোনের যুগ।

বসুন্ধরা ভিলার স্বাভাবিক জীবন যাপনের মধ্যে যে একটা ভয়ংকর অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধছিল সেটা আগের থেকে বোঝার কেউই আঁচ করতে পারেননি। কিন্তু আমার বাবার লেখায় সেই অঘটনের ইঙ্গিত ছিল।

তবে সেই অবশ্যম্ভাবী বিস্ফোরণের হাত থেকে শেষ মুহূর্তে রক্ষা পেয়ে গেল বসুন্ধরা ভিলা। বিস্ফোরণের কালো ধোঁয়ায় বসুন্ধরা ভিলার দুধ সাদা রং কালিমালিপ্ত হতে হতে বেঁচে গেল। যিনি সেই অঘটন থেকে এই পরিবারকে বসুন্ধরা ভিলাকে বাঁচাতে এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর সেই সিদ্ধান্ত ন্যায় নাকি অন্যায় তার বিচার করবে উত্তরকাল। কারণ তিনি এমন একজন মানুষ তাঁকে বিচারের অধিকার আমার নেই। তিনি আমার মা। স্বয়ং সুরঙ্গমা। —চলবে।

ঝর্ণার জলধারা। ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

কথাটা বলেই সানন্দা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। সানন্দা মাঝেমধ্যে খুব সিরিয়াসলি মজা করতো। মেয়ের সে স্বভাব মা জানতেন, ভয় দেখাস না কি হয়েছে খুলে বল। সানন্দা খাটের উপর বসে পড়ল টেবিলের পাশে রাখা কাচের গ্লাসের ঢাকনা খুলে ঢকঢক করে জল খেলো। তারপর কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজিয়ে থেকে দুম করে বলে উঠল।
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content