মঙ্গলবার ২৮ জানুয়ারি, ২০২৫


খালি পড়ে থাকা বেঞ্চ। ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

বাবুদাদা মানে সৌরভ সেনগুপ্তর কথায় ফিরব। দেওঘরের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের প্রেসিডেন্ট মহারাজের তত্ত্বাবধানে বাবুদাদা ভালোভাবে ক্লাস ইলেভেন পাশ করলো। এই মাঝের সময়টা বাবুদাদা একেবারেই কলকাতায় আসেনি। মানে তাকে আসতে দেওয়া হয়নি। ব্যতিক্রম শুধু পুজোর কটা দিন। আমার মা তাকে প্রায় আগলে রাখতেন। ক্লাস নাইন থেকে ইলেভেন এই সময়টা প্রায় প্রত্যেক মাসে বাবুদাদার সঙ্গে কেউ না কেউ দেখা করতে যেত। পিসিমণি আমার মা বড়জ্যাঠামণি মেজ্জ্যাঠামণি এক দু’বার বাবাও গিয়েছেন। আর প্রতিবারই সঙ্গে যেতেন বসুন্ধরা ভিলার অরিয়ান বা কালপুরুষ তারক নিয়োগী। বাবুদাদাকে বুঝতে দেওয়া হতো না যে তাকে বসুন্ধরা ভিলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ইলেভেনের পর বাবুদাদাকে বেনারসের হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করা হলো। বাচ্চা মহারাজ তখনও বেনারসে ৭৫ বছরের প্রৌঢ়। কিন্তু তখনও সুঠাম কর্মক্ষম। বাবুদাদা যেমন ইচ্ছে ছিল ঠিক সেভাবেই প্রি-ইউনিভার্সিটি পাশ করার পর ফ্যাকাল্টি অফ সাইন্সে কেমিস্ট্রি নিয়ে ভর্তি হল। পরবর্তীকালে এই ফ্যাকাল্টি অফ সায়েন্স হয়ে গেল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স। স্কুল এবং প্রি-ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট ভালো থাকলেও কি এক অলীককারণে কলেজে গিয়ে বাবুদাদার রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করল। যথেষ্ট ভালো ছাত্র। কিন্তু কলেজে গিয়ে সে মন দিয়ে পড়াশোনা করত না। ক্লাস করত না। বাবা মার আলোচনা থেকে সে সময় শুনেছি, দাদু ভেবেছিলেন বাবুদাদাকে বিদেশে পাঠিয়ে মাস্টার ডিগ্রি করিয়ে আনবেন। কিন্তু বাচ্চা মহারাজের সঙ্গে পরামর্শ করে বাবুদাদাকে কলেজের পড়াশোনার অমনোযোগের জন্য কোনরকম চাপ দেওয়ার কথা ভাবা হয়নি।
আজকে ভাবতে বসে পরবর্তীকালে বাবুদাদার সঙ্গে কথাবার্তার সূত্রে আমার যেটা মনে হয় স্কুলে গিয়ে একটা নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে বাবুদাদা পড়াশোনায় মন দিয়েছিল। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ পৌঁছবার পর সে বুঝতে পারল যে তাকে অমিতাভ সেন মনীষা সেনের আওতা থেকে দূরে রাখার জন্য বসুন্ধরা ভিলা থেকে প্ল্যান করে সরিয়ে রাখা হয়েছে। যখন বয়স কম ছিল তখন বাড়ির বাইরে আর কোথাও যোগাযোগ রাখার উপায় ছিল না। কলেজ হোস্টেল থেকে বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়টা অনেক বেশি ছিল। বাবুদাদা যাদের সঙ্গে টিউশন করত সেই ছাত্রদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। বাবুদাদা কোনও ভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। খুব সাধারন নম্বর পেয়ে বাবু দাদা গ্রাজুয়েশন করলো। কেমিস্ট্রি অনার্সটুকুও ছিল না পাসকোর্সে স্নাতক পরীক্ষায় পাশ করতে হল।

এতদিন কলকাতার বাইরে থাকার জন্য বাবুদাদা হিন্দিতে বেশ সড়গড় ছিল। বাচ্চা মহারাজ ভেবেছিলেন যে আশ্রম পরিচালিত স্কুলের বাবুদাদার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। আর্থিকভাবে চাকরির হয়তো প্রয়োজন ছিল না কিন্তু স্বাবলম্বী হবার জন্য সেটা অত্যন্ত দরকার ছিল। বাবুদাদার রেজাল্ট সে উপায়টা রাখল না। তখন আর চাকরি পাওয়াটা রাস্তার ধারে খালি পড়ে থাকা বেঞ্চ নয়- যে ইচ্ছে করলেই বসে পড়া যাবে।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৪৭: জেএনইউ, প্রকাশজি, রক্তকরবী, বিশু পাগল ও নন্দিনী

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-২: একলা চলো রে…

২৫ জুন, ১৯৭৫ থেকে ২১ মার্চ, ১৯৭৭ পর্যন্ত ২১ মাস ধরে দেশে জরুরি অবস্থা ও ধরপাকড় চালু হল। তারকবাবুর পরামর্শে দাদু বাবুদাদাকে বসুন্ধরা ভিলায় ফিরিয়ে আনলেন। সঙ্গতকারণেই বাবু দাদাকে এই সময় বাড়ির বাইরে বেরোতে বাধা দেওয়া হতো। আর এই বাধার জন্যই বাবুদাদা থেকে থেকে ক্ষেপে উঠত। ভয়ংকর সে রাগ। কাপডিশ ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেলছে। বইখাতা ছিঁড়ে ফেলতো। পাগলের মত চিৎকার করতে থাকত। কিছুদিন তাকে সামলানোর জন্য বাড়িতেই মানসিক চিকিৎসা করানো হতো। এবং মাঝেমধ্যে যখন তাকে সামলানো যেত না তখন ঘুমের ওষুধও দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হোত।

এত কিছু তখন আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এটা দেখতাম যে বাবুদাদা উদভ্রান্তের মতো থাকে। চুল দাড়ি কাটে না। ময়লা পোশাক-আশাক পরে। গোটা ঘরের দেওয়ালে পেন্সিল দিয়ে কেমিস্ট্রির ফর্মুলা স্ট্রাকচার এসব লিখে রাখে। বিড়বিড় করে একা একা কথা বলে। আর মাঝেমধ্যে তার আক্রোশ উগরে দেয় আমার দাদু বিনয়কান্তি বড়জ্যাঠামণি গগনকান্তি আর তারক নিয়োগী ওপর। বাবুদাদার ধারণা এই তিনজন মিলে তার স্বাভাবিক জীবনটাকে এরকম অস্বাভাবিক করে তুলেছে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৭: হিন্দু-মুসলিম মিশ্র দেবতা সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর

অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-২: ইতিহাসে অসম

আমার পিসিমণি চিরকালই ভীষণ চুপচাপ। পিসেমশাই বেপরোয়া শেয়ার কিনতে গিয়ে কাবলিওয়ালার থেকে ধার দেনা করে কপর্দকশূণ্য অবস্থা হয় এবং অফিসের শেষে সন্ধ্যেবেলা ডালহাউসির ম্যাকিনন-ম্যাকেন্জি বিল্ডিং-এর চারতলার খোলা জানলা দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার পর দুই ছেলেকে নিয়ে বসুন্ধরা ভিলার আশ্রিতা হবার কারণে পিসিমণি আজীবন কুঁকড়ে থাকতেন। তাকে একটু মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য দেবার জন্য বড়ঠাম্মি বসুন্ধরার পরামর্শে আমার দাদু বিনয়কান্তি দত্ত গড়ে দিয়েছিলেন বসুন্ধরা ফ্যাশন। তারপর যেন মাথা তুলে জীবনের আলো বাতাস নেবার অবস্থায় গিয়ে পৌঁছলেন। বেশ চলছিল কিন্তু বাবুদাদার আচমকা পরিবর্তনে আবার পিসিমণি মুষড়ে পড়লেন। বাবুদাদার ছোটভাই গৌরবও দাদাকে নিয়ে খুব লজ্জিত হয়ে থাকতো। সে নিজে এতটা সফল একজন মানুষ অথচ তার দাদাকে নিয়ে সর্বক্ষণ সে অস্বস্তিতে ভোগে। এরমধ্যে পিসিমণির শ্বশুর শাশুড়ি মারা গিয়েছেন। যে তার বাড়ির ভাগাভাগি নিয়ে পিসিমণির দেওররা এসে বসুন্ধরা ভিলায় কথা বলতে চেয়েছিলেন। পিসিমণি চাননি।

চাননি মূলত দুটো কারণে। এক তো বাবুদাদা কখন কী বলে বসে তার ঠিক নেই। আর দ্বিতীয় কারণ আমার ন’কাকিমা সুজাতা। সুজাতা এবং তার ছেলে প্রণয়ের মূল শত্রু ছিল বাবুদাদার ছোটভাই গৌরব। কিন্তু কোনওভাবেই গৌরবকে হারাতে না পেরে আমার ন’কাকিমা পিসিমণিকে টার্গেট করতেন। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বসুন্ধরা ভিলায় থাকা বসুন্ধরা ভিলার টাকায় ব্যবসা করা ছেলেদের পড়ানো এবং এখন বাড়িটাকে একটা পাগলা গারদ করে তোলা, এই সবই নাকি পিসিমণির কারণে হচ্ছে।
বসুন্ধরা ভিলার সকলেই সুজাতা দত্ত এবং তার ছেলে প্রণয়কান্তি দত্তকে এড়িয়ে চলতেন মা লক্ষ্য রাখতেন যাতে কখনোই পিসিমণি আর ন’কাকিমা মুখোমুখি না হন। যাইহোক এসব কারণেই পিসিমনি ট্র্যাংগুলার পার্কে বসুন্ধরা ফ্যাশনের শোরুমে দেওরদের ডেকে দলিলপত্রে শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির কোনও অংশ নেবেন না একথা লিখে দিলেন। পিসিমণি তখন স্বাবলম্বী তাই দেওরদের বিয়ে বা তাদের ছেলেদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে লোক-লৌকিকতার কোন ত্রুটি রাখেননি।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৫: তিনচুলে ও লেপচাজগৎ এর মেঘ-আলয়ে

বসুন্ধরা ভিলার বাসিন্দাদের মানসিক ফাটলের মধ্যেই পারিবারিক ফাটল বাড়ছিল। যেটা সবুজ লনের মধ্যে ঝকঝকে সাদা প্রাসাদোপম বসুন্ধরা ভিলার বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না।

খাবার অর্ডার দিতে মানা করেছিল অরুণাভ। কফি দিতে বলেছিল। জেএনউ-তে পড়ার সময় অরুণাভর চেহারা একটু বাল্কি ছিল। এখন অনেক ছিপছিপে। আগের থেকে একটু ফর্সাও লাগছে। চকচকে। একে কি গ্ল্যামার বলে? চেহারা বজায় রাখতে অরুণাভ এখন দুধ ও চিনি ছাড়া কফি খায়। দিল্লিতে চিনি দুধ দিয়ে মালাই চা খেতে খুব পছন্দ করতো। বাবলি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল আর এ সব ভাবছিল।
—কিরে কী দেখছিস?
—টেলিভিশন সুপারস্টার।
—রাখতো। সুপারস্টার। মাস মাইনের অভিনেতা। তুই এইসব সিরিয়াল দেখিস নাকি?
—না দেখার কী আছে? অভিনয় তো ।
—তোর কাজ করতে ইচ্ছে করে না।
হাসতে গিয়ে বাবলির মুখ চলকে কফি পড়ে গেল।
—পাগল নাকি?
—কেন সুস্থ মানুষেরা অভিনয় করে না বলছিস।
—আমি একেবারেই সে কথা বলিনি। আমার অতো ট্যালেন্ট নেই। তখনও ছিল না এখন তো নেই-ই। আর প্রকাশজি ঘষেমেজে করিয়ে নিতেন। আর সেটা অ্যামেচার অভিনয় ছিল। তোদের মত প্রফেশনাল তো কিছু নয়। ছাড়, তুই বিয়ে করবি না ?
—কেরিয়ার করতে গেলে বিয়েটা এখন করা যাবে না।
—কেরিয়ার করতে করতে তো বুড়ো হয়ে যাবি।
—তখন একটা বুড়ি খুঁজে নেব।
—রিয়েলি?
—জোক্স অ্যাপার্ট এখন কত ফ্যাশানেবল ফ্রেমের চশমা পাওয়া যায়। তুই এমন একটা বড় দিদিমণি মার্কা মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরিস কেন?
—তোর মতো আনম্যারেড আধবুড়ো হাণ্ডসামদের থেকে নিজেকে প্রোটেক্ট করতে।—চলবে।

ছবি: প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/ পর্ব-৪৯

বাবা এই লেখাটা শুরু করেছিলেন ২০০৯ নাগাদ। লেখাটার কোন নাম ঠিক করেননি। মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা লেখার শেষ করে তারপর লেখার নাম ঠিক করতেন। ২০১০ এ বাবা যখন মারা যান সেদিনও এই লেখাটা নিয়েই বসেছিলেন। সেদিনের লেখার কাগজ পেন মা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। পরে আমাকে দিয়ে বলেছিলেন।blue>

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content