রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী

নতুন অফিস


ক্লাইভ রো-এর পুরোনো অফিস থেকে লোয়ার রডন স্ট্রিটের ঝকঝকে বাড়িতে উঠে এল বসুন্ধরা গ্রুপের নতুন অফিস৷ আর সকলকে চমকে দিয়ে বিনয়কান্তি দত্ত কোম্পানির বহু সুখদুঃখের সঙ্গী সবচেয়ে প্রবীণ কর্মী তারক নিয়োগীর হাতে কাঁচি ধরিয়ে উদ্বোধনের লাল ফিতে কাটতে দিলেন৷ বোতাম টিপে পর্দা সরানো নয়—দাদু ছিলেন ট্র্যাডিশন্যাল ফিতেকাটা উদ্বোধনে বিশ্বাসী৷

অবাক বিস্ময় আর দুরন্ত আবেগে তারকবাবুর চশমা ছাপিয়ে দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল সেদিন৷ বিনয়কান্তি বিব্রত তারকবাবুকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে দিয়েছিলেন লাল ফিতে বাঁধা নতুন অফিসের বিশাল ঝকঝকে কাচের দরজার দিকে৷ উপস্থিত গণ্যমান্যেরা অবাক এবং খুশি। বাড়ির সকলে হইহই করে করতালি দিলেও সেদিন সবাই যে খুশি হয়নি সেটা বোঝা গিয়েছিল। তবে বিনয়কান্তি কখনই এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাননি। তার মন যেটা সঠিক বলেছে সেটা করেই ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন তিনি। তাই সেদিনও কোনও আমল দেননি।

প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গত বিনয়কান্তি দত্ত-র সময় থেকেই নামের ইনিশিয়াল ধরে বলার ব্যাপারটা চলত। এমনকী বিনয়কান্তি চাইতেন ছেলেরাও যাতে তাকে অফিসে ‘বিকেডি’ বলে ডাকে। সেই থেকে এখনও একই নিয়মে চলছে। অফিসে ঢোকার পর বাবা ছেলে দু’জন কর্মী, যারা কোম্পানির কথা ভাববে। তাই বিকেডির করা এই নিয়ম বদলায়নি। অফিসের কর্মীরাও এই নিয়ম মেনে চলেন। বিনয় চাইতেন না কেউ কাউকে প্রভু মনে করুক তাই স্যার বলার ব্যাপারটা একেবারেই ছিল না। তবে ব্যতিক্রম শুধু তারকবাবু। তিনি যাতে সকলকেই নাম ধরে বাবু বলতে পারেন সেই নির্দেশ দিয়েছিলেন বিনয়কান্তি। তবে তারকবাবু কোনও আপত্তি না শুনে বিনয়কান্তিকেই শুধু বিকেডি বলতেন, বাকিরা তারকবাবুকে বাবু বলে সম্বোধন করতেন। বিনয়কান্তি বলতেন তিনি ট্রেড আর ট্র্যাডিশন ছাড়া কিছু বোঝেন না। তাই এই দুটোর কোনওটাকেই ছাড়েননি। সেই পরম্পরা আজও চলছে।

১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের অস্থির সময়ে জন্ম নিয়েছিলেন এই বংশের প্রবাদপুরুষ বিনয়কান্তি। প্রকৃতির নিয়মে হয়তো আরও কিছু দিন বাঁচতেন কিন্তু নানান পারিবারিক ঝড়ঝাপটায় বিধ্বস্ত বিনয়কান্তি দত্ত চলে গেলেন ৮২ বছর বয়সে।

গগনকান্তি


বিনয়কান্তি ও স্বর্ণময়ীর ছয় ছেলে এক মেয়ে। বড়ছেলে গগনকান্তি মানে পারিবারিকভাবে আমার বড় জ্যাঠামণি আর অফিসের নিয়মে জিকেডি। বিনয়কান্তির পর এই গগনকান্তি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়েছিলেন। তবে আমাদের মানে এই তৃতীয় প্রজন্মে এসে কর্ণধার ব্যাপারটা আর রাখা হয়নি—নিয়মমতো বোর্ড অফ ডিরেক্টরস-এর একজন চেয়ারম্যান আছেন তিনি গগনকান্তির বড়ছেলে চিন্ময়কান্তি দত্ত—সংক্ষেপে সিকেডি।

মেজছেলে বিকাশকান্তি তারপর মেয়ে শান্তিলতা। তারপর আমার বাবা অমলকান্তি। বাবার পর তিন ভাই তরুণকান্তি, বিমলকান্তি আর কমলকান্তি। মেজজেঠু বিকাশকান্তি আর ন’কাকা তরুণকান্তি পারিবারিক ব্যবসায় বড় জ্যাঠামণির দুই লেফটান্যান্ট। দাদুর বিজনেস যে আজকে এখানে পৌঁছেছে তার মূল কারিগর জ্যাঠামণি মেজজেঠু আর ন’কাকা। ফুলকাকা ডাক্তার বিমলকান্তি আয়ারল্যান্ডে থাকতেন। এক আইরিশ ডাক্তারকে বিয়ে করেন। কাকিমার নামের বানান আর উচ্চারণে ফারাক ছিল। Ciara– আমাদের হিসেবে সিয়ারা বা কিয়ারা হতে পারত কিন্তু বাবা বলতেন—উঁহু! সঠিক আইরিশ উচ্চারণ হল ‘কীরা’!!

ফুলকাকা-কীরা কাকিমার দুই মেয়ে Roisin আর Shannon। শিখে নিয়েছিলাম নামের উচ্চারণ আর তাদের নামের বাংলা মানে। রয়সিন নয় রোসিন। মানে গোলাপের কুঁড়ি আর শ্যানন মানে wise river। আমাদের বাড়ির অন্য কোনও মেয়ের নাম নদীর নামে দেওয়া হত না। তাতে নাকি অমঙ্গল—এ আমার ঠাম্মি স্বর্ণময়ীর বিশ্বাস ছিল। এখনও সবাই সেটা মানে। শ্যাননের জন্মের বছর দুয়েকের মধ্যেই ফুলকাকা-কীরা কাকিমার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। এতে শ্যাননের নামকরণের কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল কি না জানি না তবে ঠাম্মি স্বর্ণময়ীর বিশ্বাসের মর্যাদা এ সংসারে বেড়েছিল।

ছোটকা কমলকান্তি এক বিচিত্র মানুষ। আমার বাবার মতোই ব্যবসায় খুব একটা মাথা দেননি। তার নেশা ছিল দুটো—থিয়েটার আর ফুটবল। ছোটকা শ্যামবাজার থিয়েটারপাড়া আর ময়দানে ‘কেকে’ নামে খুবই পরিচিত ছিল। কমলকান্তির গল্প সিনেমার মতো। সময় করে সে গল্প লিখব।

গগনকান্তি ও অমলকান্তি ছোটবেলায় তাদের বাবার কঠিন পরিশ্রমের দিনগুলো দেখেছে। যখন তারা শ্যামবাজারের ভাড়াবাড়িতে থাকত। মা ঠাকুমা ছয় ভাই- এক বোন। যখন বিনয়কান্তি ট্রামে চেপে ক্লাইভ রো-তে অফিস যেতেন—গগনকান্তি তখন বছর ১১ আর আমার বাবার বয়স সাত। সন ১৯৪৪।

বিনয়কান্তি তখন কাজ করতেন পিটারসন টি কোম্পানিতে৷ শুরু করেছিলেন স্ট্র্যান্ড রোডের চায়ের গুদাম থেকে৷ স্টোর ক্লার্ক থেকে পদোন্নতি হয়ে ক্লাইভ রো-তে অফিসে বসার সুযোগ এল। ম্যাট্রিক পাশ বিনয়কান্তির সততা ও উৎসাহ দেখে উইলিয়াম পিটারসন বিনয়কে সবেতন ছুটি দিয়েছিলেন পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাশ করার জন্যে।

সাতচল্লিশের স্বাধীনতার পর পিটারসন সাহেব দেশে ফিরে যেতে চাইলেন। বিনয়কে বললেন সে কোম্পানি নিয়ে নিতে। কারণ সাহেব জানতেন ততদিনে বিনয়কান্তি কোম্পানি চালাবার দক্ষতা অর্জন করেছে। কিন্তু কোম্পানি কিনে নেওয়ার মতো আর্থিক সংগতি বিনয়ের নেই এটাও তিনি জানতেন। সাহেব বলেছিলেন তুমি যে টাকা জোগাড় করতে পারবে আমি তাতেই তোমাকে কোম্পানি লিখে দেব৷ কিন্তু আমি বিনামূল্যে এই কোম্পানি তোমায় দেব না৷ ব্যবসায় নিজের সম্বল জড়িয়ে থাকলে তবে তুমি সে ব্যবসার মর্যাদা করবে। মায়ের ও স্ত্রীর যা গয়নাগাটি ছিল বিক্রি করেও নামমাত্র সাম্মানিক মূল্য জোগাড় হল৷ পিটারসন সাহেব বিকেডি-কে কোম্পানির স্বত্ব লিখে দিলেন। সাহেবের নিজের দুটো চা বাগান ছিল, তার মূল্য অনেক। বিনয় সাহেবকে বলেছিল সে চা-বাগান উচিত দামে মাড়োয়ারিদের বেচে দিতে। কারণ চা-বাগান চালাবার অনেক মূলধন প্রয়োজন সেটা বিনয়ের নেই। তাই মায়ের নামে বিনয়কান্তি নতুন কোম্পানির নাম রাখলেন বসুন্ধরা টি ট্রেডার্স কোম্পানি। বিভিন্ন চা-বাগানের চা নিলামে কিনে খুচরো ও পাইকারি চা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি—এই ছিল শুরু। পিটারসন সাহেবের কাছে থাকতে থাকতে চায়ের খুচরো ও পাইকারি বাজার, নানান বাগানের চায়ের কোয়ালিটি এসব ছিল বিনয়কান্তির নখদর্পণে। ফলে পরিশ্রমের সাফল্য আসতে শুরু হল। কিন্তু বিনয়কান্তি ছিলেন আদ্যন্ত একজন সৎ মানুষ। তাই সে পিটারসন সাহেবের লন্ডনের ঠিকানায় কোম্পানির যোগ্যমূল্যের বাকি টাকাটা একটু একটু করে ভারতীয় মূল্যে শুধে দিতে শুরু করল। বিনয় মনে রেখেছিল যে জলের দামে সে মালিকানা পেয়েছে সেটা ছিল অগ্রিম। বাকিটা ধার। তাই একটু একটু করে ধার শুধতে হবে। শুধু তাই নয়, পিটারসন সাহেবকে নিয়মিত কোম্পানির লভ্যাংশ পাঠাতেন বিনয়কান্তি। চিঠিতেও যোগাযোগ ছিল। পরে যখন বিনয়কান্তি নিজের ব্যবসায় যুক্ত কর্মীদের জন্যে স্টাফ ওয়েলফেয়ার ফান্ড তৈরি করলেন তখন পিটারসন সাহেব উকিলের চিঠি করে, তার এ যাবৎ সমস্ত প্রাপ্য বসুন্ধরা কোম্পানির সেই স্টাফ ওয়েলফেয়ার ফান্ডে দান করে দেন। অবাক কাণ্ড ১৯৮৭-তে বিনয় যখন মারা যান তার কয়েক মাস পরেই বিদেশ থেকে পিটারসন সাহেবের মৃত্যুর খবর পৌঁছে ছিল। কোম্পানিতে একদিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল।

তারক নিয়োগী


তারক নিয়োগী অকৃতদার। কলেজ স্ট্রিটের এক মেসবাড়িতে থাকতেন। নিরাভরণ অনাড়ম্বর জীবন। খুব কম কথা বলতেন। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা টাকমাথা ছোটখাট চেহারার মানুষ। বোধ এবং বুদ্ধি তাঁর চেহারা ছাপিয়ে যায়৷ আমি যখন দেখেছি তখন তার চোখে মোটা কাচের হাই পাওয়ারের চশমা। পকেটে একটা কৌটোতে ছাড়ানো বড় এলাচ থাকত। কথা বলতে বলতে কখনও-সখনও একটি মুখে দিতেন। বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। বাবাকে বলতেন, বসুন্ধরা ভিলার ঐশ্বর্য বৈভব কিছুই আপনাকে স্পর্শ করে না৷ আপনি সেই অচিন নক্ষত্র। আপনার উজ্জ্বলতায় আমরা আশপাশের সবাই আলোকিত। এক কক্ষচ্যুত নক্ষত্র আপনি।

বাবাও তারকবাবুকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। নতুন বই প্রকাশ পেলেই তারকবাবুকে এককপি উপহার দিতেন। বলতেন, এগুলো ঘুষ। ভাগ্যিস আপনার কলমটা অঙ্ক ছেড়ে কথা লেখা শুরু করেনি, লেখা শুরু করলে আপনি আমাদের ভাত মারতেন।

হাসতে হাসতে তারকবাবুর উত্তর দিতেন, একথা একটা কাগজে লিখে সই করে দিন অমলবাবু। আমি বুকে সেঁটে ঘুরে বেড়াব বাসেট্রামে, কন্ডাক্টর ভাড়া নেবে না।

প্রথম যেবার বাবার সঙ্গে অফিসে গিয়েছিলাম তারকবাবু আমায় দুটো বড় এলাচের দানা খেতে দিয়েছিলেন।
সময়টা খুব দ্রুত পালটে গেল। না বিনয়কান্তির মতো উদ্যোগী পুরুষ, না তারক নিয়োগীর মতো নিঃশব্দ কর্মী, আজ দুজনেই বড় বিরল। —চলবে
পরের পর্ব আগামী রবিবার
আমরা চিঠি দেওয়া প্রেম দেখেছি। ভেজানো দরজা ক্লাস রুমের ভেতরে, দোল- সরস্বতী পুজোয় পুরনো প্রেম ভেঙে নতুন প্রেম গড়তে দেখেছি। বাড়ি পালিয়ে কালীঘাটের বিয়ে—চুপি চুপি পিছনের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে বিয়ের রাতে পালানো কনের অনেক গল্প শুনেছি। আবার এখন ফেসবুকের প্রেম হোয়াটসঅ্যাপে ভাঙতেও দেখেছি।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷
ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content