রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


কোটালীপাড়ার জলছবি

ফড়েপুকুর

গুহদের ব্যবসা আরও বাড়ল—কলকাতায় তারা গুদাম নিল। এর ফলে কলকাতায় পাকাপাকিভাবে বসবাসের দরকার পড়ল। কাজেকর্মে সুবিধের জন্যে কলকাতার ফড়েপুকুরে একটা পুরোনো দোতলা বাড়ি কেনা ছিল। কলকাতায় এলে তাঁরা সেখানেই উঠতেন। এদিকে বড়কর্তার খাওয়া-দাওয়ার নানারকম ধরাকাট—তাই কত্তামা ঠিক করলেন বাখুন্ডা থেকে তিনিও কর্তাবাবুর সঙ্গে কলকাতার ফড়েপুকুরের বাড়িতে গিয়ে থাকবেন। রান্নাবান্নার জন্য বসুন্ধরা এবং সঙ্গে বিনয়কান্তিকেও কোটালীপাড়ার গাছগাছালি আর টলটলে পুকুরঘেরা সোঁদামাটির গ্রাম্যজীবন ছেড়ে ইট-কাঠ-পাথরে ভরা কলকাতায় আসতে হল। কর্তাবাবু গিরিজাশঙ্কর গুহ জানতেন বিনয়কান্তি অত্যন্ত মেধাবী—তাই তিনি আবার স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। অল্পদিনেই বিনয়কান্তি নতুন স্কুলে নিজেকে মানিয়ে নিল।

বিনয় দেখল কলকাতায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকে খবরের কাগজ বিলি করে। এর জন্য পয়সাও পাওয়া যায়। সে প্রথমে মায়ের অনুমতি চাইল। মা বললেন তুমি বরং কর্তাবাবুর কাছে অনুমতি নাও। তাঁদের দাক্ষিণ্যেই আমরা কলকাতায় এসে আছি। গিরিজাশঙ্কর আপত্তি করলেন না। বললেন পড়াশোনার ক্ষতি না করে তুমি সৎপথে রোজগার করে স্বনির্ভর হতে চাও। আমি তোমায় বাধা দেব না। বিনয়কান্তি সকালে কাগজ ফিরি করত। দুপুরবেলায় স্কুল সেরে বিকেলে মায়ের কাজে সাহায্য করত। রাতে সে ইস্কুলের সব পড়াশোনা শেষ করত। সারাদিনের ধকলে কিশোর বিনয়কান্তি ক্লান্ত হয়ে ঘুমোত—কিন্তু মাকে বলত যে কাকভোরে তাকে উঠতেই হবে। না হলে কাগজ ফিরি করা যাবে না। মাঝে মাঝে বসুন্ধরা বলতেন এখন পড়াশোনা করছিস শরীরকে এত ধকল না দিলেই নয়!! বিনয় উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে মাকে মনে করিয়ে দিত, ভুলে গেছ মা! বাখুন্ডায় খুড়োর ধার শুধতে হবে যে।

জলপানি পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করল বিনয়কান্তি। গুহবাড়িতে কেউ কোনওদিন ম্যাট্রিক পাশ করেনি। গিরিজাশঙ্কর গুহ অর্ডার দিয়ে বড়সড় সোনার মেডেল বানালেন। তাতে লেখা স্নেহের বিনয়কান্তি, এই স্বর্ণপদকের চেয়েও উজ্জ্বল হোক তোমার ভবিষ্যৎ। সদাবিজয়ী ভব। আশীর্বাদক—গিরিজাশঙ্কর গুহ, বাখুন্ডা, ফরিদপুর৷

বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ-এর অনেক বদল ঘটেছে। ক্লাইভ রো অফিসে বিনয়কান্তির অফিসঘরের দেয়ালে সাজানো ছিল সেই সোনার মেডেল। লোয়ার রডন স্ট্রিটের ঝকঝকে রিশেপসনের দেয়ালেও অনেক সার্টিফিকেট অনেক অ্যাওয়ার্ডের মধ্যে সেই সোনার মেডেলের ঝকঝকে উপস্থিতি।

স্বামীর খবরাখবরের জন্য বসুন্ধরার সব চেষ্টা বৃথা হয়েছে—তবু কোনও একদিন যে তিনি ফিরবেন এই আশা নিয়ে বসুন্ধরা সধবার বেশ ছাড়েনি।

গিরিজাশঙ্করের বয়স হয়ে গেছে। একার পক্ষে কলকাতার ব্যবসা সামলানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তাঁর বড়ছেলেকে তিনি সপরিবারে কলকাতায় আসার কথা জানালেন। বড়ছেলে বড়বউমা তিন নাতি ফড়েপুকুরের বাড়ি জমজমাট করে তুলল।

এদিকে বিনয়কান্তির চোখে ঘুম নেই। মা জিজ্ঞেস করেন ছেলেকে, কী হয়েছে? বিনয় জবাব দিতে পারে না। বিএ পড়ার জন্যে কলেজে ভর্তি হবার মতো অর্থবল নেই। গুহবাড়িতে তারা আশ্রয় পেয়েছে। কত্তাবাবুর জন্য বিনয়ের ম্যাট্রিক পাশ করা হল। এরপর তো কলেজে ভর্তি করানোর বায়না করা যায় না। তাই তার একটা পাকাপোক্ত চাকরি চাই। যে টাকা জমিয়ে পরে সুযোগ পেলে কলেজে ভর্তি হয়ে আইএ-বিএ পরীক্ষায় বসতে পারবে। কিন্তু মাকে এত সব বলবে কী করে, আজ প্রায় ১৭/১৮ বছর বাবার কোনও খোঁজ পায়নি তারা। বিনয় জানে যে মা বিশ্বাস করেন তার বাবা কোনও একদিন ফিরে আসবেন। প্রতিদিন মা সেই অসম্ভব সুখবরের আশায় থাকেন। বাখুন্ডার গুহবাড়ি থেকে কোনও চিঠি এলে উদগ্রীব হয়ে থাকেন মা— বিনয়ের কাছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চান ওই চিঠিতে তার বাবার কোনও সুখবর আছে কি না? মাকে সে আর নতুন করে কোনও কষ্ট দিতে চায় না। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বিনয় বলে কিছু হয়নি মা। ভাবছি আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় আমাদের নিয়ে যাবে? বাখুন্ডা থেকে ছ’মাস বয়সে দাদু নিয়ে গেলেন কোটালীপাড়ায়। দাদু চলে গেলেন তুমি আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলে বাখুন্ডায়— তারপর এসে উঠলাম গুহবাড়িতে। তারপর বাখুন্ডা থেকে কলকাতার ফড়েপুকুর। ম্যাট্রিক পাশ করলাম। কত্তাবাবু সোনার মেডেল দিলেন। ভাবছি এরপর কী? তুমি তো আমার জন্য সারাটা জীবন এত কষ্ট করলে মা? আমি কি কিছুই করতে পারব না তোমার জন্যে। কর্তাবাবু কত্তামাকে এ গুহপরিবারের সকলকে আমি খুব সম্মান করি মা। কিন্তু আমার বাকি জীবনটা কি এভাবেই এ বাড়ির আশ্রিত হয়েই কেটে যাবে?

বিনয়কান্তিকে গুহবাড়ির কুচোকাঁচাদের পড়ানোর কাজে লাগানো হল। ক্রমে তাকে গুহবাড়ির পাটের ব্যবসার হিসাব রাখার কাজটাও বিনয়ের কাছেই এল। গুহবাড়ি অন্নদাতা আশ্রয়দাতা বলে বাড়িতে মুখে কিছু বলত না। কিন্তু খাতা-লেখার কাজটা সে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। কখনও কখনও গুহবাড়ির বড়ছেলে কাপ্তেনি করে বাজার থেকে ইংরেজি কাগজ কিনে নিয়ে আসতেন বিনয়কান্তির ভরসায়। বিনয় ইংরেজি কাগজ পড়ে তার বাংলা তর্জমা শোনাবে। আর কত্তাবাবুর বড়ছেলে—বারান্দায় আরামকেদারায় বসে রোদ খেতে খেতে তা শুনবেন এবং মন্তব্য করবেন। বিনয় রোদভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরকে খোঁজার চেষ্টা করত। মনে মনে বলত ‘কতদিন আর কতদিন এভাবে গোলামি করে বেঁচে থাকতে হবে?’

সারাজীবনের এত ঘাত-প্রতিঘাতে বসুন্ধরা ভেতরে-ভেতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল— তারপর এই এতবছর ধরে স্বামীকে নিয়ে একটা আশানিরাশার দোলায় বেঁচে থাকা—সধবার বেশ আঁকড়ে থাকা—বয়স একটু বাড়তে না বাড়তেই সে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত। বসুন্ধরা ভয় পাচ্ছিল। তার যদি কিছু একটা ঘটে যায় তাহলে বিনুর কী হবে? বিনয়ের একটা বিয়ে দিয়ে তাকে একটা ভালো মেয়ের হাতে দিতে পারলে তিনি শান্তি পাবেন। নিশ্চিন্তও হবেন। কিন্তু বিনয় রাজি নয়। সে মাকে বলে দুশ্চিন্তা কোরো না মা। এত সহজে তোমায় আমি ছাড়ছি না। আর গুহবাড়ির পাটের জমাখরচের হিসেব লিখে আর কচিবাচ্চাদের এবিসিডি পড়িয়ে জীবনের ইতি টানতে আমি রাজি নই। আমি সুযোগের অপেক্ষায় আছি মা। একটা। একটা পাকা চাকরির সুযোগ। যেখানে আমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারব। যেখানে নিজের উন্নতি করা যাবে। যেখানে পরিশ্রম করার উৎসাহ পাওয়া যাবে। আর তুমিই তো ছোটবেলায় শিখিয়েছ মা— পাঁচজনের ভিড়ে মিশে থাকা একজন নয়—আলাদা করে পঞ্চম জন হয়ে উঠতে হবে।

বসুন্ধরা অবাক হয়েছে ছেলেকে দেখে আর তার মনে পড়ে যায় দেওর কৃষ্ণসুন্দরের মুখে শোনা সেই জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী।

শ্যামসুন্দরের যদি পুত্র হয় তবে সে হবে একজন উদ্যোগী পুরুষ…তবে তাকে অনেক সংগ্রাম অনেক কষ্টের রাস্তায় সফল হতে হবে।

কাকা কৃষ্ণসুন্দরের মৃত্যুর কথাটুকু জানালেও বসুন্ধরা সে কথা বিনয়কান্তিকে এখনই বলতে চান না—যদি সত্যি সত্যি কোনওদিন জীবনে বিনু সেরকম উন্নতি করতে পারে আর সেদিন যদি বসুন্ধরা বেঁচে থাকেন তাহলে ছেলেকে তিনি সেই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা শোনাবেন। এখন বললে অযথা ছেলের মনে একটা চাপ তৈরি হবে। বিচক্ষণ বসুন্ধরা তা চায় না। বাবার দায়িত্বটাও যে মাকেই নিতে হবে…

জাহাজঘাটায় মাঝে মাঝে ইংরেজ সাহেবসুবোরা আসত—গুহবাবুর বড়ছেলে বাবার কাছ থেকে ব্যবসার কাজকর্ম শিখে নিয়েছে—কিন্তু লালমুখো সাহেবের ইংরেজি শুনে যে সব গুলিয়ে যায়—তাই সঙ্গে বিনয়কান্তিকে নিয়ে জাহাজঘাটায় যাওয়া শুরু হল। বিনয় উপলব্ধি করল এ সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।

চটকলে এই পাট চালান দেওয়ার সূত্রে—আলাপ হল বছর তিরিশের এক আমেরিকান সাহেবের সঙ্গে। উইলিয়াম পিটারসন। সাহেবের মেমসাহেব ব্রিটিশ। সেইসূত্রে সাহেব থাকেন লন্ডনে। ১৮ বছরের বিনয়কান্তির মুখে ঝরঝরে ইংরেজি শুনে পিটারসন সাহেব অবাক হয়ে গেলেন।

এই সাবলীলভাবে ইংরেজি বলার অভ্যেসটা তাকে রপ্ত করতে হয়েছে। প্রথম প্রথম জাহাজঘাটায় সে সাহেবদের সঙ্গে কথাই বলতে পারত না—লজ্জায় অপমানে কান লাল হয়ে যেত। বাড়ি ফিরে গিয়ে রাতে দরজা জানলা দিয়ে—কত্তাবাবুর বড়ছেলের আনা ইংরেজি কাগজ থেকে চেঁচিয়ে পড়ত। তারপর সাহেব কী বললে তার কী উত্তর হবে—খাতায় লিখে লিখে অভ্যেস করত—ভাষাটা বিনয় ভালোই জানে কিন্তু বলার বাধাটা যে তাকে কাটাতেই হবে। ছোটবেলায় দাদু বলতেন গীতাধ্যানমে আছে জগদীশ্বর সর্বশক্তিমান। তিনি কৃপা করলে ‘পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্।’ কিন্তু পঙ্গুকে পাহাড় টপকানোর বাধা অতিক্রম করতে হবে নিজের চেষ্টায়—নিজের জেদ দিয়ে তার অক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে—সেটাকেই স্বামীজি বলেছেন আত্মশক্তি। সেই অন্তরের শক্তির ক্ষমতা অসীম। আর সেই চেষ্টা সেই ক্ষমতা দিয়েই বিনয় সাহেবদের সঙ্গে সমানে সমানে ইংরেজি ভাষায় কথা বলা অভ্যেস করে ফেলল।

তারপর প্রায়ই দেখা হতে লাগল সাহেবের সঙ্গে। খাতিরও হল। সাহেবের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলার সুবাদে গুহবাবুদের ব্যবসার কাজেও সুবিধে হতে লাগল।
পিটারসন একদিন একা পেয়ে কথাপ্রসঙ্গে বিনয়কে জিজ্ঞেস করলেন— সে কি গুহবাবুদের ওখানে চাকরি করে? বিনয় সত্যি বলল। গুহবাবুরা তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কলকাতায় এনে রেখেছেন। ফড়েপুকুরে ওদের বাড়িতে মা রান্নার কাজ করেন। ওনারাই বিনয়কে ম্যাট্রিক পাশ করিয়েছে—তাই কৃতজ্ঞতাবশত সে ওদের ব্যবসায় সাহায্য করে— কিন্তু সে গুহবাবুদের কাছে কোনও পাকা চাকরি করে না।

পিটারসন তাকে পরদিন তার অফিসে দেখা করতে বললেন। ছোট্ট চিরকুটে ঠিকানা লিখে দিলেন। —চলবে
ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি

ফড়েপুকুরের গুহবাড়ি

পরের পর্ব আগামী রবিবার
এত বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে তোমায় জানিয়ে রাখচি- তোমার বয়স কম উৎসাহ শক্তি উদ্যম বেশি। আবার অভিমানও বেশি। মনে রেখো বাবা কাজের জায়গায় তোমার গুণটাই রাজা!! তোমার মান অভিমানের এখানে খুব একটা কদর নেই। আর একটা কথা যে কাজ করতে চায় তার জন্য কাজের শেষ নেই। যে ফাঁকিবাজ নিকম্মা – সারাটা দিনই এডালে ওডালে বসে কাটিয়ে দেয়। তার কাজ করার অভ্যেস নেই।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷
ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content